হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ :

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের যাতায়ত ও রাতযাপন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সেখানে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এদিকে সরকারী উক্ত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২ অক্টোবর সেন্টমার্টিনে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্টিত হয়েছে। আন্তমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মতে আগামী মৌসুমে সেন্টমার্টিনদ্বীপে প্রতিদিন ১ হাজার ২৫০ জনের বেশি পর্যটক যেতে পারবেননা। সাধারণতঃ প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সেন্টমার্টিনে পর্যটক যেতে পারেন। স্থানীয় হিসাবে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ভর মৌসুমে প্রতিদিন ৫ থেকে ৮ হাজার দেশী-বিদেশী পর্যটক সেন্টমার্টিন দ্বীপে যান। তাঁদের একটি অংশ সেখানে রাতযাপন করেন।

জানা যায়, সেন্টমার্টিনদ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগটি আসে গত মার্চে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায়। সভায় এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর ও পর্যটন কর্পোরেশনকে। সেন্টমার্টিন নিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবাল শূন্য হতে পারে। দ্বীপটিতে প্রবাল ছাড়াও বিশ্ব জুড়ে বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিম, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন প্রজাতির পাখিসহ নানা ধরনের বন্য প্রাণীর বাস।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে হাইকোর্ট সেন্টমার্টিনকে রক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও বিভিন্ন সময় সেন্টমার্টিনে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করা, হোটেল সরিয়ে নেওয়ার মতো নানা উদ্যোগের কথা শুনিয়েছে। কিন্তু কার্যকর হয়নি। এদিকে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে কক্সবাজার দিয়েও সেন্টমার্টিন যাওয়ার জাহাজ চালু হয়েছে।

সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বিপুলসংখ্যক পর্যটকের যাতায়াতকে দ্বীপটির অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সেন্টমার্টিনে পাঁচ বছরের জন্য পর্যটন নিষিদ্ধের সুপারিশও করা হয়েছিল। তবে ওই চিন্ত থেকে আপাতত সরে এসেছে সরকার।

সেন্টমার্টিন ইকো ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশি বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে পর্যটক ছাড়াও প্রায় ১০ হাজার মানুষ বাস করে। সেখানে পুরোপুরি পর্যটন নিষিদ্ধ করা হলে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটে পড়বে। তাছাড়া সেন্টমার্টিনদ্বীপের বাসিন্দাগণ সরকারী এ সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনা করতে দাবি জানিয়ে আসছে। পাশাপাশি পরিবেশবাদী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা ও ব্যক্তিরা সেন্টমার্টিনদ্বীপটি রক্ষায় সরকারের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে দ্বীপের জীববৈচিত্র সংরক্ষণে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তার সমালোচনা করেছেন তাঁরা। তাঁরা মনে করছেন দ্বীপটিতে কী পরিমাণ পর্যটক যাওয়া পরিবেশের জন্য সহনীয়, তা আগে সমীক্ষা করে বের করা উচিত।

পরিবেশ অধিদপ্তর এরই মধ্যে সেন্টমার্টিনে বেড়াতে যেতে আগ্রহীদের নিবন্ধনের জন্য একটি অ্যাপ তৈরির কাজ শুরু করেছে। নিবন্ধন ছাড়া কোনো পর্যটক যাতে সেন্টমার্টিনে যেতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতেই এ উদ্যোগ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একেএম রফিক আহমেদ বলেন, ‘পর্যটন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হলে সেখানকার পরিবেশ সুরক্ষায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ আমরা নিতে পারব’।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কালক্ষেপণ না করে সেখানকার সব অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নেওয়া উচিত’।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘সরকারের উচিত পুরো দ্বীপকে অধিগ্রহণ করে সেটিকে জীববৈচিত্রের জন্য সংরক্ষণ করা। কয়েক বছর সেন্টমার্টিনে পর্যটন বন্ধ রাখা দরকার। এতে হারানো জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। তারপর সীমিত পর্যটনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে’।

এদিকে সেন্টমার্টিনদ্বীপ নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পথ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্টিত হয়েছে। ২ অক্টোবর বিকালে সেন্টমার্টিন বিএন ইসলামিক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গনে সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে এ প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন এবং উপস্থিত ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মাওলানা ফিরোজ আহমদ খান, সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাওলানা আব্দুর রহমান, ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবক এমএ রহিম জেহাদী, সেন্টমার্টিন সার্ভিস বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব সৈয়দ আলম, ইউপি সদস্য আলহাজ্ব হাবিবুর রহমান খান, সেন্টমার্টিন ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের শিক্ষা পরিচালক এমএ তাহের শাহীন, সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাহিদ হোসেন, সেন্টমার্টিন বিএন ইসলামিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ আয়াজ উদ্দিন, সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল হক মেম্বার, মাওলানা মোঃ সেলিম প্রমুখ।

বক্তাগণ বলেন, ‘দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর যুগ যুগ ধরে ষড়যন্ত্র করে আসছে। সেন্টমার্টিনদ্বীপে প্রায় ১০ হাজার লোক বাস করে। যাদের আয়ের নির্ভশীল পর্যটন ব্যবসা। তারা ৬ মাস ব্যবস্যা করে আর ৬ মাস বেকার কাটাতে হয়। এ ৬ মাসের ইনকামে ১২ মাস চলতে হয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এমন গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দ্বীপের ১০ হাজার লোক না খেয়ে মরবে। আমরা আশা করি সেন্টমার্টিনদ্বীপের খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা করে মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনা করবে’। প্রতিবাদ সভা শেষে সরকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবী জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এতে দ্বীপের সর্বসাধারণ অংশগ্রহণ করে। ##