– মোহাম্মমদ শহীদুল্লাহ

আমি শিক্ষক। আমি হতে চাই মহান। শিক্ষকতা পেশাই আমার মহান ব্রত। আমি এ মুহুর্তে সারদেশেই পরিচিত হয়ে ওঠেছি। প্রথম আলো পত্রিকায় আমাকে নিয়ে ফিচারদর্শী একটি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর। আমি শিক্ষকতা করি কক্সবাজারের শহরের একটি কলেজে। চলমান মহামারিকালের সূচনা হতেই আমি আমার শিক্ষাদানের কাজটি নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছি। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বব্যাপী যখন সবকিছু থেমে গেলো, আমিও কিছুটা থেমে যাইা। কিন্তু এভাবে থেমে থাকা কী চলে, আমার? আমাকে যে, ঘুমাতে যাওয়ার আগেও মাইলের পর মাইল হেঁটে চলতে হবে! এমন এক গুরু দায়িত্ব আমি নিয়ে আছি আমার ঘাড়ে যে, আমি কী ঘরে বসে থাকতে পারি? তাও আবার পদার্থ বিজ্ঞানের মতো বিষয় পড়াই আমি। যে বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে নিউটন, আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিংস-এর মতো মানুষও মাথা ঠিক রাখতে পারলেও, শরীর-মন ঠিক রাখতে সক্ষম রাখতে পারেন নি। আমি আমার শিক্ষার্থীদের থেকে দূরে থাকবো করোনা মহামারির বাহনায়, তা কী করে হয়?
আমি নেমে পড়ি, বিকল্প পদ্ধতিতে শ্রেণি পাঠদানের কাজে। অন-লাইনই এখন আমার শ্রেণিকক্ষ। আমি আমার মতো করে ভিডিও ক্লাশ তৈরি করে করে আপলোড করতে থাকি। একে একে অনেকগুলো ক্লাশ আমি ইউটিউবে আপলোড করে যাই। সারাদেশের সর্বস্তরে শিক্ষকগণ আমার মতো করে অন-লাইনকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানোতে নিজেদেরকে ব্যস্ত করে তুলেছেন। আমি উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক এবং মাস্টার্স লেভেলের শিক্ষার্থীদের পদার্থ বিজ্ঞান পড়াই। আমার বাড়ি দারুচিনি দ্বীপে। দ্বীপদেশের মানুষ হলেও, আমি চাই আইন স্টাইনের মতো হতে। চাই, স্টিফেন হকিংস হতে না পারলেও প্রফেসর ড. জামাল নজরুলের মতো হতে। তাঁরা নিরবে-নিবৃতে পদার্থ বিজ্ঞানের সব শাখায় বিচরণ করতে করতে পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা আমার মতো ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রবেশাধিকার পেলে, অনেক বেশি কিছু করতে পারতেন বলে আমার ধারণা। আমি একবিংশ শতাব্দির মানুষ হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, তা নিউটন, আইন স্টাইন ও হকিংস পান নি। আবার জামাল নজরুল ইসলাম ক্যাম্ব্রিজের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে এসে পড়েছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি দেশ মাতৃকার টানেই চলে এসেছিলেন। আমি বলতে পারেন, মার্কিন প্রবাসী সালমান খানের অনুসারি। সালমান খান খান একাডেমীর প্রতিষ্ঠা করে ভিডিও ক্লাস উদ্ভাবনের মাধ্যমে সে দেশে বেকার যুবক হতে এখন বিলিয়ন ডলারের মালিক। আমি হয়তো আমার দেশের কলেজে মাস্টারি করে করে সালমান খান বা যাদের নাম লিখলাম, তাঁদের মতো কখনও হতে পারবো না। কিন্তু আমার দেশে ভিডিও ক্লাশ চালিয়ে আমি সেরাদের তালিকায় ইতোমধ্যে নাম উঠিয়ে নিয়েছি। প্রথম আলো পত্রিকা আমাকে বিখ্যাত বানিয়ে দিয়েছে। আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেলো। পিছনে থাকানোর সুযোগ নেই, আমার। আমি আমার মতো করে আমার কাজটি চালিয়ে যেতে চাই। এক্ষেত্রে সবার দোয়া চাই। আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং আমার শিক্ষার্থীরা; আমি ও আমার সহকর্মীগণের ব্যাপারে কে কী বলেছেন, পড়ে দেখুন;…“ তাঁরা ২০ মার্চ থেকে কলেজটির
( সিটি কলেজ, কক্সবাজার) প্রায় ২০০ শিক্ষক অনলাইন ক্লাস শুরু করেন। গত চার মাসে তাঁরা হাজারের বেশি অন-লাইনে ক্লাস নেন। এর মধ্যে কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম একাই সম্পাদন করেন ১৬৮টি ক্লাস। ২৪ মার্চ থেকে তিনি ক্লাস শুরু করেন। আজ সোমবারও তিনি দুটি ক্লাস নেন। জাহাঙ্গীর আলম পদার্থ বিজ্ঞানের একাদশ, দ্বাদশ ও সম্মান শ্রেণির ১ম ও ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের অন-লাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিনি ১৫৩টি অনলাইন ক্লাসের ভিডিও বিভিন্ন পেজে আপলোড করেছেন। অন-লাইন ক্লাসগুলোর ভিডিও কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অনলাইন গ্রুপ (Cox’sbazar city college), অনলাইন পেজে (Department of Physics-Cox’s Bazar City College) পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি একই ভিডিও ইউটিউব চ্যানেল (PLARCBD), জেলা প্রশাসনের অনলাইন পেজ (DC Cox’s Bazar), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন পেজ (Online Classroom in National University, Bangladesh) এবং অনলাইন গ্রুপ (Online Classroom in National Univercity, Bangladesh (Group), বদরখালী ডিগ্রি কলেজ-অনলাইন পেজে প্রতিনিয়ত আপলোড হচ্ছে।
শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২৪ মার্চ থেকে তিনি কলেজের একটি কক্ষ থেকে অন-লাইন ক্লাস পরিচালনা করছেন। ২৭ জুলাই পর্যন্ত ১৬৮টি ক্লাস সম্পাদন করেছেন। এর মধ্যে ১৫৩টি অনলাইন ক্লাসের ভিডিও বিভিন্ন অনলাইন পেজে আপলোড দিয়েছেন। ইতিমধ্যে কলেজের ৩০০ শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন কলেজের অন্তত ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী ভিডিওগুলো সংগ্রহ করে শিক্ষার উন্নতি ঘটাচ্ছেন। কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং বলেন, করোনা মহামারিতেও টানা চার মাসে একাধারে ১৬৮টি অন-লাইন ক্লাস করে শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম নজির স্থাপন করেছেন। শিক্ষকতার মহান পেশাকে তিনি সমুজ্জ্বল রেখেছেন। তাঁর মতো এত বেশিসংখ্যক অনলাইন ক্লাস নেওয়ার নজির দেশে সম্ভবত অন্য কোনো শিক্ষকের নেই। কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্র আলীরজাহাল এলাকায় সবুজ অরণ্যে ঘেরা সিটি কলেজের অবস্থান। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজের শিক্ষার্থী ১২ হাজারের বেশি। শিক্ষক আছেন ২০৫ জন। সম্প্রতি কলেজে গিয়ে দেখা যায়, পুরো ক্যাম্পাস ফাঁকা। তবে ব্যস্ত সময় পার করছেন অধ্যক্ষ ক্য থিং অং। কলেজের বিভিন্ন কক্ষে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকেরা। অধ্যক্ষ ঘুরে ঘুরে সেসব ক্লাসের তদারক করছেন। একটি কক্ষে গিয়ে দেখা যায় জাহাঙ্গীর আলমকে। তখন তিনি সম্মান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস নিচ্ছিলেন।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, করোনা মহামারিতে সবাই হোম কোয়ারেন্টিনে। কিন্তু তাঁরা (শিক্ষক) ঘরে বসে থাকতে পারছেন না। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রতিদিন একাধিক ক্লাস নিতে হচ্ছে। অনলাইনে যেসব শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকতে পারছে, তারা উপকৃত হচ্ছে। নানা কারণে যেসব শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস ধরতে কিংবা অংশ নিতে পারছে না, তাদের জন্য ক্লাসের ভিডিও আপলোড করে দেওয়া হচ্ছে। পেজ থেকে ভিডিও নামিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী ভিডিও সংগ্রহ করেছে। কলেজের পদার্থবিদ্যা সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জাহেদুল ইসলামের বাড়ি শহরের বাহারছড়া এলাকায়। তিনি নিয়মিত অনলাইন ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন। জাহেদুল বলেন, তাঁর অনেক বন্ধু অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেন না। ইন্টারনেট দুর্বলতা কিংবা বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে এটা হচ্ছে। তিনি ক্লাসের ভিডিও বন্ধুদের কাছে পাঠান। এতে বন্ধুদের উপকার হচ্ছে। একই বিভাগের আরেক ছাত্র সাইফুদ্দিন রাজের বাড়ি রামু উপজেলায়। সাইফুদ্দিন বলেন, সারা দিন তিনি বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাতে শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের অনলাইন ক্লাসের ভিডিও দেখেন। এভাবে অন্য কলেজের শিক্ষার্থীরাও পাঠ নিতে পারছেন।
