সিবিএন ডেস্ক:

জোর করে নয়, আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতায় আলাপ-আলোচনা ও মোটিভেশনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে চায় সরকার। বাংলা ট্রিবিউনকে এমনটাই জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে অত্যাধুনিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাদেরকে সেই এলাকা সরেজমিন দেখানোও হয়েছে। তারা সন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসার পর সুর পাল্টিয়েছেন। আমরা তাদের জোর করে নয়, আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতায় আলাপ আলোচনা ও মোটিভেশনের মাধ্যমে ভাসানচরে নিতে চাই।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে অত্যাধুনিক সুবিধা সংবলিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও সেখানে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না রোহিঙ্গারা। তারা বলছে, ভাসানচরে আসার জন্য তারা বাংলাদেশে আসেননি। নিজ দেশে ফিরে যেতে চান তারা। তাছাড়া চরটি দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের জন্য উপযোগী কিনা তা নিয়েও ভাবা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বিষয়গুলো নিয়ে এখনও তারা পর্যবেক্ষণ করছেন।

ভাসানচরে পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর সরেজমিন দেখতে গত ৫ সেপ্টেম্বর দুই নারীসহ ৪০ জন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ভাসানচরে যান। সে সময় তারা সেখানকার সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি সরেজমিন দেখেন। তখন তারা জানিয়েছিলেন, ভাসানচরের সবকিছু তারা দেখেছেন। তাদের জন্য সরকারের গড়ে তোলা অবকাঠামোগুলো মজবুত ও খুবই সুন্দর। ভিজিটে আসা সব রোহিঙ্গা নেতার এ ব্যবস্থাপনা পছন্দ হয়েছে। এতে মুগ্ধ হয়েছেন তারা। তাছাড়া মানুষ বসবাসে যেসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দরকার সেগুলোও এখানে রয়েছে। যেটি সেখানে আসার আগে ধারণার বাইরে ছিল। বলেছিলেন, ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার পর তারা অন্যদের বোঝাবেন।

কিন্তু সেখান থেকে ক্যাম্পে ফিরে আসার পর তাদের সেই সুর পাল্টে যায়। কেউ কেউ বলেন, ভাসানচর বসবাসের উপযোগী নয়। ঝড় আসলে তা ডুবে যাবে। দীর্ঘ বসবাসের উপযোগী কিনা বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। তাছাড়া তারা ভাসানচরে যেতে আসেননি। তারা চান মিয়ানমারে চলে যেতে। রোহিঙ্গাদের এমন মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ভাসানচরে সহসা রোহিঙ্গা পুনর্বাসন সম্ভব হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

জানতে চাইলে ভাসানচর ঘুরে আসা রোহিঙ্গা নেতা মো. মোস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ভাসানচর ঘুরে এসেছি। যা দেখেছি তা এখানকার অন্যদের বলেছি। তারা কী করবে না করবে এখনও ভাবনা চিন্তা করছে। এটা তো আমার একার চিন্তা নয়। সম্মিলিত চিন্তা। সবাই যদি আগ্রহী হয় তাহলে আমরা যাবো।

সেখানে কী কী দেখতে পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেখানে স্কুল, হাসপাতাল, সাইক্লোন শেল্টার, খেলার মাঠ, গরু-ছাগলের খামার, মুরগির খামারসহ সব আছে। এক কথায় আমি বলবো মিয়ানমার থেকে আমরা বাংলাদেশে এসেছি এটা যেমন আল্লাহর কুদরত ঠিক ভাসানচরও আল্লাহর কুদরত। আর এখন আমি তো একা সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। তাছাড়া ভাসানচরের রুমগুলো একটু ছোট। তারা আমাদেরকে বলেছেন, যাদের যেমন চাহিদা সে অনুযায়ী বরাদ্দ দেবে। মেয়েরা থাকলে তার জন্য একরকম। আর বৃদ্ধ থাকলে তাদের জন্য আরেক রকম রুম দিবে। সরকারের কাছে আমাদের যে ডাটা আছে সে অনুযায়ী রুম বরাদ্দ হবে। এভাবে হলে ভালো হয়।

এই রোহিঙ্গা নেতা আরও বলেন, আমরা তো ভাসানচরে যাওয়ার জন্য আসিনি। আমরা চাই মিয়ানমারে চলে যেতে। এখন কখন কীভাবে যাবো তারও কোনও কূলকিনারা নেই। এ নিয়ে ভাবনা চিন্তায় আছি। কোনটা ভালো হবে ভাবছি। এখানে বড় সমস্যা হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়। এটা সমস্যা করতে পারে। এটা শুধু আমার কথা নয়, সবার কথা।

ভাসানচর ঘুরে আসা অপর রোহিঙ্গা নেতা নূর মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনি কোনও কথা বলতে রাজি হননি। বলেন, ‘আমার গলায় ছুরি দিলেও কথা বলবো না। কথা বললে আমার সমস্যা হয়। অন্যরা আমাকে হুমকি দেয়। ভাসানচর নিয়ে কথা বলেতে নিষেধ আছে।’

ভাসানচর নিয়ে রোহিঙ্গাদের এমন মিশ্র প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তারা (রোহিঙ্গারা) ভাসানচরে সরেজমিন গিয়ে আকৃষ্ট হয়েছেন। তখন বলেছে এর পরিবেশ খুবই ভালো। ক্যাম্পে গিয়ে অন্যদের বুঝাবে। কিন্তু ভাসানচর থেকে ফিরে তাদের সুর পাল্টে যায়। এখন বলছে দীর্ঘ সময় সেখানে থাকা সম্ভব হবে কিনা এসব নিয়ে তারা ভাবছে। এখন জোর করে তো তাদেরকে সেখানে নেওয়া যাবে না। এমন কোনও ইচ্ছাও নেই সরকারের। আমরা তাদেরকে মোটিভেট করার চেষ্টা করছি। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। তাদের সহযোগিতায় আমরা বিষয়টি সমাধান করতে চাই।

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, এত সুন্দর একটা অ্যারেজমেন্ট। সেখানে ফাইভ স্টার হোটেলের মতো অ্যারেজমেন্ট আছে। খুব সুন্দর পরিবেশ। শিক্ষা ব্যবস্থা, ফুয়েল সাপ্লাই, স্যানিটেশন, ওয়েদার সিকিউরিটি, মেডিক্যাল সাপোর্টসহ সব ব্যবস্থা রয়েছে। একটা ভালো আবাসিক এলাকার জন্য যা যা দরকার সেখানে সবটাই আছে। এখন ওরা না যাওয়ার ইচ্ছা থেকেই বিভিন্ন কথাবার্তা বলছে। এটা তো আন্তর্জাতিক সমস্যা। তাই আমাদেরকে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে আগাতে হবে।

পৃথিবীর সব শরণার্থী সমস্যা অনেক লম্বা সময় নিয়ে সমাধান হয় উল্লেখ করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।

ভাসানচর নিয়ে কথা না বলতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভাসানচর থেকে ফিরে যাওয়া এক রোহিঙ্গা নেতা। কেউ এটা নিয়ে চক্রান্ত করছে কিনা এমন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ এটার পেছনে কাজ করছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। তবে আমরা চাই আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা নিয়ে সমস্যাটি সমাধান করতে।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ এবং এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়। বাড়তি টাকা বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা, অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধিসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে ব্যয় হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।