সিবিএন ডেস্ক:
গত ২৩ মে উপসর্গ দেখা দেয়, ২৬ মে নমুনা পরীক্ষা করতে দিলে ২৯ মে রিপোর্ট আসে। ৩১ মে সকালে তীব্র শাসকষ্ট শুরু হলে হাসপাতালে ভর্তি হন গণমাধ্যমকর্মী হিটলার এ. হালিম। হাসপাতাল থেকে রাজধানীর মিরপুরের বাসায় ফেরেন ১০ জুন। হাসপাতালে ১১ দিন থাকার সময়ে ১০ দিনই তাকে ফুল টাইম অক্সিজেন নিতে হয়েছে, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি।

স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বরাবরই নিয়ম মেনে চলা হালিমের আগে কোনও ক্রনিক রোগ ছিল না। কিন্তু করোনা থেকে সেরে উঠলেও তিনি এখন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। তিনি বলেন, ‘কোভিড থেকে সেরে উঠেছি, কিন্তু কোভিড আমাকে হাই ব্লাড প্রেশার দিয়ে গেলো। হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া শুরু হলেও ১৫০/১০৫ এর নিচে আর নামতো না। বাসায় ফেরত আসার পর ঘুমের ওষুধ, প্রেশারের ওষুধ খাওয়ার পর সেটা কিছুটা নেমে আসে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা, ওষুধ না খেলে ঘুম হয় না। হয়েছে স্মৃতিভ্রমের সমস্যা, হাত পায়ের নখ কালো হয়ে গেছে। অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছি, এটা নিয়ে গত একমাস ধরে খুবই সমস্যায় পড়েছি। হয়তো যাবো শোবার ঘরে, চলে যাচ্ছি রান্নাঘরে। রান্নাঘরে আমি কেন গেলাম, সেটাও মনে করতে পারছি না।’

তিনি জানান, এখনও রয়েছে ভীষণ দুর্বলতা। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরত আসার দুই মাসের বেশি সময় পর এখনও হাঁটতে গেলে কষ্ট হয়, পা ধরে যায়, বেশি সময় নিয়ে কথা বললে নিঃশ্বাসে সমস্যা হয়, বুকে চাপ লাগে। এমনকি কোনও কারণে রাগ হলেও নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বলেন হিটলার এ. হালিম।

করোনা থেকে সেরে উঠেছেন রাজধানী পান্থপথে বসবাসকারী ব্যবসায়ী মেহেদী মাসুদ। কিন্তু করোনা তাকে দিয়ে গেছে ডায়াবেটিস। মেহেদী মাসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, করোনার সময়ে তার চর্মরোগ দেখা দেয়, যেটা আগে ছিল না। সেসময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মুহূর্তের ভেতরে অ্যালার্জি উঠে পুরো শরীরে ছড়িয়ে যায়। আর শরীরের যেসব জায়গা ঢেকে থাকে, সেখানে এটা বেশি হচ্ছিল। এটা খুব বাজে অ্যালার্জি ছিল।’

মেহেদী মাসুদ তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, তার চর্মরোগ হওয়ার পর তিনি যোগাযোগ করেন বিশিষ্ট চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ কবীর চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি তখন দেশের বাইরে। সেখান থেকে কবীর চৌধুরী তাকে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া বৈঠকে নানা দেশের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ পিরিয়ডে যারা সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের শরীরে নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে। এর অন্যতম কারণ, ইমিউনিটি সিস্টেম দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে শরীরের ভেতরে লুকায়িত ছিল যেসব জীবাণু, তার প্রকাশ হতে থাকে। এসব রোগের ভেতরে চর্মরোগ অন্যতম। তবে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পরই তিনি আক্রান্ত হন ডায়াবেটিসে, যেটা আগে তার ছিল না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক রোগী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর তার উচ্চ রক্তচাপ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে ছিল না। যার কারণে তার স্ট্রোক হয়। বাম পাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।

কোভিড পজিটিভ হয়ে সেরে উঠেছেন, এমন একাধিক ব্যক্তি বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্মৃতিভ্রষ্ট, অনিদ্রার মতো রোগে ভুগছেন তারা। শারীরিক ও মানসিক রোগের কারণে তারা ফিরতে পারছেন না স্বাভাবিক জীবনে। চিকিৎসকরা এর নাম দিয়েছেন পোস্ট কোভিড সিন্ড্রম।

