জে.জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:

চট্টগ্রামের মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার কথা জানিয়ে বিদায় বেলায় আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান।

শনিবার দুপুরে কোতোয়ালী থানার ওসি মোহম্মদ মহসীনের সঞ্চালনায় থানায় ‘হ্যালো এম্বুল্যান্স’ সেবা চালু ও গেইট উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন তিনি এসব কথা বলেন।

এ সময় পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, আমি নগরবাসীকে ধন্যবাদ জানাই, আপনারা আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি মনে করি, চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করা আমার জন্য বিশাল পাওনা। সত্যিকার অর্থে, চট্টগ্রাম শহর যেমন বিশাল, চট্টগ্রামের অবয়ব যেমন বিশাল, ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন বিশাল, এখানকার মানুষের মন-মানসিকতাও বিশাল।

তিনি বলেন, আমি একটি দৃষ্টান্ত দিতে পারি, এখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা আছেন, তারা অনেক বড় মাপের, তাদের মধ্যে সংকীর্ণতা আমি দেখিনি। অনেক তদবির-অনুরোধ আমি ভদ্রভাবে প্রত্যাখান করেছি, কিন্তু এ নিয়ে পরদিন কারও মধ্যে আমি দেখিনি কোন বিরাগ। অর্থ্যাৎ তাদের মন এত বিশাল, বড় যে তারা বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করতে পারিনি। আমরা আইনের মধ্যে থেকে তাদেরকে যতটুকু সহযোগিতা দেয়ার ততটুকু দিয়েছি।

করোনাকালে সিএমপির কার্যক্রম তুলে ধরে পুলিশ কমিশনার বলেন, আমরা স্বীকার করি বা না করি, বাস্তবতা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের একটি দূরত্ব আছে আবহমানকাল থেকে। আমরা আসলে সুযোগ পাইনি, এই দূরত্বটি কমানোর জন্য। বিভিন্নভাবে আমরা চেষ্টা করে যাই, দূরত্ব কমে, আবার বাড়ে। আমরা করোনাকালকে বেঁচে নিয়েছিলাম, এই দূরত্ব কমানোর একটা সুযোগ হিসেবে।

‘জন্ম থেকে বড় হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক যে ধারণা তৈরি হয়েই আছে, এই ধারণা থেকে যদি কিছুমাত্র কমানো যায়- এই চিন্তা থেকে করোনাকালে আমাদের এই কার্যক্রম। কাজ করতে গিয়ে সিএমপিসহ সারাদেশে অনেক পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, আমিও আক্রান্ত হয়েছিলাম। আল্লাহর রহমতে আমরা বেশিরভাগ সদস্যই সুস্থ হয়েছি। নগরবাসীও অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথমদিকে যে অব্যবস্থাপনা ছিল সার্বিকভাবে সরকারের নজরে আসার পর একটি সুষ্টু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইতিমধ্যে সমস্যাগুলো অনেকাংশে লাঘব হয়েছে।’

সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম শহরে যে সহযোগিতা আমি পেয়েছি, সত্যিকার অর্থে আমার মনে থাকবে। সাংবাদিক ভাইদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমি জানি না ভবিষ্যৎ সিএমপি কমিশনার কিভাবে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে, ঘুম থেকে উঠেই আমার প্রথম কাজ হলো লোকাল পত্রিকা পড়া। আর অনলাইনের সঙ্গে আমি একেবারে.. অফিস টাইম বাদ দিয়ে বাকি সময় আমার মুখস্ত থাকতো, অনলাইনের কোথায় কি হচ্ছে। অনেক কিছু আমাদের নলেজে আসে না। আমাদের অধীনস্ত যারা আছেন তাদের মাধ্যমে অনেক সময় আমরা আসল খবর পাই না। কিন্তু অনলাইন, গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা অনেককিছু জানতে পারি, যেগুলো সত্য হলে ব্যবস্থা নিতে পারি।

