আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
করোনায় আক্রান্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে এখন বিশ্ব মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। যেখানে আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা সেখানে ট্রাম্পের ‘করোনা’ যেন অনেকটাই নাটকীয়। এ নিয়ে রীতিমতো ধুম্রজালের আবির্ভাব হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এরইমধ্যে এক ভিডিও বার্তায় ট্রাম্প বলেছেন তিনি ‘অনেকটা ভালো বোধ’ করছেন। অপরদিকে তার চিকিৎসকরা বলছেন ট্রাম্প এখনও কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার পর্যায়ে আসেননি এবং গত ২৪ ঘণ্টায় দেখা দেয়া তার বেশ কিছু উপসর্গ ‘খুব উদ্বেগজনক’।

করোনার শুরু থেকেই আলোচনায় আছেন ট্রাম্প। তাকে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। কোভিড-১৯ মহামারিতে যেখানে বিশেষজ্ঞরা বার বার করে মাস্ক ব্যবহারের কথা বলে আসছিলো সেখানে কখনোই মাস্ক পড়াকে সমর্থন করেননি ট্রাম্প। এমনকি মাস্ক পরায় নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকে নিয়েও ব্যাঙ্গ করেছেন তিনি। এ পরিস্থিতিতে ২ অক্টোবর ট্রাম্প নিজেই টুইট করে তার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর জানান। শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল দশটা ৫৪ মিনিটে টুইটে ট্রাম্প নিজেই এ তথ্য জানিয়েছেন। তার টুইটবার্তার এরই মধ্যে রিটুইট করেছেন ৪ লক্ষ ৪ শ লোক। শেয়ার করেছেন অন্তত ৫ লক্ষ লোক। লাইক পড়েছে ১৮ লক্ষেরও বেশি।

৩ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় সকাল ৪টা ৩১ মিনিটে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন ট্রাম্প। যেখানে তিনি জানান, তিনি ওলটার রিড হাসপাতালের ‘প্রেসিডেন্টশিয়াল স্যুটে’ আছেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে আমি খুব ভালো আছি। তবে আসলেই সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে কিছু পরীক্ষা করতে হবে। ফার্স্ট লেডিও খুব ভালো আছেন। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।’ ট্রাম্পে এ পোস্টে এখনো পর্যন্ত এক লাখ ২৯ হাজার রিটুইট হয়েছে। যেখানে অনেকে ট্রাম্পের জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন।

একই দিনের পাঁচঘণ্টা ব্যবধানে ট্রাম্প টুইট করেন, ‘আমার মনে হয় পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছে, আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।’ এতে রিটুইট হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার।

গতকাল শনিবার বেলা ১১টা ১৯ মিনিটে ট্রাম্প টুইট করে জানান, চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্যরা খুবই আন্তরিক। তিনি স্বস্তি বোধ করছেন। তার এ টুইটে রিটুইট করেছেন প্রায় ৯০ হাজার মানুষ।

সর্বশেষ ৭ ঘণ্টা আগে ৪টা ৫১ মিনিটে টুইট করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি জানান, তার কোভিড-১৯ চিকিৎসার ‘আসল পরীক্ষা’ হবে আগামী কয়েক দিনে।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পের শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার হোয়াইট হাউস থেকে পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন বার্তা আসার পর তিনি নিজেই ভিডিও বার্তায় নিজের অবস্থার কথা জানালেন।

টুইটারে প্রকাশ করা চার মিনিটের ওই ভিডিওতে ট্রাম্পকে নীল রঙের একটি জ্যাকেট ও একটি সাদা শার্ট পরা অবস্থায় দেখা যায়। এ সময় তাকে কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।

ভিডিওতে ট্রাম্প বলেন, যখন শুক্রবার প্রথম ওয়ালটার রিড ন্যাশনাল মিলিটারি মেডিকেল সেন্টারে আসেন, তখন ‘তেমন ভালো বোধ করছিলেন না’, তবে এখন ‘অনেকটা ভালো বোধ’ করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা পেছনে রেখে গোল একটি টেবিল সামনে নিয়ে বসা ট্রাম্প বলেন, আগামী কয়েক দিনে, সত্যিকার পরীক্ষাটি হবে বলে আমার ধারণা, তাই আগামী কয়েক দিনে কী ঘটে তা দেখব আমরা। এ টুইটে এরই মধ্যে রিটুইট করে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ১ লক্ষ ১৪ হাজার লোক।