গত ৩০ জুন দেশের ১০০ জন শিক্ষকের সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন আর রশিদের জুম কনফারেন্স হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোনাজ আহমেদ নুর। সভায় অন্য শিক্ষকদের তুলনায় অধিক অনলাইন ক্লাস সম্পাদন করায় জাহাঙ্গীর আলমের ভূয়সী প্রশংসা করেন উপাচার্য হারুন অর রশিদ ও মোনাজ আহমেদ নুর। কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং বলেন, প্রভাষক জাহাঙ্গীর আলম একজন সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ, পরিশ্রমী মানুষ। তিনি একজন শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক। করোনাকালে তাঁর অনলাইন ক্লাসগুলো সারা দেশের হাজারো শিক্ষার্থীর উপকারে আসছে। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অধ্যক্ষের তাগিদ না থাকলে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হতো না। করোনাকালে যেখানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, সেখানে অধ্যক্ষ তাঁদের ঘর থেকে ধরে এনে শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করছেন। দেবদূতের মতো তিনি লেগে না থাকলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় অনেক পিছিয়ে পড়ত। ৭ জুলাই থেকে অধ্যক্ষের নির্দেশনায় কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অনলাইন পরীক্ষাও শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে ১০টি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে।. ’’
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকগণই অন-লাইন ক্লাস পরিচালনায় খুব বেশি সক্রিয়। এ ব্যাপারে অন-লাইন ক্লাসের উপকারিতা, করোনা মহামারিরকালে প্রাথমিক স্তরের শিশু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থমকে যাওয়া এবং দেশের সার্বিক চিত্র বর্ণনা করে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি চমৎকার প্রতিবেদন পাকাশিত হয়েছে। আমি প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে কাজ করি। দেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় আমরা কক্সবাজার জেলায়ও চেষ্টা করছি, অন-লাইন ভিত্তিক শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম চালু করার মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশোনার মধ্যে ব্যস্ত রাখতে। চকরিয়া উপজেলা এবং টেকনাফ উপজেলা এ ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগামি ভূমিকা নিয়েছে। আশা করবো; অন্য ৬টি উপজেলার শিক্ষকমন্ডলীও বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়ে অচিরেই কাজ শুরু করে দেবেন। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টটি এখানে সংযোজন করে দিচ্ছি;…..
“কোটি শিশুর পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে (মোশতাক আহমেদ, ঢাকা):
পোশাক শ্রমিক মায়ের কারখানায় কাজ শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে বাবার রিকশা সচল হচ্ছে। শুধু ছোট্ট মোহনা আক্তার পড়ালেখা ভুলতে বসেছে। এক ঘরে গাদাগাদির বাসায় টিভির ক্লাসে মন বসানো কঠিন। ইদানীং স্কুলের শিক্ষক মুঠোফোনে খোঁজখবর নিচ্ছেন। মা-ও কষ্টে-সৃষ্টে বেতন দিয়ে পাড়ার এক খালার কাছে পড়তে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু করোনার চার মাসে হাজারীবাগ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনায় যেমন শেওলা জমেছে, মোহনার পড়ার অভ্যাসেও তেমনি ছাতা পড়েছে। মা তানিয়া বেগম মুঠোফোনে বললেন, ‘বাচ্চা মানুষ তো, স্কুল বন্ধ থাকলে পড়তে চায় না।’সরকার টিভিতে প্রাথমিকের ক্লাস দেখাচ্ছে ৭ এপ্রিল থেকে। তবে খাগড়াছড়ি সদরের দক্ষিণ খবংপুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে ছেলেমেয়েরা পড়ে, তাদের অনেকের বাসায় টিভি নেই। কিছু বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। প্রধান শিক্ষক বিজয়া খীসা বললেন, এমন অভিভাবকও আছেন, যাঁরা দিন এনে দিন খান। কারও বা মুঠোফোন নেই। তিনি নিজে অনেক ছেলেমেয়েকে খাতা-কলম আর সাবান কিনে দিয়েছেন। বগুড়ার সাজাপুর ফুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ালেখায় দুর্বল এবং দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা একেবারেই বসে পড়েছে। ঢাকার রায়েরবাজারে রাজমুশুরী সরকারি প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষকের ক্লাসের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী গ্রামে চলে গেছে। ফিরবে, এমন আশা নেই। এ কথা কে না জানে, দুর্যোগে সব রকম সুযোগ সবচেয়ে বেশি খোয়ায় দুর্বলজনেরা। করোনাকালে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার হাল জানতে গিয়ে কথাটির অর্থ পরিষ্কার হলো। স্কুলগুলোতে তালা। বাড়িতে পড়ানোর মতো কেউ নেই। অনলাইন নাগালের বাইরে। ছেলেমেয়েদের বড় অংশই গরিব পরিবারের। করোনাকালে অভাব বেড়েছে, ঠাঁই নড়েছে। গত মে মাসে ব্র্যাকের একটি জরিপ দেখেছে, ১৬ শতাংশ শিশু আতঙ্কে ভুগছে। এভাবে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়া প্রায় সোয়া কোটি শিশুর অনেকে লেখাপড়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। গত দুই দশকের শিক্ষার অর্জন গোল্লায় যেতে বসেছে।গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনার ছুটি চলছে। আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত ছুটির ঘোষণা আছে। তবে শিক্ষা প্রশাসনের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা আভাস দিলেন, গোটা মাসটাই বন্ধ থাকবে। তারপর করোনার অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত হবে। স্কুল খুলবে সবার শেষে। সেগুলোর ছুটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত গড়াতে পারে। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়াদের পড়াশোনা মুখ থুবড়ে পড়ার ঝুঁকিটা আরও বড় হচ্ছে। অথচ সেটা ঠেকানোর কার্যকর উদ্যোগ নেই। তিন মাস পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলো শুধু সংসদ টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ক্লাসের ভরসায় থেকেছে। গত ২৮ জুন সরকার জেলায় জেলায় শিক্ষকদের বলেছে মুঠোফোনে ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার তদারকি করতে। বাসায় টিভি যদিবা থাকে, সম্প্রচারিত রেকর্ড করা ক্লাসগুলো গৎবাঁধা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মে মাসের জরিপটি দেশের ৮ বিভাগের ১৬ জেলায় করা। সেটা বলছে, ৫৬ শতাংশ ছেলেমেয়ে টিভির ক্লাসে আগ্রহ পায় না। দু-একটি জেলার শিক্ষা প্রশাসন ইউটিউব আর ফেসবুকে রেকর্ড করা ক্লাস তুলে দিচ্ছে। দেশজুড়ে অনেক শিক্ষক নিজেরাও তা করছেন। সরকারি কিছু বড় স্কুল অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। তবে অনলাইনে দেখার সুযোগ-সামর্থ্য সবার নেই। এখন বাংলাদেশ বেতার ও কমিউনিটি রেডিওতে ক্লাস প্রচারের তোড়জোড় চলছে। এ ছাড়া ‘এডুকেশন হেল্পলাইন’ খোলার জন্য শিক্ষকদের ডেটাবেইস তৈরি হচ্ছে। হেল্পলাইনে ফোন করে শিক্ষার্থী বিনা খরচে তার পছন্দের শিক্ষকের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ প্রথম আলোকে বললেন, প্রাথমিকের ছেলেমেয়েরা ক্লাসের বাইরে পড়তে অভ্যস্ত নয়। তারপরও এসব করার উদ্দেশ্য, পড়ালেখার চর্চাটা যেন টিকে থাকে। মুঠোফোনে তদারকির কর্মসূচিতে শিক্ষকেরা অভিভাবকের ফোনে কল দিয়ে সপ্তাহে একবার শিক্ষার্থীর পড়ার খোঁজ নেন, পড়া দেন আর টিভির ক্লাস দেখতে বলেন। তবে শিক্ষকেরা বলছেন, অনেক সময় ফোন বন্ধ থাকে। এমনিতেও সপ্তাহে এক দিনে কতটুকুই-বা হয়! নোয়াখালী সদর উপজেলা কৃপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ সামসুদ্দিন মুঠোফোনে বললেন, তাঁদের ২০১ জন ছাত্রছাত্রীর অনেকে দরিদ্র। সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না। তারা টিভির ক্লাসও খুব একটা দেখে না। গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনার ছুটি চলছে। ছবি: প্রথম আলোশিক্ষকেরা ফোনে আলাপের সাপ্তাহিক বিবরণ প্রধান শিক্ষকের কাছে জমা দেন। তিনি স্কুলের প্রতিবেদন পাঠান স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি আবার তা জেলায় পাঠান। নজরদারি হচ্ছে, তবে পর্যালোচনা হচ্ছে কই? টিভির ক্লাসগুলোর কার্যকারিতা খতিয়ে দেখা হয়নি। স্বেচ্ছাসেবী আর এনজিও পরিচালিত যেসব স্কুল অনলাইনে পড়াচ্ছে, তাদের পদ্ধতিগুলো পর্যালোচনা করে পথ খোঁজারও কোনো চেষ্টা নেই। অথচ প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশই পড়ে সরকারি স্কুলে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেস) হিসাবে তাদের সংখ্যা ১ কোটি ১৫ লাখের মতো। স্কুলের সংখ্যা ৬৬ হাজারের কাছাকাছি।…..