‘আমি ৮০-৮৫ ভাগ সাংবাদিকদের ফোন, কখনো কখনো ৯৫ ভাগ ফোন রিসিভ করতাম। অনেক সময় কষ্ট লাগতো। একই কথা দশজনকে বলতে হচ্ছে। আমি চেষ্টা করতাম, ৯০ ভাগ ফোন রিসিভ করতে। এটা ভবিষ্যতে পারাটা খুব কষ্ট হয়ে যাবে। কারণ কাজের পরিধি এত বেশী। তারপরও আমি চেষ্টা করতাম। অনেক ক্ষেত্রে কল রিসিভ না করলে পরে ব্যাক করতাম। এটা সত্যিকার অর্থে অস্পষ্টতা দূর করার জন্য। অনেক সময় ফোনটা রিসিভ না করলে সঠিক তথ্য তারা পাবেন না। এবং সঠিক তথ্য না পেলে গুজব ছড়াবে। এই আশংকা থেকে আমি ফোনগুলো রিসিভ করতাম। আমার ধারণা, সবার সঙ্গে আমার একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কারও সঙ্গে হয়তো ফিজিক্যালি দেখা হয়নি, কিন্তু আমি ভালোভাবেই তাদের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছি, এই শান্তিটুকু নিয়ে যাচ্ছি।’

চট্টগ্রাম নগরবাসী সত্যিকার অর্থে অনেক বড় মাপের মানুষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানকার সাংবাদিকরাও অনেক ভালো মানুষ, সাধারণ মানুষ অনেক ভালো। কথা নেই বার্তা নেই, চিনি না জানি না, যে কোন উৎসবে বাসায় খাবার পাঠিয়ে দেয়। দেখিনি, ফোনও করে না, কার কাছ থেকে এসেছে। এই আতিথেয়তা আমার নিজের জেলাতেও নেই। চট্টগ্রামকে অনেক ভালো ভাবি, ভালো ভেবেছি, এই ভালো অভিজ্ঞতা নিয়েই আমি চলে যেতে চাই।’

সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাটা কাটাতে চেয়েছেন জানিয়ে মাহাবুবব রহমান বলেন, আমার অফিসার যারা আছেন, অতিরিক্ত কমিশনার থেকে শুরু করে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমার সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করেছেন। ওসি মহসীনের কাজকর্মে পৃষ্টপোষকতা করেছি, উৎসাহ দিয়েছি। কখনো কোন কাজে বলিনি, এই কাজটি করা ঠিক হবে না। যে কোন ওসির ভালো কাজের সঙ্গে আমি ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকবো। আমাদের ভালো কাজের মাধ্যমে পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা যদি দূর হয়ে যায় সেটিই একজন অফিসার হিসেবে আমার প্রাপ্য, আমার কাম্য।

‘আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন, ঢাকায় যাচ্ছি, আসলে যাচ্ছি না। আমার অন্তর পড়ে থাকবে এই চট্টগ্রামে। কারণ আমি এখানকার লোকজনের সঙ্গে ফেসবুকে যুক্ত। আমাকে সবাই মনে রাখবেন। আমি ভুল করে থাকলে আজকে থেকে চাপা দিয়ে রাখবেন। ভালো স্মৃতিটুকু ধরে রাখবেন। আমিও চট্টগ্রামে তিক্ত অভিজ্ঞতা যা আছে সেটা ভুলে যেতে চাই। সুখস্মৃতি নিয়ে ঢাকায় যেতে চাই। আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। চট্টগ্রাম যেন কোন খারাপ খবরের শিরোনাম না হয়। এই শহরের মানুষগুলোও যেন ভালো ইমেজ নিয়ে বেঁচে থাকে।’

এ সময় সিএমপি অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) আমেনা বেগম, অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এস এম মোস্তাক আহমেদ খান, অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ ও বিভিন্ন জোনের উপ-কমিশনারবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।