-মু.রমজান আলি

“মা! তুমি আমার আগে যেওনাকো মরে
কেমন করে দেবো মাটি তোমার কবরে”

এই চমৎকার মায়ের গানটি প্রথম শুনেছিলাম স্কুল জীবনে প্রয়াত শিশুশিল্পী জনি দে রাজ এর কাছে । সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত তার যাদুময় কন্ঠ সবাইকে বিমোহিত করতো সহজেই। সবাই তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো,জনি একদিন বড়ো শিল্পী হয়ে এলাকার সুনাম কুঁড়াবে। গানে গানে আলোকিত করবে দেশ ও জাতিকে। নরপশুরা তাকে স্বপ্নের সমান বড় হতে দিলনা। চিরদিনের জন্য নিভিয়ে দিলো তার স্বপ্নবাতি।

গানের কথামতো জনি দে আজ তার মাকে ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই! কিন্তু ঈদগড়বাসির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সহজেই বন্ধ হবার নয়। জনি দে এর মর্মান্তিক এই হত্যাকান্ড কোনভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। ছোটবেলায় শুনতাম ডাকাতির কথা,এরপর একটু বড় হতে হতে দেখলাম অপহরণের ঘটনা, এখন জনি দে এর হত্যার মাধ্যমে শুরু হল হত্যাকান্ড। অর্থাৎ ছোটখাট ছিনতাই ঘটনা থেকে ষিয়টি মাথাছাড়া দিয়ে এখন হত্যাকান্ডে রূপ নিয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো এটি আরো ভয়ংকর কিছুতে রূপ নিবে। পরিস্থিতি এটাই বলে। একটি সম্ভাবনাময়ী প্রতিভা এরা শেষ করে দিল। এভাবে চলতে থাকলে আরো কতো প্রতিভা এরা শেষ করে দিবে একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।

Channel 24 এর একটি রিপোর্ট মারফতে জানতে পারলাম রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের সন্ত্রাসী গ্রুফ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসন হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে। বনের গহিনে অবস্থানরত সন্ত্রাসীদের বেশ কয়েকটি আস্থানা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে চিহ্নিত করেছে র্যাব। রোহিঙ্গাসহ স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র্যাব এমন অভিযান চালায়। জানা যায়,সন্ত্রাসীরা অপহরণ,খুন,ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত।

আমাদের জন্মভূমি ঈদগড় দীর্ঘদিন ধরে একটি ভয়ংকর এলাকা হিসেবে পরিচিত। কাউকে ঈদগড় বলে পরিচয় দিতেই অপহরণ,ডাকাতের কথা প্রথমেই উঠে আসে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়,এ পর্যন্ত ঈদগড়ে প্রায় একশজন লোক অপহরণের শিকার হয়,ডাকাতির কবলে পড়া সাধারণদের কথা বাদই দিলাম। সহজ সরল ঈদগড়ের লোকেরা নিরবে এসব নির্যাতন সহ্য করে আসছে অনেক দিন ধরে।অথচ সাধারণদের সরলতাকে পুঁজি করেই ক্ষমতাবানরা তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। ক্ষমতাধররা এসব অসঙ্গতি নির্মূলের আশ্বাস দিলেও কার্যত তাদের প্রতিক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ তারাতো কখনো এসবের কবলে পড়েননি অথবা তাদের ছেলে পিলেরা ও। সাধারণরা কষ্ট পেলে তাদের কি আসে যায়। একটি অপরাধ দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকা মানে এ অপরাধের পেছনে ক্ষমতাধর কেউ সম্পৃক্ত আছে। এমনটি ধারণা বিশিষ্টজনদের।

