হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর:
তেসেরা সেপ্টেম্বর তাওহিদী ছাত্রজনতার জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজের প্রতিষ্ঠা দিবস এটি । স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ইসলামের শাশ্বত আদর্শের পতাকাতলে সুসংহত করার মহান অভিপ্রায়ে ১৯৬৯সালের ৩ সেপ্টেম্বর এই আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনের অভিযাত্রা সূচিত হয়। উপমহাদেশের প্রথিতযশা আলিম ও বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ., আল্লামা যফর আহমদ ওসমানী রহ., আল্লামা আতহার আলী রহ., খতিবে আযম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ., আল্লামা মতিন খতিব রহ., আল্লামা হাজী মুহাম্মদ ইউনুছ রহ. এর মতো ঈমানী চেতনাদ্বীপ্ত মনীষীদের হাতে স্থাপিত হয় ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের বুনিয়াদ। ১৯৬৯ সালের এই দিনে নেজামে ইসলাম পার্টির তৎকালীন সদর দফতরে উল্লেখিত ইসলামী রাজনীতিবিদ ও বুযুর্গানেদ্বীনের অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক সংবাদ সম্মেলনে পার্টির সভাপতি আল্লামা যফর আহমদ ওসমানী রহ. আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী ছাত্রসমাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ সংগঠন ঈমানদ্বীপ্ত মশাল হাতে দেশব্যাপী তার প্রদীপ্ত বিচরণ অব্যাহত রেখেছে। ফলে অর্ধশত বছরের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় ইসলামী ছাত্রসমাজের অবদানে গড়ে উঠেছে ইসলামী আন্দোলনের অনেক নির্ভীক সিপাহসালার, একনিষ্ঠ দাঈ, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, সুবক্তা, প্রাজ্ঞ লেখক, সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক ও দক্ষ সংগঠক।

এ বিষয়ে সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতিদের অভিমত:
সংগঠনের দ্বিতীয় বারের মত নির্বাচিত সভাপতি, বর্তমান মজলিসে শুরা ও উপদেষ্টা পরিষদ চেয়ারম্যান, বিদগ্ধ লেখক ও গবেষক ড.আ.ফ.ম খালিদ হোসেন’র বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “ইসলামী ছাত্রসমাজের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রভূত লাভবান হয়েছি। ছাত্র সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে দিতে বক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। আমার মেধার বিকাশে সংগঠনের বিশাল অবদান রয়েছে। এছাড়া প্রশিক্ষণ কোর্সে নির্ধারিত বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য আমাকে অনেকে বই পুস্তক পড়তে হয়েছে। এতে করে আমার জ্ঞান অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি এবং ইসলামী ছাত্রসমাজ একে অপরের পরিপুরক সম্পুরক হয়ে পড়ি।” আরেক সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমীর, বিশিষ্ট লেখক ও কবি মাওলানা আব্দুল মাজেদ আতহারী বলেন “ ইসলামী ছাত্রসমাজের সাংগঠনিক কর্মকান্ডে নিজেকে শামিল করার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার জীবনের যাবতীয় কর্ম পরিধিতে ইসলামী ছাত্রসমাজের কর্ম উদ্যম ও স্পৃহাই মূল প্রেরণা এবং ব্যক্তি জীবনে কোন সফলতা –
যদি থাকে তার সিংহভাগই ইসলামী ছাত্রসমাজের মাধ্যমে পাওয়া। কারণ আমার মত মৌলভী বাংলার জমিনে হিসাব
ও গণনার খাতার কথা নয়। কেবলমাত্র ইসলামী ছাত্রসমাজের কর্মী হওয়ার সৌভাগ্যেই আজ আমার হাতে লিখকের কলম। আমার কণ্ঠে জাগরণ সঙ্গীত, আমার উচ্চারণে চেতনার কাব্য গীতি ও ছড়া সম্ভার। এসব কিছুই মহান আল্লাহর দান। উছিলা ইসলামী ছাত্রসমাজ।” সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বর্তমান মজলিসে শুরা সদস্য মাওলানা আব্দুল খালেক নিজামী বলেন “ইসলামী ছাত্রসমাজই আমাদের সত্য ও সুন্দরের অভিযাত্রায় প্রেরণা যুগিয়েছে, অভিজ্ঞতাকে করেছে সমৃদ্ধ। বিকশিত করেছে নেতৃত্বের যোগ্যতা ও দেশাত্মবোধক বৈশিষ্ট্যকে।” সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক শেখ লোকমান হোসেন বলেন “ইসলামী ছাত্রসমাজের সাথে যুক্ত হয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। আমার জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা এ সংগঠনের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। বর্তমান অবস্থায় আসার পিছনে ইসলামী ছাত্রসমাজের শিক্ষা এক বিরাট ভূমিকা রেখেছে বলে আমি মনে করি। আমার সফলতার যতটুকুই অর্জিত হয়েছে তার কৃতিত্ব আমি ইসলামী ছাত্রসমাজকেই দিতে চাই।” সাবেক বিপ্লবী কেন্দ্রীয় সভাপতি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন “ইসলামী ছাত্রসমাজ আমার প্রিয় সংগঠন। এ সংগঠনই আমাকে সাফল্যের চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে নিয়ে এসেছে।” -( তথ্য সূত্র – ৪৯ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সম্মেলন স্মারক’২০১৯- এ প্রকাশিত সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতিদের সাক্ষাৎকার)।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক গণমুখী ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা, স্বতন্ত্র ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও কওমী মাদ্রাসা সনদের সরকারী স্বীকৃতি প্রদানসহ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবী আদায়ের আন্দোলনে রয়েছে ইসলামী ছাত্রসমাজের সংগ্রামী অবদান। এছাড়াও তাগুতি শক্তির মোকাবিলা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং ইসলামী নেজাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ইসলামী ছাত্রসমাজের বলিষ্ঠ অংশগ্রহন ও সাহসী ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। তাই আজ ইসলামী ছাত্রসমাজ শুধু একটি নাম নয়; এটি একটি বিপ্লব, একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঈমানদ্বীপ্ত ঐতিহ্যের এক অনবদ্য স্মারক।

