সোয়েব সাঈদ ॥

বিজ্ঞ সহকারি জজ আদালতে ৪টি মামলা বিচারাধিন থাকা সত্ত্বেও জমির ক্ষতিপূরণের ২ কোটি টাকা হরিলুট করেছে কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহন শাখার দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তা ও দালালচক্র। আদালতে মামলা চলমান থাকায় এসব ক্ষতিপূরণের টাকা না দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসক এবং ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাকে লিখিত আবেদনও দিয়েছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা। কিন্তু ভূমি মালিকদের আবেদনের তোয়াক্কা না করে দালালদের সাথে আতাঁত করে বিপুল টাকা কৌশলে উত্তোলন করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। টাকা উত্তোলনের জন্য ভূয়া আপোষনামাও সৃজন করা হয়েছে। এসব আপোষনামায় ছিলো না ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক স্বাক্ষর। অর্থাৎ ভূমি মালিকদের স্বাক্ষর জাল করে ভূয়া আপোষনামা সাজিয়ে চিহ্নিত দালাল ও এলও অফিসের দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিয়েছেন ২ কোটি টাকা।

এ ঘটনায় দূর্ণীতি দমন কমিশন দুদকে লিখিত অভিযোগ দেন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া গ্রামের মৃত সোলেমানের ছেলে আবুল কালাম। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়ছে, তাদের স্বত্বদখলীয় জমি দোহাজারি হতে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলওয়ের ভূমি অধিগ্রহনের আওতায় পড়ে। কিন্ত তাদের জমিটি ভুলক্রমে অন্যের নামে বিএস খতিয়ানভূক্ত হলে তিনি এ নিয়ে কক্সবাজার বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে খতিয়ান সংশোধনের মামলা (নং ৯০/১৮) দায়ের করেন। বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে নিয়োগকৃত কমিশনার এ মামলায় বাদীর পক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। বর্তমানে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান। কিন্তু দালাল চক্রের সহায়তায় ভূমি অধিগ্রহন শাখার সাবেক সার্ভেয়ার মাসুদ রানাসহ আরো কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগসাজশ করে আদালতের অগোচরে মামলার বাদী পক্ষের ইসলাম গং, বিবাদী নুরুল হক গং এর সাথে ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর একটি বিতর্কিত আপোষনামা সৃজন করেন। এতে মামলাটির ৬-১৩ নং বাদীকে বাদ দিয়ে সকল বাদীর সাথে আপোষের কথা বলা হয়। এ আপোষনামায় মামলার অনেক বাদীর স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। এ আপোষনামায় স্বাক্ষর জানা অনেক ব্যক্তির টিপসই আবার লিখতে জানেনা এমন ব্যক্তির ইংরেজিতে স্বাক্ষর দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আপোষনামার স্বাক্ষরের সাথে মামলা, নোটারীতে দেয়া স্বাক্ষরের কোন মিল নেই। এতে প্রতিয়মান হয়ে এ আপোষনামা ভূয়া।

দুদকের কাছে দেয়া অভিযোগের বাদী আবুল কালাম আরো জানান, এ জমি নিয়ে ৯০/১৮ নং মামলা ছাড়াও কক্সবাজার বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে আরো ৩টি মামলা মামলা (নং যথাক্রমে অপর-২০৭/১৮, মিচ মামলা নং ১২/২০১৭, অপর ৩৭০/২০১৮ বিচারাধিন রয়েছেন। এরপরও বিজ্ঞ আদালতের প্রতি কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে লোভের বশবর্তী হয়ে সার্ভেয়ার মাসুদ রানাসহ আরো কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী-দালাল চক্র যোগসাজশ করে প্রকৃত ভূমি মালিকদের প্রায় ২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এরমধ্যে দালালরা কয়েকজন ভূমি মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা দিলেও কমিশন হিসেবে অগ্রিম চেক নিয়ে রাখায় সেই টাকাও পায়নি তারা। অর্থাৎ ক্ষতিপূরণের সব টাকাই হাতিয়ে নিয়েছে ভূমি অধিগ্রহন শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারি ও দালালচক্র। দুদকের কাছে দেয়া অভিযোগে তিনি উত্তোলনকৃত এসব টাকা উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে জমা রাখার আবেদনসহ জড়িত ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎকারিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

