নঈম নিজাম

মুজিব ইন্দিরা ভুট্টো বেনজির হত্যা ট্র্যাজেডিনঈম নিজাম
‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই

মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই। ’

সেই সুর ও সংগীতের সুরকার কিংবদন্তি আলাউদ্দিন আলী চলে গেলেন।

অনেক দুর্দান্ত গানের সুর দিয়েছেন তিনি। আমাদের জমানার জনপ্রিয় বেশির ভাগ গানের সুরই তাঁর। অনেক দিন অসুস্থ ছিলেন। চলে গেলেন হুট করে। আহারে! মানুষের জীবন কেন এত ক্ষণস্থায়ী হয়? মৃত্যুর আগে হুমায়ূন আহমেদ আক্ষেপ করেছেন বারবার। সামান্য একটা কচ্ছপের আয়ু সাড়ে তিন শ বছর। আর মানুষ কে কখন চলে যাবে কেউ জানে না। করোনা জীবনকে আরও তুচ্ছ করে দিয়েছে। জীবন আর মৃত্যুকে টেনে এনেছে পাশাপাশি। কত মানুষকে হারাচ্ছি ইয়ত্তা নেই। কেউ যাচ্ছেন নিয়মিত অসুখে। কেউ করোনাভাইরাসে। আগামীর দিনগুলো আমাদের সামনে কঠিনতম। কে বাঁচব কে থাকব জানি না। পৃথিবীর স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে। কোনো দিন ফিরবে, তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। ব্যস্ততম বিমানবন্দর জেএফকের একটি ছবি শেয়ার করেছিলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। জনমানবের চিহ্ন নেই। অথচ বিমানবন্দরটি ছিল ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত। সারা দুুনিয়ার ফ্লাইট এসে থামত। কয়েক মাস কোনো ফ্লাইটই ওড়েনি। এখন টুকটাক চলছে। কিন্তু বেশির ভাগ টার্মিনাল আর বোর্ডিং ব্রিজ বন্ধ। সারা দুনিয়ার একই হাল। বিশ^ কোন দিকে যাচ্ছে কেউ জানি না। বলতে পারছি না করোনার ভ্যাকসিন বিশ্ববাসীর কাজে আদৌ আসবে কিনা। সাধারণ মানুষ ভ্যাকসিনের নাগাল পাবে কিনা। নিশ্চয়তা নেই কোনো কিছুর। অনিশ্চয়তা নিয়েই কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন,
‘বদলে যাচ্ছে, চোখের সামনে
পৃথিবীটা খুব বদলে যাচ্ছে।

যা কিছু প্রবল আঁকড়ে ছিলাম,

সেই সব কিছুই মায়া মনে হয়। ’

মায়ার বন্ধনের শেষ লড়াইটা এখন করছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। করোনাভাইরাস রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী চেনে না। ক্ষমতাবান বোঝে না। আলাদা করে থেকেও প্রণব মুখার্জি করোনায় আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অসাধারণ মানুষটি বাংলাদেশের নড়াইলের জামাই। ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়ার পরও গিয়েছিলাম দিল্লির রাজাজি রোডে তাঁর বাড়িতে। এ বাড়িতেই এ পি জে আবদুল কালাম থাকতেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। প্রণব মুখার্জি মানুষের রাজনীতি করেন। মানুষ ছাড়া থাকতে পারেন না। তাঁর গ্রেটার কৈলাসের বাড়িতে মানুষের পদচারণ ছিল সারাক্ষণ। রাষ্ট্রপতি ভবনকে একদা তিনি সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দিয়েছিলেন। এ গুণের প্রশংসা নরেন্দ্র মোদিও করেছেন। পন্ডিত, সজ্জন এ মানুষটিকে ঘিরে আজ গভীর উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশের এই বন্ধুর রোগমুক্তি কামনা করছি। প্রার্থনা করছি তিনি যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ দুনিয়ায় আমরা কেউই থাকব না। এ জগৎসংসার বড্ড বেশি ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু ভালো থাকার সময় আমরা তা বুঝি না। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে বিভিন্ন সময় অনেক কথা হয়েছে। উপমহাদেশের মুরুব্বির মতো ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফ, বেনজির ভুট্টো, শ্রীলঙ্কার চন্দ্রিকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। আলাপে নেপালের কথা কিংবা বাদ যায়নি বাংলাদেশের অনেক কিছুও। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের আপনজন ছিলেন। জিয়াউর রহমান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়েও গল্প করেছেন একবার। জেনারেল মইন বিষয়ও বাদ যায়নি। সেসব আড্ডার কিছু অংশ লিখেছি। অনেক কিছু লেখা হয়নি। সময় সুযোগ পেলে হয়তো লিখব। মাঝে মাঝে ভাবী, জীবনের পরতে পরতে জমে থাকা সবকিছু কি একজন সংবাদকর্মী লিখতে পারে? অথবা একজন রাজনীতিবিদ বলতে পারে? শ্যাওলার মতো ভিতরে অনেক কিছু জমে থাকে অব্যক্ত হয়ে। প্রকাশ পায় না। শুধু অব দ্য রেকর্ড নয়, অন দ্য রেকর্ডেরও অনেক কাহন থেকে যায় অপ্রকাশিত।

