মুহিবুল মুকতাদির তানিম:
মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার। আর একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার।

এই উপাত্ত আমাদের জন্য খুশি হওয়ার মত অর্জন কিন্তু খুব বেশি আত্নতৃপ্তিতে থাকার মত হয়ত নয়।

আমরা অনেকেই জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নিয়ে বেশ বাগাড়ম্বর বা স্তুতি করে থাকি। দেশের জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে – কিন্তু এতে কি দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধি হচ্ছে বা জীবনযাত্রার মানের আশানুরূপ অগ্রগতি ঘটছে?

মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি হলো গাড়ির স্পিডোমিটারের মতো। অর্থনীতি কতটা দ্রুত বা মন্থর তা বোঝা যায় এটি দেখে। তবে স্পিডোমিটার বলতে পারে না গাড়িটি সঠিক পথে চলছে কি না। পথ সঠিক না হলে গতি বৃদ্ধিতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। জিডিপি সামগ্রিক পরিমাণগত হিসাব দেয়। প্রবৃদ্ধিতে জিডিপি বাড়ে, কিন্তু এটি সমৃদ্ধির অন্যতম নির্দেশক নয়। বেশির ভাগ মানুষের জীবনমানের পতন সত্ত্বেও সম্পদশালী কিছু মানুষের আয় বৃদ্ধি কোনো দেশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি এনে দিতে পারে। জিডিপি পদ্ধতিতে কোনো দেশের আর্থিক অগ্রগতি পরিমাপ করা গেলেও এটি ওই দেশের মানুষের সমৃদ্ধি বা সুখের অন্যতম নির্দেশক নয়।

বাস্তবতা হচ্ছে- মাথাপিছু আয় বেশি হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন হতে পারে। আফ্রিকার বহু দেশে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, মধ্যম আয়ের বিবরণে তারা বাংলাদেশ থেকে অনেক আগে থেকেই এগিয়ে, কিন্তু সেখানে মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। নাইজেরিয়ার মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো, এটা বলা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং আরও খারাপ। মায়ানমারের ও মাথাপিছু আয় আমাদের সমান, তাই বলে কি তাদের সমৃদ্ধ বলা যাবে?

বস্তুত বাংলাদেশের জিএনপি এবং মাথাপিছু আয়ের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পেছনে অন্যতম অবদান হচ্ছে প্রবাসী আয়ের।

আরো একটি বাস্তবতা হচ্ছে, জিডিপি অগ্রযাত্রা কোনভাবেই চাকরিবাজারের মন্দাবস্থা দূর করতে পারছেনা। যেখানে ২০১০ থেকে ২০১৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৪০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে ২০১৩ থেকে ২০১৬ অর্থবছর পর্যন্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ১৪ লক্ষ মাত্র। দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা (জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বিচারে) যেভাবে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ঠিক তার উল্টাহারে হ্রাস পাচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার।

২০১৬ থেকে অত্যাবধি (করোনাকালীন সময়ে) উপাত্তের তথ্য আশানুরূপ হবে না বৈকি?

অনেক অর্থনীতিবিদ বলেন, জিডিপির মধ্যে একটি দেশের মানুষের উন্নয়ন, সন্তুষ্টি বা সমৃদ্ধি পরিমাপের কিছু নেই। এসব বোঝার জন্য ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্ব দেন তাঁরা। তাঁদের মতে, জিডিপি দিয়ে একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাপা যায়, কিন্তু দেশের মানুষের ভালো-মন্দের কিছুই বুঝা যায় না। দেশের মানুষের উন্নয়ন বা সমৃদ্ধি পরিমাপের জন্য যুক্ত্ররাজ্য বা ভূটানের উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে।

২০১০ সালে দেশের মানুষ কতটা ভালো আছে তা জানার জন্য যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রথমবারের মতো জিডিপির বাইরে পাঁচটি সূচক ব্যবহার করার ঘোষণা দেন। এগুলো হলো ভালো চাকরি, সরকারি নীতির ভালো-মন্দ, পরিবেশ সুরক্ষা, স্বচ্ছতা ও সুস্বাস্থ্য।

তথাকথিত অনুন্নত দেশ হলেও ভুটান মাথাপিছু জাতীয় আয়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে, আইএমএফের বৈশ্বিক রিপোর্টে বাংলাদেশে যখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২০০ ডলার অতিক্রম করেছে, তখনই ভুটানে মাথাপিছু আয় তার দ্বিগুণেরও বেশি, আড়াই হাজার ডলার। তারপরও ভুটান জিডিপি–মাথাপিছু আয় নিয়ে সীমাহীন উচ্ছ্বাসে গা ভাসায়নি বরং জিডিপিকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশ্বকে দেওয়া তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী পদ্ধতি ‘মোট জাতীয় সুখ’ অর্থনীতির পরিমাণগত দিকের ওপর সব ছেড়ে না দিয়ে মানুষের জীবন ও পরিবেশ নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। এই হিসাব পদ্ধতিতে মোট নয়টি ক্ষেত্র বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়: মানসিক ভালো থাকা, সময়ের ব্যবহার, সম্প্রদায়, জীবনীশক্তি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, বাস্তুতান্ত্রিক স্থিতিস্থাপকতা, জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সুশাসন।

জিডিপি’র সীমাবদ্ধতার জন্য একটি উদাহরণ দিই। ধরা যাক দুটি দেশ এক বছরে ১০০০ টাকার পণ্য ও সেবা উত্পাদন করেছে। অর্থাৎ তাদের জিডিপি সমান। কিন্তু একটি দেশের সরকার ১০০০ টাকার মধ্যে ৭০০ টাকা লুট করেছে। আরেক দেশের সরকার ১০০০ টাকা জনগণের কল্যাণে সমহারে ব্যয় করেছে। এই দুই দেশের মধ্যে কোনটি ভালো, তা জিডিপি বলতে পারে না।

জিডিপি বৃদ্ধির স্তুতি না গেয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ, চাকরি বাজার সৃষ্টি, আইন শৃংখলার উন্নয়ন হওয়াটাই অতীব জরুরী বৈকি।

দিন শেষে ৫০ টাকা কেজি আলু কিনতে গিয়ে জিডিপি বন্দনা নাভিশ্বাস হয়েই ঠেকে।