মনীষীদের দৃষ্টিতে ইসলামী ছাত্রসমাজ:
“তাগুতি শক্তির জমাট বাধা অন্ধকার ব্যুহ ভেদ করে ইসলামী ছাত্রসমাজের তরুণ সৈনিকেরাই জেগে উঠবে প্রভাতের সূর্যের ন্যায়।” – খতীবে আযম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ.।

“ইসলামী ছাত্রসমাজ নেতা-কর্মীদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, ঔদার্যপূর্ণ ব্যবহার ও মানুষকে সহজে আপন করে নেয়ার মত মহৎ গুণাবলী সর্বস্তরের ছাত্রজনতার মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।” – আল্লামা হাজী মুহাম্মদ ইউনুছ রহ.।

“ইসলামী ছাত্রসমাজ একটি ব্যতিক্রমধর্মী সংগঠন। সংগঠনটি সলফে সালেহীনের ত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ব্যাপৃত। এটি বাতিলের মোকাবিলায় এক আপোষহীন কাফেলা।” জাতীয় খতীব আল্লামা ওবাইদুল হক রহ.।

“এ দেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে সব কর্মবীর মুজাহিদ জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইসলামী ছাত্রসমাজ এগিয়ে যাচ্ছে এটিই গর্বের কথা। ইসলামী ছাত্রসমাজের বৃক্ষ অনাগতকাল ধরে চির সবুজ থাকুক, সুশোভিত হোক ফলে ও ফুলে।” – মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ.।

“ইসলামী মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ ও মুসলিম জাতির হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জিহাদে উদ্ধুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ইসলামী ছাত্রসমাজের নিরলস প্রচেষ্টা বহুদিন থেকেই আমি লক্ষ্য করে আসছি। ইসলামী ছাত্রসমাজ লক্ষ্যপথে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাক।” – মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.।

“ইসলামী ছাত্রসমাজ জাতির আশা ও মূল্যবান সম্পদ। জাতিকে আলোর পথ দেখাতে ইসলামী ছাত্রসমাজ বিশেষ সংগ্রামী ভূমিকা পালন করবে। নমরুদী দম্ভ হবে তাদের সংগ্রামের সামনে নতজানু।”- মাওলানা রেজাউল করিম ইসলামাবাদী রহ.। -( তথ্য সূত্র – ঢাকা মহানগর সম্মেলন স্মারক’১৯৯০ইং ও ৪৯ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সম্মেলন স্মারক’২০১৯ইং )।

৫১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভ সন্ধিক্ষণে ঐতিহ্যবাহী এ ঈমানী কাফেলার প্রতিষ্ঠাতাগণ ও মরহুম নেতৃবৃন্দের রুহের মাগফিরাত ও দরজাত বুলন্দি কামনা করি। সেই সাথে সংগঠনের সাবেক-বর্তমান নেতা-কর্মী,শুভানুধ্যায়ীসহ ছাত্রজনতার প্রতি জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। মহান আল্লাহর দরবারে কামনা করি এ সংগঠনের সকল নেতা-কর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু এবং হেরার জ্যোতির পানে প্রাগ্রসর প্রাণপ্রিয় এ বিপ্লবী কাফেলার উত্তরোত্তর সফলতা ও সমৃদ্ধি। আহবান জানাই ছাত্রজনতার প্রতি – আসুন, আমাদের হৃদয়ের দ্বার আপনাদের জন্য অবারিত সারাক্ষণ। আপনাদেরকে বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে হেরার জ্যোতির পানে নিয়ে যাবার জন্য হাত বাড়াচ্ছি।

লেখক:
সিনিয়র সহ-সভাপতি
কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজ।