আবদুল হাকিম (মাসুম)
আরবী সনে মহররম একটি সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসের ১০ তারিখে পৃথিবীতে ঘটেছে আদ্যোপান্ত অনেক ঘটনা।

তারমধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে পেশ করা হলোঃ
১. ১০ মহররম, এই দিনে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীকে মানুষের বাসোপযোগী সব উপায় উপকরণ দিয়ে সামঞ্জস্য বিধান করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে আল্লাহরই প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মানুষ প্রেরণ করেছেন। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব যখন ছেড়ে দেবে, এমনি একসময় তিনি পৃথিবীর সব ব্যবস্থাপনা ধ্বংস করে দেবেন, সংঘটিত করবেন কিয়ামত। আর সেই দিনটি হবে ১০ মহররম ।

২. হজরত আদমকে ( আ:) মাটি থেকে সৃষ্টি করে বেহেশতে রাখা হয় মহররমের ১০ তারিখ । কালক্রমে পৃথিবীর প্রথম মানব- মানবী হিসাবে হজরত আদমকে (আ) বেহেশত থেকে নামিয়ে রাখা হয় শ্রীলংকার সিংহল দ্বীপে এবং হাওয়াকে ( আ) নামিয়ে রাখা হয় সাউদী আরবের জেদ্দায়, দিনটা ছিল মহররমের ১০ তারিখ। হজরত আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল করা হয় আশূরার এ দিনেই এবং হজরত আদম ও স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটে আরাফাতের ময়দানে এ দিনেই। অত: পর আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত আদমকে (আ) নবী ও নেতা (খলিফা) ঘোষণা করা হয়। পৃথিবীর প্রথম মসজিদ কা’বা তৈরি হয় হজরত আদম (আ) এর মাধ্যমে ।

৩. জর্ডানে হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা নবীর দ্বীন কায়েমের দাওয়াতকে অমান্য করে। যার ফলে তারা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হয়। নূহ (আ) ও মুষ্টিমেয় ঈমানদার মুসলমানেরা আল্লাহর হুকুমে একটি জাহাজে উঠে উদ্ধার পেয়েছিলেন। তুফান শেষে জাহাজটি ঠেকে যায় জুদি পাহাড়ের চূড়ায়। অত:পর নুহ (আ) সহ মুসলমানেরা মাটিতে নেমে আসেন। দিনটি ছিল ১০ মহররম।

৪.ইরাকে হজরত ইব্রাহিম (আ.) দ্বীন কায়েমের দাওয়াত দিতে গিয়ে তৎকালীন জালিম শাসক নমরুদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। অবশেষে নমরুদের জেলখানায় বন্দী হন। নমরুদের নির্দেশে আল্লাহর নবী ইব্রাহিমকে ( আ) নির্মমভাবে হত্যা করার জন্য বিশাল অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। আল্লাহর হুকুমে ইব্রাহিম (আ) অগ্নিকুন্ড থেকে নিরাপদে বের হয়ে আসেন। দিনটি ছিল ১০ মহররম ।

৫. সিরিয়ায় হজরত আইয়ুব (আ.) এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর সমস্ত শরীরে পচন ধরে যায় ও দুর্গন্ধ বের হয়। শেষে জিহ্বায় পোকা ধরে। তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন, হে আল্লাহ্, আমি ১৮ বছর কঠিন রোগে ভোগতেছি, কোন অভিযোগ করি নাই। আজ আমি অভিযোগ করবো। আমার জিহ্বায় পোকায় ধরেছে, যার কারণে তোমার সূন্দর নাম “আল্লাহ্” উচ্চারণ করতে পারছিনা । সূতরাং আমার অসূখ ভাল করে দাও প্রভূ। তাঁর দোয়ায় খুশি হয়ে আল্লাহ্ তাঁর অসূখ ভাল করে দেন। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন । তখন দিনটি ছিল ১০ মহররম ।

৬. ফিলিস্তিনে হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) তার ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কূপে পতিত হন এবং এক বণিক দল তাঁকে উদ্ধার করে মিশরে নিয়ে যায় এবং সেদেশের এক মন্ত্রীর কাছে বিক্রি করে দেয় । পরে এক মিথ্যা অপবাদে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয় । ঘটনা পরম্পরায় পরে তিনি মহান আল্লাহর ইচ্ছায় মিসরের প্রধানমন্ত্রী হন। ৪০ বছর পর তিনি ফিলিস্তিনে এসে পিতার সঙ্গে মিলিত হন। পুত্রশোকে অন্ধ হয়ে যাওয়া পিতা ইয়াকুব (আ) এর চোখের সামনে ইউসুফ(আ) এর পুরনো জামা তুলে ধরলে চোখ ভালো হয়ে যায় । এই ঐতিহাসিক দিনটি ছিল ১০মহররম ।

৭. ইয়েমেনে হজরত ইউনুস (আ.) দ্বীন কায়েমের দাওয়াত দিতে গিয়ে নিজ জাতির নেতৃস্থানীয় লোকদের দ্বারা চরমভাবে অবহেলিত ও অত্যচারিত হয়ে সাগর অতিক্রম করে দেশান্তরিত হওয়ার সময় পানিতে পতিত হন এবং এক বিরাটাকার মাছ তাকে গিলে ফেলে। মাছের পেটে ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহর কাছে বিপদ মুক্তির দোয়া করেন এবং আল্লাহ্ দোয়া কবুল করেন। এই মাছ সাথে সাথে তীরে এসে বমি করে দেয় এবং এভাবে হজরত ইউনুস (আ) মুক্তি পান। আর সে দিনটি ছিল মহররমের ১০ তারিখে।

