মহেশখালী-কক্সবাজার ফেরিঘাটের দুঃখের কথা

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০৬:৪১

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


ছবির বর্ণনা: গত ৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে মহেশখালী যাবার জন্য ৬ নং ঘাটে পৌঁছে দেখি শতাধিক লোক মহেশখালী যাবার জন্য ঘাটে উপস্থিত এবং বোট না পেয়ে হা-হুতাশ করছেন। খাল ভর্তি জোয়ারের পানি কিন্তু বোট নেই। ডিঙ্গি নৌকায় তো এ বিশাল জনপদের যাত্রী পার করে কুল পাবে না। তবুও ঘাটওয়ালা যাত্রীদের বসিয়ে রেখে তাদের স্পিডবোটে পার করাবে! আমি ও তাদের সাথে হা-হুতাশে যোগ দিলাম এবং দাঁড়িয়ে যাত্রীদের দুর্দশা দেখলাম। একটা বোট আসে যাত্রীরা ঠেলাঠেলি দিয়ে বোটে উঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ঠেলাঠেলিতে কেউ কেউ পানিতেও পড়ে যাচ্ছে। অনেক যাত্রী টুরিস্ট মনে হলো। আমার পক্ষে ধাক্কাধাক্কি দিয়ে বোটে উঠা সম্ভব নয় ভেবে হাল ছেড়ে দিয়ে মহেশখালী যাবার আশা ত্যাগ করে আমি সেদিন বাসায় ফিরে গেলাম। এ দৃশ্য একদিনের নয়, প্রতিদিনের।

মকবুল আহমেদ:
সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলি সবই নদী মাতৃক ও সাগর বেষ্টিত। নদী ও সাগরের পাড়ে-পাড়ে বিশ্বের বড় বড় নামীদামী শহরগুলি গড়ে উঠেছে। এই সাগর ও নদী দেশগুলিকে অপার সৌভাগ্য এনে দিয়েছে। সবগুলি দেশেই উন্নত ও নিরাপদ নৌযান সার্ভিস রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়–নৌপথে ভাড়া অন্যান্য পথের চেয়ে অনেক কম। কারন প্রকৃতির দেয়া বিনা খরচায় জলের উপর দিয়েই নৌ-যান চলে। তাতে ব্রিজ-কালবার্ড-ব্যয়বহুল সড়ক কিছুই রাষ্ট্রকে নির্মান করতে হয় না। শুধু প্রয়োজন একটি ভালো মানের নৌযান। এই ভালোমানের নৌযান না দিতে পারার ব্যর্থতাকে ঘিরে মহেশখালী দ্বীপের মানুষের এতো হয়রানী ও এতো মানুষের মৃত্যু! এই বিনা খরচায় প্রাপ্ত যোগাযোগের সুযোগ-সম্ভাবনার এই জলপথ আমাদের রাষ্ট্রের অবহেলার মধ্যে পড়ে আছে। যে পাকিস্তানী আমলকে আমরা গালি দিতে পছন্দ করি, সেই আমলে মহেশখালী-কক্সবাজার জল পথে সরকারের উদ্যোগে লঞ্চ-স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। সেই সার্ভিস উন্নতির দিকে না গিয়ে অধ:পতনের দিকে গেল। ঔপনিবেশিক জমানার মতো এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতা ও আমলারা ইজারাদারীর খাম-খেয়ালির উপর লক্ষ লক্ষ মানুষের যাতায়াত ও জীবনের ভার ছেড়ে দিল। প্রতি বছর যাত্রী-সাধারণের মৃত্যু ও ভয়ভীতি নিয়ে যাতায়াত ও মানুষের হয়রানী বৃদ্ধি পেতে থাকলো।

স্পিডবোট ব্যবসার কাঁচা টাকার লোভে ও মান্দাতা আমলের গরু- ছাগল পরিবহনেরও অধম কাঠের নৌকা দিয়ে লোক পারাপার করার ব্যবস্থা জনগণের প্রতি কি রকম অবজ্ঞা ও অবহেলা থাকলে হতে পারে তার উদাহরণ মহেশখালী-কক্সবাজার ফেরিঘাট। এ অধ:পতিত অব্যবস্থা চালু রাখার জন্য রাষ্ট্রের জল পরিবহনের সংস্থা বি আই ডব্লিউ টি এ-কে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। কস্তুরাঘাটের এককালের সক্রিয় ও ব্যস্ততম বি আই ডব্লিউ টি এ-র অফিসটি এখন সরকারী কর্মকর্তাদের বিশ্রামখানায় রূপান্তরিত করেছে ! এর চেয়ে উপকূলের যাতায়াত ব্যবস্থাপনার অধ:পতন আর কি হতে পারে?

প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা মহেশখালী দ্বীপের প্রসঙ্গে হামেশা পর্যটনের কথা বলে থাকেন। কোনো পর্যটক যিনি একবার মহেশখালী এসেছেন তিনি ফিরে যেতে-যেতে যাতায়াতের অব্যবস্থাপনা ও হয়রানীর কথা বলতে-বলতে যান এবং ঘাট ব্যবস্থাপকদের গালমন্দ করতে-করতে ফিরে যান। মহেশখালীর বাসিন্দা যারা দ্বীপের বাইরে থাকেন এবং তারা যদি মাসে ছ-মাসে বাড়ি যেতে চান , তারা কক্সবাজার ৬নং ঘাটে ও গোরকঘাটা ঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা নৌকার জন্য অপেক্ষা করার হয়রানীতে ভোগে নিজের বাড়ি-ঘরে যাবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আর মহেশখালীর যারা ব্যবসা-বানিজ্য করে পরিবার চালান তাদের ব্যবসার সিংহভাগ মুনাফার টাকা এই ঘাটের টোল আদায়কারীকে দিয়ে যেতে হয়। টোল পরিশোধের রাষ্ট্রের কোনো নিয়ম-নীতি এখানে কখনো কেউ দেখে নি। মগের মুলুক নামে বাংলায় যে পরিভাষা আছে তার সাক্ষাত উদাহরণ এই মহেশখালী-কক্সবাজার ফেরিঘাটে লক্ষ্য করা যাবে। মহেশখালী-কক্সবাজার ফেরিঘাটের দূরত্বের ৪/৫ গুণ বেশি দূরের পথ রামু-কক্সবাজারের দূরত্ব। রামুর মানুষ জেলা শহরে আসেন ২০/২৫টাকায় আরামদায়ক বাসে চড়ে। আর মহেশখালীর দ্বীপের মানুষ স্বল্প পথ পাড়ি দিয়ে জেলা শহরে আসেন বৃষ্টিতে ভিজে আর রোদে পুড়ে এবং ভয়ে ও ত্রাসে প্রাণ হাতে নিয়ে নগদ জনপ্রতি ৭৫ টাকা গুণে দিয়ে। এই উচ্চ মূল্যের ভাড়ার বাইরে কক্সবাজারের ৬ নং ঘাটে ভিন্ন দেশে পাড়ি দেবার মতো ইমিগ্রেশনের টোল আদায়ের নির্মম দশা সব লোকেই জানেন।

ডিমের খোলসের মতো যাত্রী পারাপারের অনিরাপদ ও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বাহন স্পিডবোটে উঠার জন্য প্রতিদিন যাত্রীদের যুদ্ধ করতে হয়। মারামারি, ধাক্কাধাক্কি করতে হয় ৭৫ টাকা দামের উচ্চ মূল্যের নিচুমানের ময়লাযুক্ত একটি সিট যোগাড় করার জন্য। কেন এ হয়রানী? যাত্রীরা কি বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করেন? কেন ৫০/১০০ জনের উপযোগী দ্রুতগতির উন্নত ও নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা নেই? বৃটিশ আমলের পরিত্যক্ত লোক দেখানো কাঠের বোট অপসারণ করে আসন বিশিষ্ট ও ছাউনিযুক্ত উন্নত বোটের ব্যবস্থা নেই কেন? স্থানীয় ইজারাদারী প্রথা কিংবা প্রশাসনের টাকা কামানোর খাস-কালেকশন প্রথা তুলে দেন না কেন? এতে কার কত লাভ দুদকের তদন্ত করা উচিত। এস আলম বা গ্রীন লাইন কোম্পানীকে নীতিমালা তৈরি করে দিয়ে বলুন তারা রাতারাতি উন্নত বোট বা লঞ্চ তৈরি করে ব্যবসা করবে। রাষ্ট্রের জলপরিবহন সংস্থা বি আই ডব্লিউ টি এ-কে অচল করে রাখা হয়েছে কেন? তাকে সক্রিয় করুন। মহেশখালী-কক্সবাজারের এ প্রাচীন ফেরিঘাটে এই সরকারী সংস্থাকে অচল করে রাখা দেশের চরম অবনতি, তাকে সচল করাতেই দেশের উন্নতি বোঝায়।

আমাদের বন্ধু ড. সলিমুল্লাহ খান মহেশখালী-কক্সবাজার ফেরিঘাটের দুর্বিসহ পারাপারের বিষয়ে এক আলাপকালে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন — তাঁর আমেরিকা বাসকালে তিনি দেখেছেন একটি দ্বীপে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য উক্ত দ্বীপে যাবার ভাড়া ফ্রি, শুধু ফিরে আসার ভাড়াই দিতে হয়। তিনি বলেন, নিরাপদ ও আরামদায়ক যাতায়াতের জন্যই লোকেরা উক্ত দ্বীপে যেতেন এবং ওখানে ভ্রমণকালে কেনাকাটা ও খাওয়া-দাওয়ার খরচ করা থেকেই পর্যটকদের যাবার ফ্রি ভাড়া কর্তৃপক্ষ পুষিয়ে নিতেন। এটা বললাম আমাদের প্রশাসনের পর্যটন ভাবনা বোঝার জন্য। মহেশখালী ফেরিঘাটে নৌকার ও ঘাটের মাঝি-মাল্লারা পর্যটকদের এবং সাধারণ যাত্রীদের যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভাবে ব্যবহার করে এবং মালামাল পরিবহনের ভাড়া হিসেবে যে জোর-জবরদস্তি করে টাকা আদায় করে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। বিগত দীর্ঘ ৩০/৪০ বছরের সুশাসন বলুন আর দু:শাসন বলুন দ্বীপের মানুষের এ অসহায়তা ও দুর্ভোগ থেকে মুক্ত করা যায় নি। মানুষের জীবন ও সময়কে মূল্য দেবার বিষয় আর উপেক্ষা করা চলে না। সভ্যতা ও উন্নতির প্রধান কথা উন্নত ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রচলন।