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনেক জীবনী পড়েছি। তাঁকে নিয়ে বায়োগ্রাফির সংখ্যা অনেক। ছায়াসঙ্গী পুপুল জয়করের লেখা ইন্দিরার জীবনী করোনাকালে আবার পড়লাম। ইন্দিরার সঙ্গে পুপুলের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। দুজনের অনেক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণাও আছে বইতে। বাদ যায়নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড ও ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবার্তা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইন্দিরা চিন্তিত হয়ে ওঠেন উপমহাদেশের আগামী নিয়ে। এমনকি নিজের নিরাপত্তা নিয়েও উৎকণ্ঠা ছিল। শিশু রাসেলের হত্যা তাঁকে ব্যথিত করেছে। ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে আগেই সতর্ক করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী ও ‘র’। হিমালয় হৃদয়ের বঙ্গবন্ধু সবকিছু উড়িয়ে দিয়েছেন। ভাবতেও পারেননি তাঁকে কোনো বাঙালি হত্যা করতে পারে। সারা জীবন লড়ে দেশটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা কী করে তাঁর বিপক্ষে যাবে! ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং-র-এর তখন প্রধান ছিলেন রামেশ্বর নাথ কাও। ১৯৭৪ সালে আর এন কাও খবর পান বাংলাদেশে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। আর পুরো ষড়যন্ত্র হচ্ছে প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরে। দিন দিন ষড়যন্ত্রের ডালপালা বিকশিত হচ্ছে। র-এর প্রধান দ্রুত সবকিছু জানাতে সাক্ষাৎ করেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। সব শুনলেন ইন্দিরা। তারপর আর এন কাওকে বললেন, তুমি দ্রুত বাংলাদেশ যাও। সবকিছু মুজিবকে অবহিত কর। ঢাকায় এলেন কাও। ছদ্মবেশ নিয়ে গেলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। সরকারপ্রধানের সাদামাটা নিরাপত্তাহীন জীবন তাঁকে বিস্মিত করে। এ বিস্ময় নিয়েই সাক্ষাৎ ইতিহাসের মহানায়কের সঙ্গে। বাকিটা পুপুল জয়করের বই থেকে কাও-এর মুখে শোনা যাক। ‘আমরা বাগানের মধ্যে পায়চারি করছিলাম। আমি মুজিবকে বলি, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য আছে। কিন্তু তিনি ছিলেন পাইপমুখে খোশমেজাজে। বলা যায় প্রাণবন্ত, সব সময়ের মতো রমরমা ভাব। আমার কথার জবাবে বললেন, “আমার কিছুই হতে পারে না, ওরা আমার লোক”। ’ চক্রান্তকে পাত্তাই দিলেন না বঙ্গবন্ধু। কাও বিস্মিত হলেন তাঁর কথা শুনে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ঢাকায় ভালোভাবে খাওয়া-দাওয়া করতে বললেন। ছদ্মবেশ নিয়েও মজা করলেন। দিল্লি ফিরে গেলেন কাও। সবকিছু জানালেন ইন্দিরা গান্ধীকে।