দেশে এখনও এ বিষয় নিয়ে কোনও গবেষণা হয়নি। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়ার পর এসব নানা শারীরিক জটিলতা নিয়ে রোগীদের আবার হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। কোভিড আক্রান্তরা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেও তার চিকিৎসা শেষ হয়ে যায় না, তাকে নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে। সুস্থতা ও পুনর্বাসনের জন্য চিকিৎসা দরকার হয় তার।

করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর যে কারও রক্তের সুগার পরিমাপ করতে হবে জানিয়ে গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানজিনা হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনায় সংক্রমণের সঙ্গে ডায়ারেবটিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এটা এই মহামারি শুরু হওয়ার পরই জানা গেছে। এমনকি যেসব ডায়াবেটিস রোগী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, অন্যদের চেয়ে তাদের মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেশি। একইসঙ্গে আগে ডায়াবেটিস ছিল না, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন−এমন রোগীও অনেক পাচ্ছি আমরা।’

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন অতি সম্প্রতি জানিয়েছে, যাদের আগে ডায়াবেটিস ছিল না, করোনা হওয়ার পর তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার অনেক ঘটনা দেখা গেছে। এর ব্যাখ্যা হিসেবে তারা জানিয়েছে, এসিই রিসেপ্টর (এনজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম) এর মাধ্যমে শরীরে এটা প্রবেশ করে। আর এই এসিই রিসেপ্টর যকৃৎ, কিডনি, ক্ষুদ্রান্তেও রয়েছে। এই এসিই রিসেপ্টর অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে নিঃসৃত হওয়া ইনসুলিনকে নষ্ট করে দেয়। যার কারণে করোনা হওয়ার আগে ডায়াবেটিস না থাকলেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনের বরাত দিয়ে ডা. তানজিনা হোসেন বলেন, ‘কোভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে ফেরার পর শতকরা ৪২ শতাংশ রোগীর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। এতদিন ধরে জেনেছি, ডায়াবেটিস ধীরে ধীরে দীর্ঘদিন ধরে হয় বিভিন্ন অনিয়মের কারণে। কিন্তু এরকম হুট করে হাসপাতালে যাওয়ার পর ডায়াবেটিস হয়ে যাচ্ছে−এটা এই প্রথম দেখা গেলো।’

আর করোনা থেকে সেরে ওঠার পর ক্লান্তি বা অবসন্নতা, শ্বাসকষ্ট, অনিদ্রা, দীর্ঘদিন কাশি−এগুলো রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে যারা আইসিইউসহ হাসপাতালে ছিলেন, তাদের ডিপ্রেশন, ট্রমা যেতে সময় লাগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এমনও হতে পারে কারও কারও পুরো সেরে উঠতে আট মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।’

যে কোনও বড় ধরনের সংক্রমণের পর অন্যান্য রোগের লক্ষণ দেখা যায় জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেকেরই এসব সমস্যা ভালো হয়ে যায়। বিশেষ করে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়, আইসিইউতে যেতে হয় তারা সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর এ ধরনের সমস্যা বেশি হয়। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জটিলতা বেশি হয়। তবে অন্য রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হবে। পুষ্টিকর খাবার, ব্যায়ামসহ নিয়মের ভেতরে থাকতে হবে। আর ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে করোনার পর। সেক্ষেত্রে তাদের নিয়মিতভাবে সুগার চেক করে চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে হবে।’

কোভিডের পর কিছু রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে যাকে আমরা পোস্ট কোভিড বলছি−মন্তব্য করে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এর মধ্যে অবসাদ বা ক্লান্তি থেকে শুরু করে নানান সমস্যা রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার কারণে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়ার ওপর ঝড় বয়ে যায়। এ কারণে পরবর্তী সময়ে নানা রকম উপসর্গ দেখা যায়। এ কারণে কোভিড আক্রান্তরা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেও তার চিকিৎসা শেষ হয়ে যায় না। তাকে নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে।’

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এমন কেসও আমরা পেয়েছি যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়ার পর তার হঠাৎ মৃত্যু হয়েছে। আর এসব কারণেই করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেরে যাওয়ার পরবর্তী ধাপে পুনর্বাসনমূলক চিকিৎসা হওয়া দরকার।’