বৃহস্পতিবার রাতে ট্রাম্পের নমুনা পরীক্ষায় কোভিড-১৯ পজিটিভ আসার পর থেকেই তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে নাগরিকদের মধ্যে। কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্টের শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন রকম তথ্য প্রকাশ করায় তিনি ঠিক কতোটা অসুস্থ তা নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হচ্ছিল। পরে ট্রাম্প নিজেই ভিডিও বার্তায় নিজের শারীরিক অবস্থার কথা জানান।

শনিবার সকালে হোয়াইট হাউসের একদল চিকিৎসক জানান, ট্রাম্পের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে আর তিনি ইতিমধ্যে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসা নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন।

একজন চিকিৎসক জানান ট্রাম্প তাদের বলেছেন, ‘আমার মনে হচ্ছে আজই আমি এখান থেকে হেঁটে বের হয়ে যেতে পারবো।’

এর কয়েক মিনিটের মধ্যে হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ মার্ক মেডৌস সাংবাদিকদের ভিন্ন কথা বলেন। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় প্রেসিডেন্টের শারীরিক অবস্থা খুব উদ্বেগজনক ছিল এবং তার চিকিৎসার দিক থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা সঙ্কটজনক হতে পারে। আমরা এখনও পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার সুস্পষ্ট পথে নেই।

মেডৌস প্রাথমিক মন্তব্যগুলো তাকে যেন শনাক্ত করা না যায় সেই শর্ত দিয়ে করেছিলেন, কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার বলার ভঙ্গি পাল্টে যায়, রয়টার্সকে তিনি বলেন ট্রাম্প ‘খুব ভালো’ করছেন এবং ‘চিকিৎসকরা তার উন্নতিতে অত্যন্ত সন্তুষ্ট।’

কিন্তু নিজের মন্তব্যের এই পরস্পরবিরোধিতার কোনো ব্যাখ্যা দেননি তিনি। ট্রাম্পের একজন উপদেষ্টা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মেডৌসের প্রথম মন্তব্য জানার পর প্রেসিডেন্ট খুশি হতে পারেননি।

রয়টার্স জানিয়েছে, প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্টের ওয়ালটার রিডে যাওয়ার বিষয়টিকে ‘পূর্বসতর্কতামূলক’ বলে বর্ণনা করেছেন আর হাসপাতালে ট্রাম্পকে কয়েকদিন থাকতে হতে পারে বলে জানিয়েছেন।

ট্রাম্পের শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত আরেকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হাসপাতালে যাওয়ার আগে প্রেসিডেন্টকে অক্সিজেন দেয়া হয়েছিল।

ওই সময়ের পরিস্থিতি সর্ম্পকে অবগত আরেকজন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের শ্বাসকষ্ট হওয়ার পর ও তার অক্সিজেনের মাত্র কমে যাওয়ার পর তাকে হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

তবে শনিবার হাসপাতালের সামনে হোয়াইট হাউসের চিকিৎসক শন পি. কনলি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ট্রাম্পের শ্বাসকষ্ট নেই এবং ওয়ালটার রিডে তাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে না। কবে ট্রাম্প হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে পারেন তার সম্ভাব্য সময় নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

ট্রাম্পের করোনায় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও রাজনীতিতে যে প্রভাব পড়বে

আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় স্বভাবতই ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণা কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর প্রভাব পড়তে পারে দেশটির সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও।

আক্রান্ত হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগেই আমেরিকানদের করোনা নিয়ে বেশি চিন্তা না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তার ভাষায়, ‘করোনাভাইরাসে আসলে প্রায় কারোই কিছু হয় না, কেবল বয়স্ক এবং হৃদরোগীদের ছাড়া।’ এমন মন্তব্যের এক সপ্তাহের মধ্যেই ট্রাম্পের শরীরে করোনা শনাক্ত হয় এবং তিনি নিজেও বয়স্ক। শুধু তিনি নন, ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পেরও কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফল পজিটিভ।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র ৩২ দিন আগে এটা যে কী মারাত্মক এক ঘটনা, তার গুরুত্ব বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। ট্রাম্পকে এখন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। চিকিৎসা নিতে হবে। তার নির্বাচনি সমাবেশে যাওয়ার কোনও সুযোগই আর নেই। দুই সপ্তাহের মধ্যে দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর যে দ্বিতীয় টেলিভিশন বিতর্ক হওয়ার কথা, সেটি আদৌ হবে কি না, তা-ও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

ট্রাম্প যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেক্ষেত্রে তার নির্বাচনি প্রচারণার কী হবে? তার অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনার কী প্রভাব পড়বে নির্বাচনে? যদি তিনি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন কী ঘটবে? যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স-এরও করোনা শনাক্ত হয়, তখন কী হবে? নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে এসব ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কি একটি সাংবিধানিক সংকটের মুখে?

একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার মাঝখানে, যখন ভোটের বাকি আর মাত্র ৩২ দিন, তখন এই খবরটা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বকেই চমকে দিয়েছে। বিশ্বনেতারা এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সুস্থতা কামনা করে বার্তা পাঠিয়েছেন।

এই খবরের সঙ্গে সঙ্গেই দুনিয়াজুড়ে শেয়ারবাজারে বড় প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কারণ এটি শুধু বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের ব্যাপারেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

জাপানের নিকেই শেয়ার সূচক শূন্য দশমিক সাত শতাংশ পড়ে গেছে। ইউরোপে লন্ডন, ফ্রাংকফুর্ট এবং প্যারিসের শেয়ারবাজারের সব প্রধান সূচকে দর পড়তে শুরু করে লেনদেন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের ডাউ জোনস, নাসডাক এবং এসএনপি, তিনটি সূচকেই একই প্রবণতার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে স্বাভাবিক চলাফেরা করেছেন, বড় ধরনের নির্বাচনি সমাবেশ করেছেন, সেটি নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগ ছিল।

বিবিসির উত্তর আমেরিকা সংবাদদাতা জন সোপেল বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, এটি একই সঙ্গে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা, আবার অবাক হওয়ার মতো কোনও ব্যাপার নয়। এটি এ কারণেই অত্যাশ্চর্য এক খবর, প্রেসিডেন্টকে ঘিরে নেওয়া সব ব্যবস্থার পরও তিনি আক্রান্ত হলেন। কেননা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ঘিরে যে অস্বাভাবিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয় পুরো দুনিয়ায় তা অতুলনীয়। যারা তাকে ঘিরে রাখেন, তাদের নিয়মিত করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়।

জন সোপেল বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাতে আবার অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কারণ করোনাভাইরাস মোকাবিলার নিয়মকানুনের ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের কর্মীদের মধ্যে, বিশেষ করে ওয়েস্ট উইংয়ে তিনি বেশ অনীহা দেখেছেন। সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন ছাড়া হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইং এ খুব কম লোকজনই মাস্ক পরেন।

নির্বাচনি প্রচারণার কী হবে?

ট্রাম্পের করোনা শনাক্তের খবরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা যে নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেল, এটা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। এই ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তার নির্বাচনি সমাবেশগুলো বন্ধ রাখতে হবে। তিনি আর আগের মতো সবকিছু করতে পারবেন না। তার উপদেষ্টারাও বিষয়টি স্বীকার করছেন। শুক্রবার রাতেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের থাকার কথা অরল্যান্ডোর এক নির্বাচনি সভায়। এই সপ্তাহান্তে যাওয়ার কথা উইসকনসিন। এসব সমাবেশে এখন আর ট্রাম্পের সশরীরের উপস্থিত হওয়ার সুযোগ নেই।

দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেনের মধ্যে দ্বিতীয় টেলিভিশন বিতর্ক হওয়ার কথা। প্রথম বিতর্কটি যে রকম বিশৃঙ্খল ছিল, তা নিয়ে সমালোচনার পর বিতর্কের নিয়মকানুনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কিন্তু ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থা কোন দিকে যায়, তার ওপর এখন এই বিতর্কের ভাগ্য নির্ভর করছে।

ট্রাম্পের একজন উপদেষ্টা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এমন হতে পারে যে, কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রেসিডেন্ট সামনাসামনি বিতর্কের পরিবর্তে ভার্চুয়াল বিতর্কে অংশ নিতে পারেন।

ট্রাম্প আক্রান্ত হওয়ার রাজনৈতিক সুবিধা কে পাবে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থার ওপর। যদি তিনি ‘এসিম্পটোমেটিক’ হন, অর্থাৎ করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে যেসব গুরুতর লক্ষণ দেখা যায়, সেগুলো যদি তার না থাকে, তাহলে হয়তো ট্রাম্প আবারও বলার চেষ্টা করবেন যে, করোনাভাইরাস তেমন গুরুতর কিছু নয়। আবার যদি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেটা থেকেও তিনি রাজনৈতিক ফায়দা পেতে পারেন। তার জন্য সহানুভূতির ঢেউ উঠতে পারে, যেমনটা ঘটেছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই অসুস্থতা থেকে কোনও রাজনৈতিক ফায়দা তোলার ক্ষেত্রে তার বিরোধী শিবিরের লোকজনকেও বেশ সতর্ক থাকতে হবে। করোনাভাইরাসের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগাগোড়াই সেগুলো উপেক্ষা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন, এমন অভিযোগও আছে।

