এম নুরুল হক চকোরী:
হিজরী নববর্ষের প্রথম মাস পবিত্র মাহে মুহররমের ১০ তারিখ বা ঐতিহাসিক আশুরার দিন। ইসলামের ইতিহাসে বহু অবিস্মরণীয় স্মৃতি বিজড়িত এবং হৃদয় বিদারক মর্মস্পর্শী শোকাহত ঘটনার দিন। আজকের এই দিন সমগ্র পৃথিবী সৃষ্টির দিন। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র লওহে মাহফুজ ও যাবতীয় সৃষ্টি জীবের প্রাণ বা রূহসহ পৃথিবীর সমস্ত পাহাড়-পর্বত নদ- নদী সাগর-মহাসাগর এবং মানুষের প্রয়োজনীয় সব কিছু সৃষ্টি করেছেন আজকের এইদিনে। পৃথিবীর সর্ব প্রথম মানুষ আমাদের আদি পিতা- প্রথম নবী হযরত আদম (আ:) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং বেহেস্তে প্রবেশ করা হয়েছিল আজকের এদিনে। আজকের এই তারিখেই হয়েছিল মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আ: এর জন্ম। নূহ (আ:)ও তার উম্মতগণ হয়েছিলন মহাপ্লাবন এর কবল থেকে মুক্ত। কবুল হয়েছিল মহান আল্লাহর দরবারে হযরত আদম আ: এর তওবা । হযরত আইয়ুব (আ:)কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন এই দিনে। এই দিনেই হযরত ইউনুছ আ: পেয়েছিলেন মাছের পেট থেকে পরিত্রাণ। আজকের আশুরার দিন হযরত মুসা আ: ও তার অনুসারিদের বিজয় ও মহান স্বাধীনতার দিন। হযরত মুসা (আ:) ও তার কওম মহান আল্লাহর হুকুমে তৎকালীন জালিম বাদশাহ ফেরাউনের জুলুম নির্যাতন থেকে নাজাত লাভ করেছিলেন আজকের এই তারিখে। এদিনেই হযরত মুসা (আ:) তুর পাহাড়ে মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের গৌরব অর্জন করেছিলেন। হযরত ইয়াকুব (আ:) অনেক বিরহের পর তার প্রিয় পুত্র হযরত ইউসুফ (আ:) এর সাথে মুলাকাত হয়েছিল আজকের এই দিনে। হযরত ইব্রাহিম (আ:) জালিম বাদশাহ নমরুদের অঘ্নিকুন্ডে ৪০ দিন অবস্থানের পর মহান আল্লাহর কৃপায় নিরাপদ ও অক্ষুন্ন অবস্থায় হেসে হেসে বেরিয়ে এসেছিলেন আশুরার এই দিনে। হযরত ঈসা (আ:) কে ইয়াহুদিদের চক্রান্ত থেকে মুক্ত করে মহান আল্লাহ চতুর্থ আসমানে তুলে নিয়েছিলেন এই ১০ তারিখে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স:) এর দরবারে হযরত জিব্রাইল (আ:) মহান আল্লাহর রহমতের বানী নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন আজকের এই আশুরার দিনে। হৃদয় বিদারক কারবালার প্রান্তে মুসলিম উম্মাহর প্রাণের স্পন্দন হযরত হুসাইন (র:) সহ একে একে ৭২ জন শহীদের মর্মস্পর্শী ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল আজকের এদিনে। সর্বোপুরী হযরত ইস্রাফিল (আ:) এর সিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে এই সুন্দর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে মাহে মুররমের ১০ তারিখ জুমাবার তথা আজকের এই আশুরার দিনেই। তাই পৃথিবীর এই সুদীর্ঘ ইতিহাসে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য আশুরার আজকের এই দিন অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু অত্যন্ত দূ:খ ও পরিতাপের বিষয় যে আজ আমাদের সমাজে হিযরী নববর্ষ ও মুহাররম এলেই কারবালার ঘটনা নিয়ে সবাই মেতে ওঠে আর হিজরত ও আশুরার তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলী ভুলে যায়। এমনকি অনেকে শিয়াদের অনুকরণ করে আশুরাকে শুধু কারবালার শোক দিবস হিসেবে পালন করে নানা ধরণের কুসংস্কার ও বিদায়াতপূর্ণ বাক্যে জড়িত হয়ে পড়ে। কেননা সাধারণত তারা মনে করে কারবালাই আশুরার একমাত্র গুরুত্বপূুৃর্ণ ঘটনা এবং কারবালার কারণেই ইসলামে আশুরার এত গুরুত্ব। অথচ ইসলামের ইতিহাসে আশুরার গুরুত্ব লাভের সাথে কারবালার ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই। বলতে গেলে কারবালার কারণে আশুরারর গুরুত্ব বাড়েনি, বরং আশুরার কারণেরই কারবালার গুরুত্ব বেড়েছে। ইসলামী ইতিহাসের পাতা উল্টালেই আমরা দেখতে পাই লোমহর্ষক কত হৃদয় বিদারক মর্মস্পর্শী ঘটনার বিবরণ। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে ওসমান (র:) এর হত্যাকান্ড, হযরত আলী ও হযরত মোয়াবিয়া (র:) এ মধ্যকার দ্বন্দ্ব, আত্তায়ী কর্তৃক হযরত আলী (র:) এর শাহাদত এবং কারবালা প্রান্তরে নবী (স:) এর দৌহিত্র বেহেস্তের যুবকদের সর্দার হযরত আলী ও হযরত ফাতেমা (র:) এর আদরের সন্তান হযরত হোসাইন (র:) এর স্ব- পরিবারে শাহাদত বরণ, এসব কিছূই একটি ধারাবাহিক যড়যন্ত্রের ফসল। ছদ্ম বেশি মুনাফিক ইয়াহুদীর সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই এসব ষড়যন্ত্রের মূল হোতা এবং শিয়ারাই ছিল তার সহযোগী। ইসলামকে অংকুরেই নির্মূল করার হীন উদ্দেশ্যে এ চক্রটি মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও মতানৈক্যের বীজ বুনতে থাকে। এদের ষড়যন্ত্র, বিশ্বাস ঘাতকতা ও মুনাফেকির কারণে হযরত হোসাইন (র:) কারবালায় শহীদ হন। আবার এরাই নিজেদের পাপ ঢাকার জন্য নিজেদের অপরাধ ধামা- চাপা দেয়ার জন্য তখন থেকেই কারবালার ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য কারবালার ইতিহাসবিকৃতির অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছে। তার ধারাবাহিকতার আশুরার দিনে লোক দেখানো শোকের বন্যা বয়ে দিচ্ছে। তারা আশুরার মূল তাৎপর্যকে বাদ দিয়ে শুধু কারবালার ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে। । শিয়াদের নানা ধরণের কুসংস্কার ও বিদয়াত পূর্ণ কর্মকান্ড এবং ধারাবাহিক

