শিপ্ত বড়ুয়া


কক্সবাজার জেলা সদর থেকে রামু উপজেলা মাত্র এগারো কিলোমিটারের পথ। পুরো রামু উপজেলা জুড়ে রয়েছে বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাচীন ও পুরানো সব ধর্মীয় স্থাপনা। রামু উপজেলার বিশাল বিশাল পাহাড় সম্বলিত একটি এলাকা রাজারকুল ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের পূর্ব রাজারকুল গ্রাম জুড়ে প্রায় ১০ টি মতো বড় বড় পাহাড় রয়েছে যেগুলোর দু’ একটি পাহাড়ে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের পুরানো নিদর্শন। তার মধ্যে কথিত বার্মা পাড়া সংশ্লিষ্ট পাহাড়ে মিলেছে প্রায় একশো বছরের পুরানো ৩০ ফুট উচ্চ একটি জাদী। সমতল ভূমি থেকে পাহাড়ের উপর উচ্চতা আনুমানিক ৩৫০ ফুট হতে পারে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকের লেখা পড়ে জানা যায় জাদীটি ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত।

তৎকালীন বৌদ্ধ ভিক্ষু উঁ দেবেন্দ্র মহাস্থবির কিংবা প্রকাশ পন্ডিত ঠাকুর এই ত্ব ক্যাং কিংবা রাজারকুল বনবিহার প্রতিষ্ঠা করেন। ধনিরাম স্যারের লেখা “রামুর প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য” বইয়ে এইসব তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায় উক্ত ভিক্ষু শ্রীকুল বিহারের প্রধান অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। ত্ব ক্যাংটি নির্মাণের লক্ষ্যে পরে তাঁর শিষ্য উঁ ইন্দ্রবংশকে শ্রীকুল বিহারে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।

স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বয়স্ক এবং মুরুব্বিদের মুখে শোনা যায়, রাজারকুলের এই ত্ব ক্যাং ও বনবিহার মূলত বৌদ্ধিক নিয়মে ধ্যান সাধনার জন্যই উক্ত ভিক্ষু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তিনি দীর্ঘদিন বিহারে ধ্যান-সাধনায় মত্ত ছিলেন। এভাবে দীর্ঘদিন ধ্যান-সাধনাকালে এই পাহাড়ের আশেপাশে কোন জনবসতি ছিলো না। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে কিছু মুসলিম পুশ ইন করার ফলে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন জায়গা এবং বান্দরবান জেলার বিভিন্ন খাস পাহাড় অংশে তারা তাদের জনবসতি আস্তে ধীরে গড়ে তুলে। তারই অংশ হিসেবে রাজারকুলের ত্ব ক্যাং এর পাহাড়ের পাদদেশে কিছু মানুষ তাদের জনবসতি গড়ে তুলতে থাকে।

এভাবে সময় আগাতে আগাতে একসময় তাদের প্রয়োজনের তাগিদে ত্ব ক্যাং এর প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ উঁ দেবেন্দ্র মহাস্থবিরের বিরুদ্ধে নানান অপবাদ দেওয়ার মাধ্যমে তাকে এখান থেকে তাড়ানো হয়। বর্তমানে এই জাদীর পাহাড়ের পাদদেশে পড়ে উঠেছে ভারী জনবসতি। প্রায় ৫০ বছর ধরেই অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে এই জাদীটি। রামুর বিভিন্ন জায়গায় বৌদ্ধ পল্লী ও মন্দির থাকলেও এই জাদীটি সংস্কারের জন্য এতদিন কেউ কোন উদ্যোগ নেন নি। সম্প্রতি রামুর তরুণ সংগঠক ও শিক্ষক সুমথ বড়ুয়া তত্ত্বাবধানে এই জাদীটি সংস্কারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে রামুর বিভিন্ন তরুণ। অর্থাভাবে এবং পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনার অভাবে সকল উদ্যোগ এখন প্রায় মাঠে মারা যাওয়ার উপক্রম।

জাদীটি দর্শনে দেখা যায় লাওয়ে জাদীর মতো এই জাদীটিও ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে অসংখ্যবার। প্রাচীণ বৌদ্ধদের আদি নিবাস এবং ইতিহাসের অনন্য স্বাক্ষী এই ত্ব জাদী। স্থানীয় বসতির মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায় তারা এই জাদীটি পুনঃসংস্কারে যথেষ্ট সাহায্য করতে চান। তারা জানান জাদীটি একটি জাতীয় সম্পদ এবং প্রাচীন নিদর্শন। এটাকে জাতীয়ভাবে সংস্কারের দাবী জানান তারা। এখন অপেক্ষার পালা কখন সরকারিভাবে এবং স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন জাদীটি আরো বেশি দৃষ্টিনন্দন ও সংস্কারের কাজে এগিয়ে আসেন। রামুর দ্বিতীয় জাদী ত্ব ক্যাং কিংবা বনবিহার সংস্কার করা হলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যেমন তীর্থস্থান হয়ে উঠবে তেমনি সাধারণ পর্যটকের দৃষ্টি কাটবে এই রাজারকুল বনবিহার। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়া হলে রাজারকুলের ত্ব ক্যাং ও বনবিহার এবং কাউয়ারখোপের লাওয়ে জাদী ধ্বংস হয়ে যাবে।