এই মহামারির মধ্যেই তিনি বড় বড় নির্বাচনি সমাবেশ করেছেন। হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে নিয়মিত নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এখন ট্রাম্পের বিরোধী শিবিরের লোকজন যদি বলার চেষ্টা করেন যে, প্রেসিডেন্ট তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করছেন, সেটাকে রিপাবলিকানরা কাজে লাগাতে পারে বিরোধীপক্ষের ‘হৃদয়হীনতা এবং সুবিধাবাদিতার‌’ উদাহারণ হিসেবে।

এই ঘটনা করোনাভাইরাসকে আবার বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। এটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্ষতি করতে পারে কিংবা এর উল্টোটাও হতে পারে। তার সমর্থকরা প্রেসিডেন্টের পক্ষে আরও বেশি করে জোট বাধতে পারে।

মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এরিক হ্যাম বিবিসিকে বলেন, ‌‘এর দুটিই ঘটতে পারে। বেশিরভাগ মানুষই হয়তো চাইবেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ফার্স্ট লেডি এবং আক্রান্ত সবাই সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু আবার এটাও মনে রাখতে হবে, এই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস সম্পর্কে ভুল তথ্যের সবচেয়ে বড় উৎস ছিলেন।’ নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনেও একই রকমের কথা বলা হয়েছে।

ট্রাম্প শরীরে ব্লিচ ইনজেক্ট করা থেকে শুরু করে কত রকম মন্তব্য করেছেন এই করোনা নিয়ে। সেই বেপরোয়া প্রেসিডেন্ট এখন নিজেই এ ভাইরাসে আক্রান্ত। কাজেই এটি তার বিপক্ষেও যেতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত যদি তিনি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন কী ঘটবে?

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের যে চিকিৎসক, তিনি বেশ আশাবাদী। তিনি মনে করেন, প্রেসিডেন্ট কোনও বিঘ্ন ছাড়াই তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই অবস্থা দ্রুত পাল্টে যেতে পারে। লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করে। অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বয়স ৭৪ বছর। হোয়াইট হাউসের চিকিৎসকের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি শারীরিকভাবে স্থূলকায়, অর্থাৎ উচ্চতা অনুযায়ী তার যা ওজন থাকা উচিৎ, তার চেয়ে বেশি। ট্রাম্প সেই দলে পড়েন, যাদের জন্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। যদি তিনি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়েন তখন কী করতে হবে, তা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে মার্কিন সংবিধানে।

বিবিসি-র উত্তর আমেরিকা সংবাদদাতা জন সোপেল বলেন, মার্কিন সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীতে বলা আছে অসুস্থতার কারণে প্রেসিডেন্ট অক্ষম হয়ে পড়লে দায়িত্ব নেবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। সুতরাং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কিছু হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকেই তার জায়গা নিতে হবে। সেজন্য তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে হয়তো তাকে অল্প কিছুদিনের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে হতে পারে।

২৫তম সংশোধনীর এই ধারায় উল্লেখ আছে, প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে সাময়িকভাবে তার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেন ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে। যখন আবার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন, তখন আবার এই ক্ষমতা ফিরিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সও দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন, তখন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য এর পরেই আছেন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। এদিকে ন্যান্সি পেলোসি-ও এরইমধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আইসোলেশনে গেছেন বলে জানা গেছে।

ন্যান্সি পেলোসি হচ্ছেন বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির। কাজেই তার কাছে ক্ষমতা যাওয়ার মানে হচ্ছে রিপাবলিকানদের কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ডেমোক্র্যাটদের হাতে চলে যাওয়া। ওয়াশিংটন পোস্ট এ রকম একটি পরিস্থিতির কথা কল্পনা করে এ বছরের শুরুতে লিখেছিল, ‌‘‌‌ট্রাম্প ও পেন্সের কাছ থেকে পেলোসি-র কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে কোনও চেষ্টার বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবেই অনেক আইনি ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ আসবে। যুক্তরাষ্ট্রে যখন একটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দরকার খুব বেশি, তখন এই ঘটনা সেখানে আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।’ কাজেই এ রকম পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে এসব ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে একটি সাংবিধানিক সংকটের আশঙ্কা শংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

-বাংলাদেশ জার্নাল