ষড়যন্ত্র ও অপ প্রচারের ফলে আশুরা আজ তার ব্যাপক ঐতিহাসিক তাৎপর্য হারিয়ে শুধু কারবালার একটি হৃদয় বিদারক ঘটনার জন্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য যে, হযরত ওমর (র:) হযরত ওসমান, (র:) হযরত হামজা (র:) এর শাহাদতের ঘটনা কি কারবালার চেয়ে কম হৃদয় বিদারক? বদর ,ওহুদ প্রভৃতি যুদ্ধের মত সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম আর কোনটি আছে? এসব ছিল কাফিরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের আদর্শিক সংগ্রাম আর প্রকৃত পক্ষে সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক। অথচ কারবালা ছিল মুসলমানদের মধ্যকার রাজনৈতিক মত পার্থক্যের একটি অন্তদ্বন্ধ মাত্র। তাই বলে আমি কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনাকে ছোট করে দেখাতে চাচ্ছি না । আমি মনে করি কারবালার ঘটনা পবিত্র আশুরার দিনে সংঘটিত করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক হযরত হোসাইন (র:) এর শাহাদাত তথা কারবালার ঘটনাকে মর্যাদার দিক দিয়ে ঐতিহাসিক ভাবে শানিত করেছেন। আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে, হযরত হোসাইন (র:) এর শাহাদত তথা কারবালার ঘটনার মূল হোতা ও ষড়যন্ত্রকারী ছিল মুসলমানদের চির দুশমন ইয়াহুদী চক্র। আসলে ইয়াজিদের উপস্থিতিতে কোনদিন হোসাইন (র:) শাহাদত বরণ হতে পারতেন না। হযরত হোসাইন (র:) শাহাদতের ঘটনায় ইয়াজিদ গভীর ভাবে শোকাহত ও মর্মাহত হয়েছিল। ইয়াজিদ শেষে বুঝতে পেরেছিল ইয়াহুদী চক্রের ষড়যন্ত্র ও তার সৈন্যদের বিশ্বাস ঘাতকতার কথা।