……১৩ জুলাই দুপুর। পুরোনো ট্যানারি এলাকার কাছে হাজারীবাগ বালিকা সরকারি বিদ্যালয়ের ফটকে তালা ঝুলছে। আশপাশের দোকানিরা বললেন, মাঝেমধ্যে দু-একজন শিক্ষক আসেন। তখন তালা খোলে। উল্টো দিকে পটুয়াখালীর বাউফলের ছেলে তুহিনের মুঠোফোনের দোকান। তাঁর এখানে ১৭ বছরের ব্যবসা। বললেন, স্কুলের শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগই শ্রমজীবী পরিবারের। তাঁর ভাইয়ের মেয়ে ইসরাত জাহান এখানে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ভাই কাজ করেন ট্যানারিতে। ভাতিজি বাসায় একা একা যতটুকু পারে পড়ে। পড়া বিশেষ হয় না। তুহিন বলেন, কী আর করা! এদিকে প্রধান শিক্ষক এস এম ছায়িদ উল্লা একজন কর্মচারীর হাতে স্কুলের চাবি দিয়ে পাঠালেন। একই উঠান লাগোয়া ভবনে ছেলেদের প্রাথমিক স্কুল। ভবনের কলাপসিবল গেটেও তালা ঝুলছে। মাঠ নেই। একটুকরা আঙিনায় শেওলা পড়েছে। এক পাশে আগাছা গজিয়েছে। প্রধান শিক্ষক মুঠোফোনে বললেন, উপবৃত্তি বিতরণ বা অন্য কোনো কাজ থাকলে স্কুলে যান। নয়তো নয়। মোহনা এই স্কুলেরই প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। কাছেই কালুনগরে তাদের এক ঘরের ভাড়া বাসা। পোশাকশ্রমিক মা আর রিকশাচালক বাবা দুজনই সারা দিন বাইরে থাকেন। মায়ের মুঠোফোনে সে বলল, অল্প দিন হলো বিকেলে প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলছেন, শিক্ষকেরা ক্লাস রেকর্ড করে স্কুলের নামে খোলা ফেসবুক পাতাতেও দিচ্ছেন। সব শিক্ষার্থী অবশ্য সেগুলো দেখতে পারে না। এখন উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দেওয়া হয়। প্রায় সব অভিভাবকের এখন মুঠোফোন আছে। তবে ক্লাস দেখতে চাই স্মার্টফোন। প্রধান শিক্ষক ছায়িদ উল্লার মতে, সরকার ইন্টারনেট ডেটা জোগালে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া সম্ভব। তবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কারও ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন না থাকলে বিনা মূল্যে দিতে হবে। ছাত্রীদের জন্য এক হাজার টাকা করে মাসিক বৃত্তিও দরকার। ঈশ্বরগঞ্জের হারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০৩ জন ছেলেমেয়ে পড়ে, শিক্ষক আছেন ছয়জন। সহকারী শিক্ষক মো. আমিনুল হক বললেন, টিভির ক্লাস বাচ্চারা দেখতে চায় না। উপজেলায় অনেক শিক্ষক ফেসবুকের পাতায় ক্লাস তুলে দেন। কিন্তু অনেকেরই নাগালে স্মার্টফোন নেই। খাগড়াছড়ি সদরে পাহাড়ের কোলে দক্ষিণ খবংপুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষার্থী আছে ৬০ জন। প্রধান শিক্ষক বিজয়া খীসা বললেন, টিভি আছে হয়তো ৬০ ভাগের বাসায়। প্রথম দিকে বাচ্চাদের আগ্রহ ছিল। এখন আর নেই। গ্রামটিতে দরিদ্র মানুষই বেশি। প্রধান শিক্ষক বললেন, ছেলেমেয়েরা কাছাকাছি থাকে। তিনি নিজেই খোঁজখবর রাখছেন। তবে পড়াশোনার সমস্যা তো হচ্ছেই।করোনার কারণে স্কুলগুলোতে তালা।
ঝরে পড়ার অশনি সংকেত
ঢাকার রায়েরবাজারে রাজমুশুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বয়স ১৫০ বছর। ১৩ জুলাই স্কুলটিতে গিয়ে দেখা গেল বন্ধ। একটি বেসরকারি সংস্থার ফেলোশিপের অংশ হিসেবে দুই বছরের জন্য এই স্কুলে পড়াচ্ছেন সেঁজুতি শোণিমা। মুঠোফোনে সেঁজুতি জানালেন, স্কুলটিতে মোট শিক্ষার্থী ৫৭০ জন। শিক্ষক আছেন ১৪ জন। তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ান। ক্লাসের ৬১ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছেন। ১৪ জুলাই সেঁজুতি বললেন, এ মুহূর্তে তাঁর ৪১ জন ছাত্রছাত্রী ঢাকায় আছে। বাকিরা পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। ফোনে কথা বলে জেনেছেন, দু-একজন বাদে বাকিদের ঢাকায় ফেরার সম্ভাবনা নেই।