’৭৫ সালের মার্চে কাও আবার ঢাকা নিয়ে উদ্বেগজনক রিপোর্ট পান। একদিকে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে সরকার উৎখাতের বৈঠক, অন্যদিকে রাজনীতিতেও নানামুখী ষড়যন্ত্র। সেনাছাউনিতে সরকারবিরোধী বৈঠকে অংশগ্রহণকারীর অনেকেই নিয়মিত আসত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব তাদের পুত্রস্নেহ নিয়ে ভাত খাইয়ে দিতেন। এদেরই একজন ছিলেন মেজর ডালিম। ‘অটোবায়োগ্রাফি অব ইন্দিরা গান্ধী’ বইতে পুপুল লেখেন, ‘কাওয়ের কাছে খবর পৌঁছে গোলন্দাজ বাহিনীতে মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সংগঠিত হচ্ছে। এবার ইন্দিরা দ্রুতবেগে মুজিবকে অবহিত করেন সবকিছু। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে অসম্মত হন। তিনি তো বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা। তিনি তাঁর আপন লোকদের দ্বারা গুপ্তহত্যার শিকারে পরিণত হতে পারেন না। র-এর প্রতিবেদনগুলোয় লেখা ছিল, বাইরের দেশের শক্তি কর্তৃক ষড়যন্ত্রের কর্মসূচি পরিকল্পিত ও পরিচালিত হচ্ছে। ’ বঙ্গবন্ধু কোনো কিছুই বিশ্বাস করলেন না। বরং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেন সারা দেশে। মানুষের মুখে হাসি ফোটাতেই তাঁর নতুন লড়াই। আর বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল তাঁকে ঘিরে কোনো কিছু হতে পারে না। তাঁর ওপর কোনো বাঙালি আঘাত করতে পারে না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আঘাতের সাহস রাখেনি। আর বাংলাদেশের ছেলে-ছোকরারা কী করবে!

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইন্দিরার বাসভবনে যান পুপুল জয়কর। লাল কেল্লায় পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল। তিনি ভাষণ তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁর মন ভালো ছিল না। উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক দেখা দেয় ইন্দিরার মনে। পুপুলকে বললেন, ‘মুজিব হত্যা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের প্রথম অংশ। এ ঘটনা উপমহাদেশকে ডুবিয়ে দেবে। মুজিব চলে গেলেন। পরের টার্গেট হব আমি। ’ ইন্দিরা শিশু রাসেলের হত্যার খবর পান কিছুটা বিলম্বে। তিনি উৎকণ্ঠিত হন। রাহুল গান্ধী অনেকটা রাসেলের বয়সী। ইন্দিরা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না শিশু রাসেলকে ওরা নিস্তার দেয়নি। আগামী দিনে রাহুলকে নিয়েও এমন হতে পারে। ষড়যন্ত্রকারীরা আমাকে ও আমার পরিবারকে ধ্বংস করতে চায়। আমি গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো এত দিন অগ্রাহ্য করেছি। আগামী দিনে আমি কাকে বিশ্বাস করব?’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ইন্দিরাকে বিস্মিত ও হতাশ করে। লৌহমানবী নিজেকে নিয়ে চিন্তিত হন। নিজের সতর্কতা নিয়েও কথা বলেন ব্যক্তিগত পরামর্শকদের সঙ্গে। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কালো ছায়া এ উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেয়নি। সে ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় একদিন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় ইন্দিরা গান্ধীকে। ঘটনার ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু উপমহাদেশের অনেক হত্যাকান্ডের নিষ্ঠুরতার মিল কোথায় যেন রয়েছে। যার হিসাব মেলানো কঠিন।

এ হিসাব বেনজির ভুট্টোও মেলাতে পারেননি। ১৯৭১ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিতর্কিত আচরণ কার্যক্রমেও বেনজির ছিলেন বাবার সমর্থক। বেনজির তখন ভাবতে পারতেন না পাকিস্তান আর্মি খুন-ধর্ষণসহ এত বর্বরতা করতে পারে বাংলাদেশে। ভুট্টো পরিবারের প্রতি নিষ্ঠুরতা থেকেই পাকিস্তানি আর্মির বর্বরতা বুঝতে পারেন বেনজির। আত্মজীবনীতে তিনি কিছুটা তুলে ধরেন। সে সময় ডিসেম্বরে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের অবস্থান নিয়ে বাবা-মেয়ের কথা হচ্ছিল। বাবা মেয়েকে বললেন, ‘তুমি কি মনে কর, নিরাপত্তা পরিষদ ভারতের নিন্দা করবে এবং ভারতের সেনা প্রত্যাহারের তাগিদ দেবে?’ মেয়ে বললেন, ‘কেন নয়?’ জবাবে জুলফিকার আলী বললেন, ‘পিংকি! তুমি আইনের একজন ভালো ছাত্রী হতে পারো এবং আমি একজন হার্র্ভার্ড গ্র্যাজুয়েটের মতকে অস্বীকার করব না। কিন্তু তুমি ক্ষমতার রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই জানো না। ’ বেনজির আসলে তখনো অনেক কিছু অনুধাবন করতে পারেননি। এ ঘটনার কয়েক বছর পরই সিমলা চুক্তির সময় বাবার সঙ্গে ছিলেন বেনজির। ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিত্ব কাছ থেকে দেখেন সেদিন। তখনো বেনজির জানেন না তাঁর পরিবারের জন্য কী ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছে। বেনজির পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কন্যা তখন। একবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সময় পাকিস্তান গিয়ে এক অনুষ্ঠানে পরিচিত হন সেনাপ্রধান জিয়াউল হকের সঙ্গে। তাঁর বাবার নিযুক্ত সেনাপ্রধান। এ নিয়ে বেনজির লেখেন, ‘৭৭ সালের ৫ জানুয়ারি আমি জিয়ার সঙ্গে সামনা-সামনি পরিচিত হই। পরবর্তীকালে এ লোকটিই আমাদের সবার জীবন আকস্মিকভাবে বদলে দেয়। জিয়াকে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমি মনে মনে জেমস বন্ডের মতো দীর্ঘ, উগ্র, ইস্পাতসৈন্যকে কল্পনা করছিলাম পাকিস্তানে আমার বাবার সেনাপ্রধান হিসেবে। কিন্তু আমার সামনে দাঁড়ানো জেনারেল ছিলেন, খাটো, নার্ভাস, আত্মবিশ্বাসহীন একজন লোক। ছয়জনকে ডিঙিয়ে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ’