অপহৃতদের সাথে কথা বলে জানা যায়,তাদের বেশির ভাগকেই লোকালয় থেকে এক-দুই কিলোমিটার ভিতরে নিয়ে নির্যাতন চালায় অপহরণকারীরা। শুধুমাত্র ঘন্টা দেড়েক পরপর সাইড পাল্টায়। গত ৫ ডিসেম্বর ঈদগড় টুঠার বিল এলাকার নুরুল ইসলাম এবং হাসনাকাটা এলাকার আব্দুল খালেককে অপহরণ করে। নুরুল ইসলাম পরের দিন ডাকাতদলকে ফাঁকি দিয়ে অনেকটা আলৌকিকভাবে পালিয়ে আসে মাছুয়াখালি এরিয়ায়। তার ভাষ্য মতে,ডাকাতদলরা যেখানে অবস্থান করে সেখানে রেল লাইন প্রকল্পের জন্য মাটি সংগ্রহ করার কাজে নিয়োজিত Excavator এর আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। অপহরণকারীদের একজন ঐ এলাকা থেকেই তাদের জন্য ভাত নিয়ে যায়। এমনকি এরা পালিয়ে আসা নুরুল ইসলামকে খুঁজতে লোকালয়ে চলে আসে এবং রেল লাইনের শ্রমিকদের হুমকি দিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। একটু ভাবুনতো কি রকম দাপুটে হলে এমনটা সম্ভব এদের! পুলিশ এ ব্যাপারে জেনে ও কোন কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়নি। পরে ডাকাতদের কাছে থেকে যাওয়া আব্দুল খালেককে ২৫০০০ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে সন্ধ্যায় জোয়ারিয়ানালা এলাকা থেকে ছেড়ে দেয়। তার মানে ডাকাতদলরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছুয়া খালি থেকে জোয়ারিয়ানালার দুই তিন কিলোমিটারের ভিতরে ছিল।

তাহলে এখন প্রশ্ন হলো-আমরা কি এমন কোন Backdated যুগে বসবাস করছি যে,দুই তিন কিলোমিটার এলাকার আশ পাশে অবস্থানরত অপহরণকারীদের চিহ্নিত করা আমাদের প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা? অথবা বনটির এরিয়া কি এতই বিশাল যে, এদেরকে ধরতে কষ্ট হবে? অথবা অপহরণের ঘটনা কি এমন নতুন কিছু, যা বিবেচনাযোগ্য নয়?

রামু চা বাগান থেকে পূর্ব দিকে বাইশারী পর্যন্ত এবং দক্ষিণে ভোমরিয়া ঘোনা থেকে ঈদগড় পর্যন্ত এই বনজ এরিয়ার আয়তন ১৫ বর্গ কিলোমিটার বা তার চেয়ে একটু কম বেশি (আনুমানিক)। এই এরিয়ায় অপহরণের ঘটনা চলাকালীন হেলিকপ্টার অভিযান চালালে অথবা রিমোট কন্ট্রোল ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহার করে ২/১ ঘন্টার মধ্যে অপহরণকারীদের আস্থানা সহজেই চিহ্নিত হতে পারে।তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর এই যুগে প্রশাসন চাইলে আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে। জানা যায় ,জনিকে হত্যার পর হত্যাকারিরা পানেরছড়া ঢালা থেকে দক্ষিণ দিকে বনের ভিতর পালিয়ে যায়। প্রশাসন সাথে সাথে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে হয়তো অপরাধিদের পাওয়া যেত। যেহেতু এ অপরাধ দীর্ঘদিন ধরে চলমান,এর স্থায়ী সমাধান জরুরী। স্থায়ী সমাধান করতে এরকম কোন কার্যকরি পদক্ষেপের বিকল্প নাই। এটাই এখন সহজ সরল ঈদগড়বাসীর প্রাণের দাবী।

গত ২৩ নভেম্বর ২০১৯ ইং,মহেশখালীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে। এতে ক্ষমতাসীনরা প্রশংসা কুঁড়িয়ে আনে। তাহলে দীর্ঘদিন ধরে দাপুটে ঈদগড় এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার এ বনদস্যুদের কেন আত্নসমর্পণের আওতায় আনতে পারছেননা তারা! এটা ও প্রশ্নের দাবী রাখে।

রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার স্বার্থে যদি ক্যাম্পের আশপাশের এরিয়ায় হেলিকপ্টার অভিযান চালানো যায়,তাহলে ঈদগড়বাসী কি রোহিঙ্গাদের চেয়ে ও কম অধিকারপ্রাপ্য? নাকি ঈদগড় বাসী আলাদা একটি রাষ্ট্রের বাসিন্দা যে,এদের ব্যাপারে আমাদের দেশের প্রশাসনের মাথা ঘামানোর দরকার নেই!

 

মু.রমজান আলি
সম্মান ৪র্থ বর্ষ (অধ্যয়নরত)
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
(কক্সবাজার সরকারি কলেজ)