কালেরকন্ঠ : কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং সন্ত্রাস কবলিত মেগা রোহিঙ্গা শিবিরের সাধারণ রোহিঙ্গারা এক মুহূর্তও আর সেখানে অবস্থান করতে রাজি নয়। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের অব্যাহত সংঘর্ষ, গোলাগুলি, আগুনে ঘর পোড়ানোসহ লাগাতার অরাজক পরিস্থিতিতে আর থাকতে চায় না রোহিঙ্গারা। পরস্পর বিরোধী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের হানাহানিতে গত এক সপ্তাহে এক বাংলাদেশিসহ ৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। এসব কারণে যত দ্রুত সম্ভব তারা দেশে ফিরতে চায়। নতুবা শান্তির অন্বেষণে যেতে চায় নোয়াখালীর ভাসানচরে।

মিয়ানমার সেনাদের অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে দেশত্যাগী মানুষগুলোকে বাংলাদেশ সরকার এবং এদেশের জনগণ মানবিক কারণে ঠাঁই দিয়েছিল। আশ্রয় পেয়ে সেই রোহিঙ্গাদেরই একটি অংশ কিনা ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এই রোহিঙ্গারা হয়ে পড়ে বেপরোয়া। তারা এদেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে এদেশের আইন অমান্য করে চলছে প্রতিনিয়ত। এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রতি যেমনি হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠে তেমনি স্থানীয়রাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের ভয়ে তটস্থ সাধারণ রোহিঙ্গারাই এখন প্রকাশ্যে বলছে তারা নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরতে চায়। দেশে ফিরতে যদি বিলম্ব হয় তাহলে তাদের এক্ষুনি নোয়াখালীর ভাসানচরে নিয়ে যেতেও দাবি জানিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ হাফেজ (৩৫) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আঁরা বর্মার মিলিটারির অত্যাচার খাইয়্যেরে ধাই আস্যি। এবার আঁরার কউমর পার্টির অত্যাচারুত্তু বাঁইচত চাই।’ অর্থাৎ আমরা মিয়ানমারের সেনাদের অত্যাচারে পালিয়ে এসেছি। এবার আমাদের স্বজাতির সন্ত্রাসীদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে চাই। আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থার বিরোধিতা সত্বেও সাধারণ রোহিঙ্গারা এসব কারণে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে ভাসানচরে।

কুতুপালং শিবিরের লম্বাশিয়া এলাকার বাসিন্দা রোহিঙ্গা রহমতুল্লাহ (৪০) দুঃখের সঙ্গে বলেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি শ্রেণী কি কারণে অস্ত্র হাতে নেয় সেটা তাদের বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে খুন-খারাবি, অপহরণ, মাদক ব্যবসায় তারা কেন লিপ্ত হবে? সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে প্রতি মাসে চাঁদা না দিলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর কেন নেমে আসবে নির্যাতন? কেনইবা এক রোহিঙ্গা আরেক রোহিঙ্গার ঘর-দুয়ারে আগুন দেবে?

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়াসহ ঔষধ পথ্যেরও কোনো অভাব নেই। দেদারছে মিলছে কাজকর্মও। অভাব নেই টাকা-পয়সারও। এমন সুখ-শান্তির মধ্যে এরকম অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি কেন করা হচ্ছে-এমন প্রশ্ন সাধারণ রোহিঙ্গাদের।

কুতুপালং নিবন্ধিত শিবিরের ই ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করিম বাহিনী নামের সন্ত্রাসী রোহিঙ্গার দলটি আমার ১২ বছরের কিশোর সন্তান রবিউলকে অপহরণ করে নিয়েছিল। টানা ৬ দিন পর আজ রবিবার আমার বুকের ধন রবিউলকে পুলিশ উদ্ধার করেছে।’

রোহিঙ্গা আমিন জানান, দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী করিমের দলে এক হাজার ২০০ জন সন্ত্রাসী রয়েছে। করিম বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনে এখানকার সাধারণ রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। করিম বাহিনীর সন্ত্রাসীরা অপহরণ, খুন-খারাবি, চাঁদাবাজিসহ মুক্তিপণ বাণিজ্যেও জড়িত। গতকাল রবিবার সকালেও ব্লক এলাকা থেকে বাহিনীর সন্ত্রাসীরা এক রোহিঙ্গা নারীকে অপহরণ করে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

কুতুপালং মেগা শিবিরের অগণিত সংখ্যক সাধারণ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা গ্রুপের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে বেশ কিছুকাল ধরে। নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বলেন, ‘আমরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছি। বাংলাদেশের মানবিক সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। এখন অমানবিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচতে আবার পালাতে হচ্ছে।’ তারা বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে ভাসানচরসহ অন্য যেকোনো স্থানে যেতে তারা রাজি। অশান্ত কুতুপালং শিবিরে তারা আর থাকতে রাজি নয়।’

কক্সবাজারে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা জানান, রোহিঙ্গারা এমনতিইে ভাসান চরে যেতে প্রস্তুত। তবে কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ তাদেরকে বাধা দিয়ে আসছে। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের বাধার কারণেই এতদিন সাধারণ রোহিঙ্গারা মুখ খুলছিল না।

এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সব পুলিশ সদস্যদের নির্দেশনা প্রদান করেছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন। ডিআইজি জানান, রোহিঙ্গা শিবিরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য গত শুক্রবার থেকে র‌্যাব-পুলিশ, আর্মড ব্যাটালিয়ান ও আনসার বাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত অস্ত্রসহ অন্তত ৩০ জন সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রাখার কথাও বলেন ডিআইজি।