সেঁজুতির ভয়, এই বাচ্চারা ঝরে পড়বে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০০৫ সালে প্রাথমিকে পড়ুয়াদের ৪৭ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার আগেই ঝরে পড়ত। সরকারি-বেসরকারি চেষ্টায় এই হার ১৮ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু এখন আবার তা বাড়তে পারে। বিশ্বজুড়েই স্কুল থেকে বাচ্চাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক গবেষণা বলছে, করোনার পর বিশ্বের প্রায় এক কোটি শিশু স্কুলে ফিরবে না। শিক্ষা তহবিল কাটছাঁট হওয়া এবং দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার কারণে তারা ঝরে পড়বে। বগুড়ার সাজাপুর ফুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জুলফিকার আলী প্রামাণিকের ভয়, তাঁর ১৪২ জন ছাত্রছাত্রীর অনেকে ঝরে পড়বে। সমস্যা বেশি হবে দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের। বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান গত এপ্রিল-মে মাসে শিক্ষাসংকটের ওপর একটি জরিপ করেছে। শিক্ষা নিয়ে কাজ করা ১১৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ১১টি শিক্ষক সংগঠন এতে অংশ নেয়। জরিপটি বলছে, ঝরে পড়া বাড়তে পারে। বাড়তে পারে অনিয়মিত উপস্থিতি, শিশুশ্রম আর বাল্যবিবাহও।আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত স্কুল ছুটির ঘোষণা আছে।
পড়ালেখায় ধরে রাখা
সংসদ টিভিতে সিলেবাস ধরে ক্লাস প্রচারিত হচ্ছে। সব কটি বিকল্প উদ্যোগই মূলত ক্লাসকেন্দ্রিক। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হয়নি। প্রথম সাময়িকী পরীক্ষা হয়নি। আগস্টে দ্বিতীয় সাময়িকী পরীক্ষাও হওয়ার আশা কম। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফসিউল্লাহ প্রথম আলোকে বললেন, ‘আগে পড়াটা শেষ হোক না! পরীক্ষার কথা পরে দেখা যাবে।’ আগামী নভেম্বরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং এরপর বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার কথা। অধিদপ্তরের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, প্রথমটি পাবলিক পরীক্ষা। সিদ্ধান্ত নেবে সরকারের উচ্চপর্যায়। তবে এ বছর বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদের মতে, এ সময় মাধ্যমিকের আগের দুটি পাবলিক পরীক্ষাই স্থগিত রাখলে বিরাট কোনো ক্ষতি হবে না। বরং আগামী দুই থেকে তিন বছরের প্রধান কাজ হবে, সব শিক্ষার্থীকে স্কুলে ফিরিয়ে এনে নিয়মিত ক্লাসে ধরে রাখা। অধ্যাপক মনজুর বলেছেন, শিক্ষার্থীদের পড়ার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে। বেশি পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের বাড়তি সহায়তা লাগবে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের আস্থা ধরে রাখতে হবে। পরিকল্পনা পোক্ত না হলে সবই ভেস্তে যাবে।সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়াদের পড়াশোনা মুখ থুবড়ে পড়ার ঝুঁকি বড় হচ্ছে। ……
করোনা মহামরি চলাকালে মরার উপর খড়ার ঘা‘য়ের মতো দেশের ৩৮টি জেলা বন্যায় ভাসছে। এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন পড়ে দেখুন……..

বন্যায় ৮১ লাখ শিক্ষার্থী বিপদে (ইফতেখার মাহমুদ, ঢাকা):
যমুনার ভাঙনে হুমকিতে ঘরবাড়ি। তাই বসতঘর ভেঙে নৌকায় তুলে বাঁধের ওপর সরিয়ে নিচ্ছেন গ্রামবাসী। গত শনিবার বিকেলে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার আউচার পাড়া এলাকায়। ছবি: সোয়েল রানাচরাঞ্চলের বাতিঘর নামে পরিচিত মাদারীপুরের শিবচরের বন্দরখোলা এলাকার এসইএস ডিপি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনটি পদ্মায় বিলীন হয়েছে এক সপ্তাহও হয়নি। ২০০৯ সালে বিদ্যালয়ে যখন পাঠদান শুরু হয়, তখন পদ্মা নদীর সীমানা ছিল প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। ২০১২ সালে বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। এই বিদ্যালয়ে ২৪টি গ্রামের প্রায় ৩০০ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করত। এই শিক্ষার্থীদের এখন কী হবে, জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. আফজাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নদী থেকে চার কিলোমিটার দূরে নতুন একটি জায়গা ঠিক করা হয়েছে। সেখানে স্থানীয় একজন দানবীর জমি দিতে চেয়েছেন। ওই জমিতে বিদ্যালয় ভবন করে দিতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে।..
কিন্তু ভবনটি নির্মাণের সময় তো নদী থেকে চার কিলোমিটার দূরে ছিল, এই প্রশ্নে আফজাল হোসেন বলেন, এখানে জমির দাম অনেক। এত বড় স্কুলের জন্য কে এত বড় জমি দেবে?
এর আগে গত বছরও বন্দরখোলা এলাকার তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পদ্মায় বিলীন হয়েছিল। শুধু পদ্মা নয়, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা থেকে শুরু করে যমুনা অববাহিকায় বন্যার পানি ও ভাঙনে মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে দেশের ৩০ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের বই, খাতা, পেনসিল, কলমও ভেসে গেছে। করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এমনিতেই শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এখন শিক্ষা অবকাঠামো ও উপকরণও হুমকির মুখে পড়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘ এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলো যৌথভাবে দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ১ হাজার ৯০২টি বিদ্যালয় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮১ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। আর বই, খাতা, কলম, পেনসিলসহ শিক্ষা উপকরণ ভেসে গেছে ১০ লাখ শিক্ষার্থীর। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে রংপুর বিভাগে, ৭৬২টি। এরপর সিলেট বিভাগে ৬৩৫টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৪৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে গত মার্চ থেকে বন্ধ থাকা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ খুব একটা হয়নি। বন্যার সময়ে ভবনগুলো রক্ষার জন্য বরাদ্দও ছিল সীমিত। আবার শিক্ষার্থীদেরকেও এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করা হয়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আকরাম–আল–হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী দুটি বড় স্কুল ভবন পুরোপুরি নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর এসব ভবনকে দ্রুত কীভাবে মেরামত ও ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, সেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সরকারিভাবে ভাঙনের পূর্বাভাস এবং ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে দেওয়ার পরও নদীর কাছাকাছি কেন এত বড় ভবন করা হয়, এই প্রশ্নে আকরাম–আল–হোসেন বলেন, নদীতীর ও চর এলাকাতেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। তা না হলে সেখানকার শিক্ষার্থীরা কোথায় পড়বে। নদীর চার কিলোমিটার দূরে ভবন নির্মাণ করার পরও রক্ষা পেল না। তবে ভবিষ্যতে এসব এলাকায় আর প্রথাগত উপায়ে ভবন নির্মাণ করা হবে না। ভাঙন ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় কী ধরনের ভবন টেকসই হবে, তার দুটি নকশা