৮.মিশরে হজরত মুসা (আ.) দ্বীন কায়েমের দাওয়াত দিতে গিয়ে তৎকালীন মিশরের রাজা ফেরাউনের রাষ্ট্রীয় বাধার শিকার হন। চালানো হয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও অপপ্রচার । শুরু হয় হয়রানি ও নিষ্ঠুর নির্যাতন। এক পর্যায়ে চলমান নির্যাতনের অংশ হিসাবে হজরত মুসা (আ) ও তাঁর অনুসারী মুসলমানদেরকে ধাওয়া করে জালিম ফেরআউন ও তার রাষ্ট্রীয় বিশাল বাহিনী। নবী মুসা (আ) ও তাঁর অনুসারী মুসলমানেরা আত্মরক্ষার্থে নীল নদীর দিকে সরে যায়। এদিকে মুসা (আ) ও তাঁর অনুসারী মুসলমানদেরকে প্রাণে মেরে ফেলার জন্য ফেরআউন এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। সে এগিয়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে হজরত মুসা (আ) আল্লাহর হুকুমে হাতে থাকা লাঠি দিয়ে নদীতে আঘাত করে। তৎক্ষনাত নদীতে ১২টা রাস্তা হয়ে যায়। হজরত মুসা (আ) ও তাঁর অনুসারী মুসলমানেরা রাস্তা দিয়ে নদী পার হয়ে যায়। এদিকে অত্যাচারী ফেরআউন নবী মুসা (আ) ও তার অনুসারীদের ধাওয়া করে নদীর মাঝ পর্যন্ত চলে যায়। আল্লাহর গজবে ১২টা রাস্তা আবার পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং ফেরআউন তার বাহিনী সহ পানিতে ডুবে মরে যায়। এভাবে মুসা (আ) ও তাঁর অনুসারী মুসলমানগণ ফেরআউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা পান। ঘটনার এ দিনটি ছিল মহররমের ১০ তারিখ । এ ঘটনাকে বনী ইসরাইলগণ প্রতি বছর বিজয় উল্লাস হিসেবে পালন করে থাকে এবং শোকরিয়া স্বরূপ একটি করে রোজা পালন করে। বিজয়ের হকদার হিসেবে উম্মতে মুহাম্মদির জন্য দুইটা করে রোজা পালন করার নির্দেশ রয়েছে । মূলতঃ ১০ মহররম হলো বিজয় উল্লাসের দিন।

৯. ফিলিস্তিনে হজরত ঈসা (আ.)-এর দ্বীন কায়েমের দাওয়াতকে জাতির নেতৃস্থানীয় লোকেরা সহ্য করতে পারে নাই। দ্বীনের দাওয়াতে বাধা, মিথ্যা অপবাদ,অপপ্রচার ও নানা হয়রানি জোরেসুরে চলতে থাকে । শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা মাফিক হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে রাতে বাড়ি ঘেরাও করা হয়। মহান আল্লাহ হজরত ঈসাকে (আ) তাদের হাত থেকে রক্ষা করে ঐ রাতেই আসমানে উঠিয়ে নেন। আর ঐ রাতটি ছিল মহররমের ১০ তারিখের ।

১০. ইরাকের ফূরাত নদীর তীর। কারবালা প্রান্তর । ইসলামী খেলাফত পুন:প্রতিষ্ঠার দাবিতে সত্যের সেনানী অকুতোভয় রাসূলের (স) দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা) কুপাবাসীর আমন্ত্রণে কারবালার প্রান্তরে উপস্থিত । এজিদের নির্দেশে কুপার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কর্তৃক ইমাম হোসাইনকে বাধা প্রদান । গভর্নরের হঠকারিতায় এক অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন ইমাম । শিশু মহিলা সহ ৭৩ জনের ইমামের কাফেলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গভর্নরের নেতৃত্বে ৪০০০ সশস্ত্র যোদ্ধা । ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই অসম যুদ্ধে পাপিষ্ঠ গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের নির্দেশে ধু ধু কারবালার প্রান্তরে নবী দৌহিত্র জান্নাতের যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইনকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার মস্তককে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। ইমামের কাফেলার মহিলা ছাড়া সব পুরুষদের হত্যা করা হয়। এ মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে ৬১ হিজরির ১০ মহররম ।
সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের সপক্ষে অটল অবিচল থেকে নিজেকে উৎসর্গ করার এ এক বিরল দৃষ্টান্ত মুসলিম দুনিয়ার সামনে ।

তিনি (আল্লাহ্) তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই বিধিবিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন । আর যা এখন তোমার কাছে (হে মুহাম্মদ) অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি এবং যার আদেশ ইতিপূর্বে আমি দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মুসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না । (সূরা আশশূরা- ১৩)
(সংকলিত)

আবদুল হাকিম (মাসুম)
পেশকার পাড়া
কক্সবাজার পৌরসভা
কক্সবাজার ।