বেনজিরের ধারণাও বদলে দিয়ে ’৭৭ সালের ৫ জুলাই পাকিস্তানে সেনা অভ্যুত্থান হলো। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বাড়ি ঘেরাও হলো। এ সময় একজন পুলিশ সদস্য জীবন নিয়ে পালাতে অনুরোধ করলেন ভুট্টোকে। তিনি পালালেন না। বরং জুলফিকার আলী ভুট্টো ফোনে পেয়ে যান জেনারেল জিয়াকে। সেনাপ্রধান তাঁকে বললেন, ‘আমি দুঃখিত স্যার, আমাকে এটা করতে হলো। আপনাকে কিছু সময়ের জন্য নিরাপদ হেফাজতে রাখব। নব্বই দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন করাব। আপনি আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন। আপনাকে আমি স্যালুট করব। ’ তার পরের ইতিহাস সবার জানা। জুলফিকার আলী ভুট্টো সে সুযোগ আর পাননি। তাঁর বিরুদ্ধে পুরনো খুনের অভিযোগ আনা হলো। খুনের অভিযোগ এনে ফাঁসি দেওয়া হলো। ঝুঁকি নিয়ে বাবাকে দেখতে এসে আটক হলেন বেনজিরও।

ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর! অভিশাপের রাজনীতি এ উপমহাদেশকে বারবার আঘাত করেছে। বেনজির ভুট্টোর জীবনটা ছিল ভীষণ ট্র্যাজেডির। ভুট্টো পরিবারের ছেলেগুলোকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। বেনজির বারবার কারাভোগ করেছেন। আটক হয়ে লড়েছেন সেনাশাসনের বিরুদ্ধে। একদিন মুক্তি পেলেন। প্রধানমন্ত্রী হলেন। ক্ষমতা হারালেন। আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। কিন্তু ট্র্যাজেডি তাঁর পিছু ছাড়ল না। নিজের ভাইয়ের মেয়ে অভিযোগের আঙ্গুল তুললেন তাঁর দিকে। বেনজিরের ক্ষমতাকালে খুন হন তাঁর আপন ভাই মুরতুজা। ভাই-বোনের সম্পর্ক তখন ভালো ছিল না ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। আসিফ আলী জারদারি এ আগুনে আরও ঘি ঢালেন। ফাতিমা ভুট্টো তাঁর বাবার মৃত্যু নিয়ে আঙ্গুল তুললেন ফুফু বেনজিরের বিরুদ্ধে। কথা বলেন আসিফ আলী জারদারিকে নিয়ে। বেনজিরের শেষটাও করুণ। ক্ষমতার রাজনীতির হিসাব-নিকাশের চড়া দাম দিলেন বেনজির নিজেও। হত্যা আর খুনের রাজনীতি দেখতে দেখতেই তাঁকেও জীবন দিতে হলো। উপমহাদেশকে বারবার আঘাত করেছে রাজনীতির এ নিষ্ঠুরতা। রাজীব গান্ধীর হত্যা ও বাংলাদেশের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা সবকিছুর ধারাবাহিকতা। আমরা খুব সহজে অতীত ভুলে যাই। মনে রাাখি না অনেক কিছু। হিংসা-বিদ্বেষ আমাদের শেষ করে দিচ্ছে। অথচ নিয়তির নিষ্ঠুর খেলা কেউ ঠেকাতে পারেনি কোনো দিন। প্রকৃতির এটাই যেন নিয়ম।

লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন