আলমগীর আহমুদ


কলকাতার আলো বাতাসে গড়ে উঠা মানুষ ধীরাজ ভট্টাচার্য । বুকে প্রেম কর্মে ন্যায্যতার পারিবারিক শিক্ষা ধারণ করা সন্তান । টেকনাফ থানায় পোষ্ঠিং হয়ে আসে পুলিশ অফিসার হয়ে।

ভালবাসা আর শাসনের সোহাগেই কক্সবাজারবাসী ধীরাজের অবক্ষমূর্তি আজও স্মৃতি করে রেখেছে । টেকনাফ থানা সীমানা প্রাচীরে । থানার পাতকূপটিকে লালন করেছে শ্রদ্ধায় সন্মানে ! তাঁদেরই পরাণের মানুষ মাথিন ধীরাজের স্মৃতির কারনে ।

বৃটিশ শাসনে ভারতবর্ষ । কলকাতার মানুষ সেদিনের টেকনাফের পরিবেশে কথা বলা সময় কাটানো ছিল ভীষণ যাতনার । জঙ্গলাকীর্ণ অধিকাংশ এলাকা।

টেকনাফ থেকে নৌকা সাম্পানে উখিয়াঘাটে নেমে বালুখালী গাড়ি ষ্টেশনে এসে ( এটিই এতদঞ্চলের প্রাচীন গাড়ির ষ্টেশন) গাড়ীতে উত্তরমুখী বড় শহরে যাত্রা করতে হতো।

তখনও কক্সবাজার শহর হয়নি । রামু ছিল প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু । রামু চৌমুহনী হয়েই চট্টগ্রাম ঢাকা কলকাতার গাড়ীপথ ।

‘যে পরিবেশে নাই লক্ষী , সে যেন নীড়হারা পক্ষী’.. এমন দশায় ধীরাজ । কিছুই ভাল লাগতো না। মনে সদাই ছটফট । থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে শুধুই ভাবত ।

পানীয় জলের সংকট ছিল পুরো টেকনাফ জুড়ে । টেকনাফ থানার সামনের পাতকূপ (রিংওয়েল) থেকে প্রতিদিনই পানীয় জল ভরতে কলসী কাঁখে মাড়াইত একঝাঁক রাখাইন তরুণীর দল । দীর্ঘ এলাকায় পানীয় জলের একমাত্র কূপ ছিল এটি । এই কূপের জলেরও ছিল বেশ কদর ।

হঠাৎ একদিন সই পরিবেষ্ঠিত জমিদার কন্যা মাথিন হৈ হুল্লোড়ে কলসী ভরতে গিয়ে চোখে চোখ পড়ে যায় থানার বারান্দায় বসা সেই মানুষটির চোখে । দূ’জনেই বেশ বিব্রত , চোখ ফিরিয়ে নিলেও কেউ কারে পারছে না মন থেকে মুছতে । ঘুরে ফিরে দূ’ জনেই জাবর কাটছে সেই প্রথম দেখার।

দিনবদলে ধর্মের দেয়াল টপকিয়ে তাঁরা হয়ে উঠে একে অন্যের । বিনিময় হয়ে পড়ে মন দেয়া নেয়া । জমিদার ওয়াংথিনের কন্যা মাথিন– ধীরাজ যেন বাঁধা পড়ে বিনে সূঁতায়।

ধীরাজ অপেক্ষায় রইত বসে । কবে আবার সকাল হবে, মাথিন আসবে কলসী কাঁখে, উপহার দিবে ভালবাসার গোপন হাসি!

মাথিনও অপেক্ষার প্রহর গুণত । ক্ষণে ক্ষণে ঘুম ভেঙ্গে ভাবত এইবুঝি সকাল হল ! এইবুঝি সকাল হল ! রুটিনে হয়ে রয় সখীদের ঝাঁকে খুব ভোরে পাতকূপে । কাঁখে কলসী ।

প্রেম যখন ধর্মের দোহাই না মানা, না মানা রোমাণ্টিকতায় ! তখনই খবর পৌঁছে ধীরাজের বাবার কানে । ঠিক তখনই কলকাতা থেকে ধীরাজ টেলিগ্রাম পায় বাবার । ” তোমার মা’ অসুস্থ ছুটি যদি না মেলে চাকরী ছেড়ে এসো” ।

মনের মানুষের বিচ্ছেদে রইতে মাথিন নারাজ । সে কলকাতা যাবে সে মানতেই পারছে না। দাঁড়ায় বাঁধ হয়ে । উভয় সংকটে ধীরাজ । অবশেষে মাথিনকে না জানিয়ে সে রওয়ানা দেয় কলকাতা।

এ খবর মাথিনের কাছে পৌঁছতেই বিরহীব্যথায় পোঁড়তে রয় দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস । ভুলবুঝে ভাবতে রয় বিয়ের ভয়ে ধীরাজ গেছে পালিয়ে। মনে বাঁজে এককথা ধীরাজের সাথে আর হবে না দেখা আমার । বিরহকাতুরতায় মাথিন ছাড়ে খাওয়া নাওয়া । শেষ পরিনতি মৃত্যুই কপাল লিখন বনে মাথিনের ।

কলকাতা থেকে ফিরে ধীরাজ । মাথিনের এমন বিদায় শুনে ‘যার আর পর নাই’ এমন ব্যথায় ব্যথিত হয় । নাড়া পড়ে প্রেমিক হৃদয়ে । মানতে পারছে না মনে নেয়া মানুষটির এমন বিদায় ।

মনের চিতা জ্বলছে আর জ্বালছে ! এমন জ্বালানি নিয়েই ধীরাজ ফিরে কলকাতা । লিখেন আত্নজীবনীমুলক উপন্যাস ” “যখন আমি পুলিশ ছিলাম।” যেটি কলকাতায় স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি হয়ে কাঁদিয়েছে অগুনতি দর্শক হৃদয় ।

টেকনাফ থানার সেই পাতকূপটি ধীরাজ মাথিনের প্রেমের উপখ্যান করে রাখতে কক্সবাজারবাসী ডাকা শুরু করেন ‘মাথিনের কূপ’ । গুণায় আসে প্রেমের ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে।

লায়লী মজনু, শিরি ফরহাদ, মলকা মনু, চন্ডীদাস রজকিনী, মমতাজ শাহজানের প্রেমের মতো এক অমর কাহিনী হয়ে ধীরাজ মাথিনের প্রেম কাহিনীও স্থান নেয় ইতিহাসে। পায় অমরত্ব।

প্রতিবছর কক্সবাজারের

লাখও পর্যটক একনজর মার্থিনের কূপ দেখতে হুমড়ি খেয়ে আসে টেকনাফ থানার উঠোনে । কূপটির পাড়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়ে কয় “প্রেম জয়ী হউক যুগে যুগে !

“ধীরাজ মাথিন ” — “তোমরা রও অমর প্রেমের প্রেরণা “!

 


লেখক : বিভাগীয় প্রধান , সমাজবিজ্ঞান বিভাগ , উখিয়া কলেজ কক্সবাজার। alamgir83cox@gmail.com