অভিযোগে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফছার, ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা মর্তুজা আল মুঈদ ও আবুল হাসনাত, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা দেবতোষ চক্রবর্তী, ভূমি অধিগ্রহন শাখার নেপাল চন্দ্র ধর, সার্ভেয়ার মাসুদ রানা, মো. জহিরুল ইসলাম, মোখলেছুর রহমান, মাহবুব রহমান ও আবদুল জলিল, অপর ৯০/১৮ মামলার বাদি মো. ইসলাম, বিবাদী নুরুল হক, ইব্রাহীম খলিল, মোর্শেদ মেম্বার, নুরুল কবির, শামসুল আলম, শাহাজান, জাফর আলম, এনামুল হক, মিজানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনে দেয়া অভিযোগটি তদন্ত করছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক শ্রাবস্তী রায়। গত ১০ আগস্ট তদন্তকালে তাঁর কাছে অনিয়ম-দূর্ণীতির তথ্য ও পরে লিখিত বক্তব্য দেন অভিযোগকারি আবুল কালাম ও আবুল কাছিম।

অভিযোগকারি আবুল কালাম ও আবুল কাছিম জানান, দুদফা তদন্তের জন্য তাদের ডাকা হলেও বিবাদীদের ডাকা হয়েছে কিনা তারা জানেননা। এ কারণে তারা সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

দুদকের অভিযোগে অভিযুক্ত নুরুল হকও ভূমি অধিগ্রহন শাখার সাবেক সার্ভেয়ার মাসুদ রানা সহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং দালাল চক্রের ব্যাপক অনিয়ম-দূর্ণীতির তথ্য দিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযোগটির তদন্তকারি কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক শ্রাবন্তী রায়ের কাছে দেয়া লিখিত বক্তব্যে রামুর লম্বরীপাড়ার বয়োবৃদ্ধ নুরুল হক জানিয়েছেন, রেলের অধিগ্রহনকৃত তার জমি নিয়ে তিনি এবং ওয়ারিশগন বাদি হয়ে অপর-৯০/২০১৮ এবং অপর ২০৭/২০১৭ মামলা বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে বিচারাধিন রয়েছেন। তিনি জানান, এ জমি নিয়ে চলমান মামলার আপোষ-মিমাংসার নামে সার্ভেয়ার মাসুদ রানা ও তার সহযোগি (দালাল) শাহজাহানসহ একটি চক্র তাকে এবং জমির অন্যান্য মালিকদের মধ্যে ২ মামলায় পৃথক ভূয়া আপোষনামা সৃজন করে। পরে ওই আপোষনামা দিয়ে তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২ কোটি টাকা উত্তোলন করে কৌশলে আত্মসাৎ করে মাসুদ রানাসহ দালাল চক্র।

এরমধ্যে দালাল শাহজাহান নুরুল হক গং এর নামে এসেসমেন্টকৃত ৫৫ লাখ টাকা নিজের নামে চেক দিয়ে উত্তোলন করে।

এভাবে ভূমি মালিক নুরুল হক গং এর নামে কক্সবাজারস্থ ওয়ান ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, স্যোসাল ইসলামী ব্যাংক হতে শাজাহান ছাড়াও অপরাপর দালালরাও নিজেদের নামে চেক নিয়ে টাকা উত্তোলন করে। এভাবে জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের সব টাকাই হাতিয়ে নিয়েছে ভূমি অধিগ্রহন শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারি ও শক্তিশালী দালাল চক্র।

নুরুল হক জানান, দালাল চক্রের প্রধান হোতা শাহজাহান রামুর রশিদনগর ইউনিয়নের মুরাপাড়া এলাকার মৃত মোক্তার আহমদের ছেলে। সে সার্ভেয়ার মাসুদ রানার সহযোগি হিসেবে পরিচিতি। মাসুদ রানার ছত্রছায়ায় রমরমা দালালি করে ক্ষতিপূরণ নিতে আসা লোকজনকে নিঃস্ব করে দিতো শাহাজাহান। ২০১৯-২০২০ সালে এলও শাখার সিসি টিভির ফুটেজ দেখলেই দালাল শাহাজাহান ও সার্ভেয়ার মাসুদ রানার অপকর্ম ধরা পড়বে। শনাক্ত করা যাবে অন্যান্য দালালদেরও।

