শাহিদ মোস্তফা শাহিদ, ঈদগড় থেকে ফিরে
আঞ্চলিক গানের শিল্পী জনি দে রাজের কি অপরাধ ছিল? কেনইবা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে? এ প্রশ্ন এখন সর্বমহলের।
তাকে পরিকল্পিত নাকি অন্য কোন কারণে খুন করেছে? তাও ধোঁয়াশা। এমন কোন তথ্য এখনো মেলেনি, যে তথ্যের সুত্র ধরে ঘটনার আসল রহস্য বের করা হবে!
যে কারণে হত্যার ঘটনার ৪ দিন পেরিয়ে গেলেও কোন আসামী আটক হয়নি।
তবে, মামলার সূত্র ধরে কাজ করছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম।
পুরো কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামেও অব্যাহত রয়েছে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ৷ ঘটনার ৪ পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোন কুল কিনারা বের করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা গুলো৷
তবে, প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে লোমহর্ষক একটি তথ্য। এ তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় যাত্রী, চালক, পথচারী, প্রত্যক্ষদর্শীসহ বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলেন প্রতিবেদক।
বিভিন্ন সূত্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও মূলত তাকে হত্যা করা হয়েছে তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে।
জনিকে বহনকারী সিনএনজির আগে আরো একটি সিএনজি ঈদগড়ে যাচ্ছিল। সেই গাড়ীর এক যাত্রী প্রকাশ করেন অজানা কিছু তথ্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তিকে তিনি ঘটনাটি অবগত করেন। তাদের একজনের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
তারা সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন।
বর্ণনা অনুুযায়ী পাওয়া তথ্য:
ঘটনার দিন সকাল ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে ঈদগাঁও বাসস্টেশন থেকে ৫ জন যাত্রী নিয়ে ঈদগড়ের উদ্দেশ্য ছেড়ে যান দিনের প্রথম সিএনজি গাড়ীটি। এ সিএনজিটি যাওয়ার পথে ঘটনাস্থলে পৌঁছলে একজন ব্যক্তি গাড়ীটিকে সংকেত দেন। সেই সিএনজি চালক ডাকাত সন্দেহ করে ঐ ব্যক্তিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। যদিও বা সিএনজি চালক ও মালিক সমিতি বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। কারণ ৮ টার আগে ঈদগড় সড়কে সিএনজি ছেড়ে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইনী ঝামেলা এড়াতে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। পরপরই আরো একটি সিএনজি ঈদগড়ে যাচ্ছিল, সেই গাড়ীর চালক ছিল ইসলামাবাদ ইউনিয়নের খোদাই বাড়ী এলাকার আবুল কালাম। এই গাড়ীটি যাওয়ার পথে সড়কের হিমছড়ি ঢালায় এক ব্যক্তি মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকছিল। ২য় গাড়ীর চালক পুরাতন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সেও ডাকাত দলের সদস্যকে পিষে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে গাড়ীটি পার্শ্ববর্তী বালির স্তূপে উল্টে যায়। ৫/৬ মিনিট পর্যন্ত গাড়ীর নিচে আটকা পড়ছিল যাত্রীরা। বালি উত্তোলনের এক শ্রমিকের সহযোগিতায় কোন রকম উঠে তারাও নিরাপদে চলে যায়। এ সময় ডাকাত দলের অপরাপর ৫/৬ জন সদস্য পাহাড় থেকে নেমে এসে তাদের সহযোগীকে উদ্ধার করে পাহাড়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। সে সময়ে যাচ্ছিল শিল্পী জনি দে রাজ ও মোহাম্মদ কালুকে বহনকারী সিনএনজিটি। তাদের সিএনজিকেও সংকেত দেয় ডাকাত দল। তারা ইশারা দিয়ে ঐদিকে না যাওয়ার জন্য বারণ করলেও জোরে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চালক। সংকেত অমান্য করায় এক রাউন্ড গুলিও করে ডাকাত দলের সদস্যরা। সংকেত ও গুলি বর্ষন অমান্য করে তাদের সহকর্মীকে উদ্ধার তৎপরতা করার সময় নিহত কন্ঠ শিল্পী জনি দে উঁকি দিয়ে তাদের কর্মকান্ড এক নজর দেখে নেন।