আশুরার ফজিলত

মুহররমের ১০ তারিখ বা পবিত্র আশুরা একটি বরকতাময় ও ফজিলতের দিন। আশুরার দিন সর্ম্পকে মহানবী (স:) বলেছেন আশুরার দিবস রোজা রাখলে পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেছেন যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবার বর্গের পেছনে বেশী ব্যায় করবে আল্লাহ তার জীবিকা সারা বছর বৃদ্ধি করবেন। হাদীস শরীফে আছে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার দিন রোজা রাখা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা সুন্নাত হয়ে গেছে। হযরত আলী (র:) থেকে বর্ণিত এক ব্যক্তি হুজুর (স:) কে জিজ্ঞেস করলো- রমজানের পর কোন মাসে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদের্শ দিচ্ছেন? রাসূল (স:) বললেন রমজান মাস ছাড়া যদি আর কোন মাসে রোজা রাখতে চাও- তাহলে মুহররম মাসে রোজা রাখ। কেননা এটা আল্লাহর মাস, এ মাসে একটা দিন রয়েছে যেদিন আল্লাহ পাক একটি জাতির গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন এবং অন্য জাতির গোনাহ ক্ষমা করবেন, ঐ দিনটি হচ্ছে আশুরা । আশুরার দিনে হযরত মুহাম্মদ (স:) নিজে রোজা রাখতেন এবং অন্যকে রোজা রাখতে বলতেন। উল্লেখ্য যে, আশুরার দিনে ইয়াহুদিরাও রোজা রাখেন। তাই তাদের সাথে সামঞ্জস্য না হওয়ার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স:) আশুরার সাথে আরেকটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিল্নে । তাই মুহররমের ৯- ১০ অথবা ১০-১১ তারিখ ২টি রোজা রাখা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যার আলোকে জানা যায়, জিলক্বদ, ও জিলহজ্ব ও মুহররম এবং রজব এ চারটি মাস হচ্ছে আল্লাহর দরবারে সম্মানিত মাস। যারা এমাসে বেশী বেশী ইবাদত করবে- তারা অন্যান্য মাসেও আল্লাহর ইবাদত করার সুযোগ পাবে। অনুরূপ কেউ এ মাসগুলোতে পাপচার থেকে নিজেকে দুরে রাখতে ্পারলে বছরের বাকী মাস গুলোতেও পাপচার থেকে দুরে থাকা সহজ হয়। তাই এ সুযোগের সদদ্ব্যব্যাহার থেকে বিরত থাকা কোন বুদ্বিমানের কাজ হবে না। উপরোল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কারণে মুহররম মাস বিশেষ করে এর দশম তারিখ আশুরার দিন মুসলিম সমাজে অত্যন্ত পবিত্র ও ঐতিহাসিক মহিমাম্বিত হিসেবে বিবেচিত ।

কারবালার শিক্ষাঃ

৬০ হিজরির মুহররম মাসের ১০ তারিখ তথা আজকের আশুরার দিনে সংঘটিত কারবালার ঘটনায় নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করে হযরত হোসাইন (র:) সত্য ও ন্যায়ের পথে জুলুম, নির্যাতন ও জালিমের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের কথা জাতিকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আমাদের সকলকে সে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুহররমের আসল চেহারা নব প্রজন্মের সামনে দিন দিন বিলুপ্ত করে দেওয়ার সুক্ষè, ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। আমাদের মুসলিম সমাজের একটি গ্র“প প্রতি বছর মুহররম আসলে এ মাস কে শুধু শোকের মাস হিসেবে পালন করে। কারবালার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে মাতম মর্সিয়া, ক্রন্দন, বক্ষ প্রহার ও হযরত হোসাইনের (র:) মাজার সদৃশ তাজিয়া ও বিভিন্ন ধরনের শোকের ঝন্ডা উত্তোলন করা হয়। অথচ এগুলো সবই বিদায়াত ও নিষিদ্ধ । আল্লাহ আমদের পবিত্র আশুরা ও কালবালার প্রকৃত শিক্ষা উপলদ্ধি করার তাউফিক দান করুন আমিন।

লেখক: এ নুরুল হক চকোরী
সভাপতি,
কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ
chakurycox@gmail.com
০১৮৫৩৪১৩৩৪১