মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

একজন নুর আহমদ। আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, আইনবিশারদ, রাজনীতিবিদ সহ আরো অনেক গুনে গুণান্বিত। অসাধারণ মেধা ও বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন এই মানুষটি জন্মেছিলেন, ১৯৪৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজার সদর উপজেলার খরুলিয়া গ্রামে। পিতা ছিলেন-মৌলভী ছৈয়দ আহমদ। মাতা ছিলেন-গুলবাহার খাতুন। নুর আহমদ ছিলেন, ৫ ভাই ৪ বোনের মধ্যে তৃতীয়।

এই মানুষটি’র ৭৭তম জন্মদিন আজ মঙ্গলবার ১৫ সেপ্টেম্বর। অনেকেই তাঁকে অধ্যাপক নুর আহমদ হিসাবে চিনেন। কারণ এই মানুষটি কক্সবাজার কলেজ সহ বিভিন্ন কলেজে ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। আবার কক্সবাজার আইন কলেজ প্রতিষ্ঠার পর সেখানে ১৯৮৫ সাল থেকে দীর্ঘদিন তিনি অধ্যাপনা করেছেন বিনাবেতনে সুনামের সাথে। তার স্বীকৃতি স্বরূপ এবছরের প্রথম দিকে কক্সবাজার আইন কলেজের সাবেক সফল অধ্যাপক হিসাবে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশেষ সম্মাননায় অভিষিক্ত করেন।

তিনি এডভোকেট নুর আহমদ হিসাবেও সুপরিচিত। কারণ বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে এডভোকেটশীপ সনদ নিয়ে একজন নবীন আইনজীবী হিসাবে ১৯৭৩ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতিতে যোগদান করেন। তখন থেকে তিনি দীর্ঘ ৪৬ বছর যাবৎ কক্সবাজারে আইন পেশায় জড়িত। যদিও বয়সের ভারে জ্ঞান পিপাসু এই মানুষটি এখন আর খুব একটা তাঁর প্রিয় অঙ্গন আদালতের দিকে যেতে পারেন না। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৭ বছর এপিপি হিসাবে আদালতে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৭ সালে জেলার সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা হিসাবে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউট (পিপি) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। আদালতে ফৌজদারী আইনের বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনায় অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন-জীবনের অধিকাংশ সময়। আদালতে তাঁর প্রাজ্ঞ, প্রাঞ্জল ও সাবলীল উপস্থাপনা ছিলো অনুসরনীয় ও শিক্ষনীয়। আইনের ব্যাখা ও আইন চর্চায় এডভোকেট নুর আহমদ এর অসাধারণ পান্ডিত্য ফুটে উঠতো সবসময়। সফল আইনজীবী হিসাবে পেয়েছেন-কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির বিশেষ সম্মাননা। সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম এর হাত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়েছেন এই সম্মাননা। প্রতিজযশা আইনজীবী এডভোকেট নুর আহমদ ২০০৪ সালে আইন বিষয়ে “আইন ও বিচার” নামক তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশ করেন। বিচারঙ্গনের প্রয়োজনীয়তায় এই গ্রন্থটির “Law & Justice” নামে ইংরেজি সংস্করণও বের করা হয়।

কক্সবাজার জেলার সর্বিক বিষয়াদি নিয়ে ১৯৮৮ সালে নুর আহমদই সর্বপ্রথম “কক্সবাজারের ইতিহাস” গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এজন্য দীর্ঘ প্রায় একদশক এ অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষনা করেছেন তিনি। “কক্সবাজারের ইতিহাস” গ্রন্থটির পাঠক কাটতি বেড়ে যাওয়ায় ২০০৫ সালে গ্রন্থটি ২য় সংস্করণ বের করা হয়। অসাধারণ পাঠক জনপ্রিয়তা পায় লেখক-গবেষক নুর আহমদ এর এক দশকের সাধনার ফল “কক্সবাজারের ইতিহাস” নামক গ্রন্থটি।

নুর আহমদ কক্সবাজার মডেল হাইস্কুল থেকে ১৯৬০ সালে এসএসসি এবং ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ হতে কৃতিত্বের সাথে এইসএসসি পাশ করেন। ছাত্রজীবনে নুর আহমদ চট্টগ্রাম কলেজ অর্থনীতি সংসদ এর প্রথমে সদস্য ও পরে সহ সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং ১৯৬৬ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন সফলতার সাথে।

একসময় নুর আহমদ কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে একসময় সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা জমাদার ফজল করিম ছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সামরিক আদালতে সরকার পক্ষের সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করতে মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা জমাদার ফজল করিম সে সময় জীবনবাজি রেখে দুঃসাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। লেখক, গবেষক নুর আহমদ এর তৃতীয় গ্রন্থ হলো “মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু”। সমসাময়িককালে এ গ্রন্থটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

কক্সবাজার আইনঙ্গনের বটবৃক্ষ এডভোকেট নুর আহমদ নবীন আইনজীবী থাকাবস্থায় ১৯৭৫ সালে ১৭ মে কক্সবাজার শহরের মধ্য টেকপাড়ার ঐতিহ্যবাহী বুনিয়াদি পরিবারের ফয়জুল কবির ও নাজমুন খাতুনের কন্যা মেহবুবা বেগমকে সহধর্মিণী হিসাবে বেঁচে নেন। এডভোকেট নুর আহমদ ও মেহবুবা বেগম দম্পতি ৩ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের গর্বিত জনক ও জননী। তাঁদের জ্যেষ্ঠ সন্তান এডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বিগত প্রায় ১২ বছর ধরে এপিপি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। দ্বিতীয় সন্তান রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক কক্সবাজার শাখার নির্বাহী কর্মকর্তা। তৃতীয় সন্তান ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদ হসপিটালিটি এন্ড ট্যুরিজম বিষয়ে অনার্স করে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজেমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে আবার এলএলবি করছেন। একমাত্র কন্যা সাজিয়া আফরিন একজন গৃহিণী। বরণ্য আইনজীবী এডভোকেট নুর আহমদ ২০১১ সালে স্বস্ত্রীক পবিত্র হজ্জ পালন করেন। বর্তমানে কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ টেকপাড়া পাহাড়তলী সড়কে ‘পর্ণলতা’ ভবনে বসবাসরত এডভোকেট নুর আহমদ বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকটা অসুস্থ। কক্সবাজারবাসীর গর্ব, আইনঙ্গনের অহংকার, বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এই মানুষটির জন্য তাঁর ৭৭তম জন্মদিনে তাঁর বিগত ৪৫ বছরের জীবনসঙ্গিনী মেহবুবা বেগম তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর জন্য সকলের কাছে দোয়া কামনা করেছেন।