এ সময় উত্তেজিত ডাকাত দলের সদস্যরা সিএনজি চালককে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করে উপর্যুপুরি চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কোপাতে থাকে। লক্ষভ্রষ্ট হয়ে কোপ লেগে ঘটনাস্থলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জনি দে রাজ ও মোহাম্মদ কালু। সে সময় তিন নারী যাত্রীকে নিয়ে চালক দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে গজালিয়া জামে মসজিদের পাশে কবরস্থানে অবস্থান করেন।
নারী যাত্রীদের ধারণা জনি দে রাজ উঁকি দেওয়ায় তাকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে আহত করে। তাকে উদ্ধার করতে নেমে যান বৃদ্ধ মোহাম্মদ কালু।
মোহাম্মদ কালু ডাকাত দলের সদস্যদের কি যেন একটা কথা বলছিল, তাই তাকেও কোপানো হয়। তাদের ধারণা ডাকাত দলের এক সদস্যকে সিএনজির ধাক্কা ও পিষ্ট করে মেরে ফেলায় তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জনি ও কালুকে কুপিয়ে বদলা নিয়েছে। তা না হলে জনি দে রাজের হাতে দামী দুইটি মোবাইল সেট, স্বর্ণের চেইনসহ আরো দামী জিনিসপত্র ছিল। সেগুলো কিছুই নিয়ে যায়নি ডাকাত দল।সে সময় ডাকাত দলের সদস্যদের উত্তেজিত অবস্থায় দেখা গেছে।
জনি ও কালুকে কুপিয়ে ডাকাত দলের পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া সদস্যকে টানাহেঁচড়া করে পাহাড়ে দিকে নিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজনের দাবী, ঘটনাস্থলের আশপাশে জঙ্গলে দিকে ১/২ কিলোমিটার পথ বা স্থানে অভিযান চালালে ডাকাত দলের কোন না কোন আলামত সংগ্রহ করতে পারত।
ঈদগড়ের বাসিন্দা আবুল কাসেম জানান, যদি ঘটনা এমনই হয় তাহলে ডাকাত দলের সদস্য যে মারা গেছে তার লাশ পাহাড়ের ভিতর লুকিয়ে রাখতে পারে। সন্ধান চালালে তাদের কোন বস্তু আলামত হিসেবে উদ্ধার হতে পারে। তবে এ পর্যন্ত পুলিশ ঘটনাস্থল ছাড়া আশেপাশে প্রবেশ করেনি। মামলার সূত্র ধরে পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জড়িতদের ধরতে কাজ চালাচ্ছে। ঘটনার পরদিন থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম কাজ করছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় লোকজন দাবী করেন, তিন সিএনজি চালককে আটক করলে মুল রহস্য বের হবে।তারা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অতিলোভে ৮ টার আগে গাড়ী যাত্রী আসা নেয়া করে। সেদিন ৭টা ৩৫/৪০ মিনিটে গাড়ী না ছাড়লে হয়তো এত বড় একটি ঘটনার জন্ম নিত না।
ঈদগড় একতা হিন্দু সমাজের সভাপতি অধির কান্তি দে বলেন, তারাও বিভিন্ন জন থেকে এমন খবরটি পেয়েছেন। তবে ঘটনায় কারা কারা জড়িত চিহ্নিত করতে পারেনি। জনি দে রাজ খুনের ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক সবাইকে আটক করে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
জনির পিতা তপন দে বলেন, আজকে ছেলের ৪ দিনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, ব্যস্ততার কারণে তেমন একটা কথা বলতে না পারলেও ছেলে হত্যার বিচার চান সরকারের কাছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঈদগাঁও তদন্ত কেন্দ্রের এসআই শামীম আল মামুন জানান, ইতোপূর্বে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তিনি আশা প্রকাশ করেন খুব শ্রীঘ্রই জনি দে রাজের খুনের ঘটনায় জড়িতদের আটক করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, গত ৮ অক্টোবর ভোরে পটিয়া উপজেলার হাসমত মঞ্জিল আমীর ভান্ডার দরবার শরীফ থেকে অনুষ্ঠান করে শ্যামলী পরিবহণের বাসে করে ঈদগাঁও বাসস্টেশনে নেমে পিতা পুত্র বার আউলিয়া হোটেল থেকে নাস্তা করে ছেলে আগে বাড়ীর উদ্দেশ্য সিএনজি করে রওনা দেয়। প্রতিমধ্যে নৃশংস ভাবে খুনের শিকার হন।