ক্ষতিগ্রস্ত জাহান আরা বেগম, ছেনুআরা বেগম, আবুল কালাম, নুরুল আমিন, রুহুল আমিন, নুরুল আজিম, মো. সেলিম, আবদুল মালেক, আবদুল খালেক, রাবেয়া খাতুনসহ অনেকে জানান, ক্ষতিপুরণের ২ কোটি টাকা উত্তোলন করে সব টাকাই ভূমি অধিগ্রহন শাখার দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও দালালরা আত্মসাৎ করেছেন। এরমধ্যে ভূমি অধিগ্রহন শাখার কর্মকর্তাদের কমিশন হিসেবে নেয়া হয় ৫৫ লাখ টাকা। আবার অপর ৯০/১৮ ও অপর ২০৭/১৮ মামলা দুটি আপোষ করে বাদীদের দেয়ার জন্য নেন ৫৫ লাখ টাকা। কিন্তু টাকা উত্তোলনের পর বাদিদের একটি টাকাও দেয়া হয়নি। অর্থাৎ এ ৫৫ লাখ টাকাও লুট করে দালালরা। এছাড়া আরো ৯০ লাখ টাকা জমির মালিকদের সাথে বিভিন্নভাবে প্রতারনা করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

সম্প্রতি দালাল চক্রের এক সদস্যসহ ২ জনের কাছ থেকে আত্মসাৎকৃত ক্ষতিপূরণের ২ লাখ টাকা উদ্ধার করে রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া গ্রামের স্থানীয় কয়েকজন শালিসকার। বর্তমানে ওই ২ লাখ টাকা লম্বরীপাড়া মসজিদ কমিটির কাছে জমা রয়েছে। লম্বরীপাড়া মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ জাকের আহমদ জানান, আজিজুল হক ও আবুল হোসেনের কাছ থেকে বিচারকরা ২ লাখ টাকা নিয়ে তার কাছে জমা রেখেছেন। জানা গেছে, বড় বড় দালালরা দূরবর্তী এলাকার হওয়ায় আত্মসাৎকৃত ক্ষতিপূরণের বিশাল অংকের টাকা উদ্ধার করতে সাহস পাচ্ছে না ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা।

এদিকে কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহন শাখায় রামুর লম্বরীপাড়া গ্রামের নিরীহ এসব জমি মালিকদের সাথে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও দালাল চক্র কর্তৃক ক্ষতিপূরণের বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জনমনে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। ক্ষুব্দ জনতা ও ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা অবিলম্বে এসব ক্ষতিপূরণের টাকা পূণরায় সরকারি কোষাগারে জমা করে চলমান মামলা নিরসন সাপেক্ষে সঠিক ভূমি মালিকদের বন্টনের জোর দাবি জানিয়েছেন এবং দরিদ্র ভূমি মালিকদের অসহায় পরিস্থিতিতে এ অভিযোগটির তদন্ত কাজ শুরু করায় দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

অপর-৯০/২০১৮ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবি এডভোকেট জসিম উদ্দিন (এজিপি) জানিয়েছেন, বিরোধীয় জমি নিয়ে মামলা রয়েছে। এ মামলায় ভূমি অধিগ্রহন শাখার কর্মকর্তাদের বিবাদী করা হয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার আগে ক্ষতিপূরণের টাকা না দিতেই মামলাটি করা হয়েছিলো। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহন শাখা বিজ্ঞ আদালতকে কোন প্রকার অবহিত না করে এবং অনুমতি না নিয়েই ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েছেন। এটা সঠিক হয়নি।

এব্যাপারে জানার জন্য কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহন শাখার সাবেক সার্ভেয়ার মাসুদ রানা এবং অন্যতম দালাল শাজাহানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তাদের মুঠোফোনের সংযোগ বন্ধ থাকায় উভয়ের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য সার্ভেয়ার মাসুদ রানাকে অনিয়মের অভিযোগে ইতিপূর্বে কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহন অফিস থেকে অন্যত্র বদলী করা হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশনে দেয়া অভিযোগটি তদন্ত করছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক শ্রাবন্তী রায়। তিনি জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে তিনি বিষয়টি তদন্ত করছেন। প্রশাসনিক নিয়ম মেনে বিষয়টি অগ্রসর হচ্ছে।