নিয়ে কাজ চলছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বন্যাকবলিত এলাকায় এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬০৩টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন। বন্যায় এ পর্যন্ত ৩১টি জেলায় ৪৭ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার পানি নেমে গেলে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো সংস্কারের কাজ শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে যেসব শিক্ষার্থীর শিক্ষা উপকরণ ভেসে গেছে বা নষ্ট হয়েছে, তাদের সহায়তা দিতে হবে। যাতে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। একই সঙ্গে তাদের উপবৃত্তির টাকা বাড়িয়ে দেওয়া যায় কি না, সেটি ভাবতে হবে। এমনকি উপবৃত্তির টাকা অগ্রিম দেওয়া যায় কি না, সেটিও ভাবতে হবে।
পানি নামতে আগস্টের মাঝামাঝি লেগে যাবে
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের প্রধান দুই অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মায় বন্যার পানি নামতে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেগে যাবে। আগামী দু–এক দিনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার উজানে বৃষ্টি বেড়ে আরেক দফা বন্যার ঢল আসতে পারে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আবারও অবনতি হতে পারে।
ফারহান ইশরাকআহা আমার ক্যাম্পাসের বৃষ্টি
ফারহান ইশরাক, শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সকাল সাতটা। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। গত সপ্তাহ থেকে প্রতিদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির পানি এসে পড়ল। চায়ের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও তাই হজম করতে হলো। আশপাশের রাস্তায় কেউ নেই, থাকার কথাও না। রাস্তাটা আজকাল নীরবই থাকে। অবশ্য বর্ষার দিনগুলোই এমন। বিষণ্ন, স্মৃতিকাতরতায় ভরপুর। অনেক দিন পর ছেলেবেলার মতো এ বছরের বৃষ্টির দিনগুলোও ঘরে বসেই কাটছে।
গত বছরের বর্ষাও কেটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। সেবার জুন মাসে ছিল সেমিস্টার ফাইনাল। ঈদুল ফিতরের অল্প কয়েক দিন পরই তাই হলে ফিরতে হলো। তখন ক্যাম্পাস একদম ফাঁকা, দু–চারটি বিভাগ ছাড়া প্রায় সবার ঈদের ছুটি চলছে। বিশাল ক্যাম্পাসে অবসর সময়গুলো তাই একা একাই কাটত। আর সেই নির্জনতার ভিড়ে বন্ধু ছিল বর্ষার এই বৃষ্টি।
বিকেলে, সন্ধ্যায় একটু দমকা হাওয়া উঠলেই চলে যেতাম হলের ছাদে, কখনোবা মাঠে। মাঝেমধ্যে ফুলার রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টি নামত। আবার কোনো কোনো দিন কাটত ভীষণ ঘুমে। সকালে উঠেই দেখি বৃষ্টি, সঙ্গে ঘন কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে আবরণ চারদিকে। বিছানা ছাড়তে মন চায় না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়, কিন্তু বৃষ্টি থামে না আর। ঘুম থেকে উঠে হলের দোকানে ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি খেয়ে আবার ঘুমাতে যাই, শরীর-মন সারা দিন থেকে যায় অবসন্ন। ক্যাম্পাসের বর্ষার স্মৃতিগুলো এমনই। শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে বসে চা খেতে খেতে কিংবা টিএসসির মাঠে ভিজতে ভিজতে কখন যে গত বর্ষা চলে গিয়েছে টেরও পাইনি। এবারের বর্ষাটা বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
এখন একই শহরে, পাশাপাশি বাসায় থেকেও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ নেই। কয়েক বাসা পরেই করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে, দুশ্চিন্তাও মাথাচাড়া দিচ্ছে খুব বেশি। বদ্ধ জীবনে বই, সিনেমা আর অনলাইন আড্ডাই একমাত্র সঙ্গী। শুরুর দিকে সঙ্গটা ভালোই লাগছিল, এখন বিরক্তিকর ঠেকছে সব। এক জিনিস দীর্ঘদিন কারই বা ভালো লাগে। কিছু করারও নেই। বন্ধুদের সঙ্গে পুরোনো দিনগুলোর কথা ভেবেই তাই দিন পার করে দিই। রুটিনবিহীন হলজীবন, ক্লাস শেষে শ্যাডোর আড্ডা, ব্যস্ততম মধুর ক্যানটিনে স্লোগানে গলা মেলানো, রাতভর সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি, ঘুরেফিরে সব আলোচনারই সারবস্তু এই ক্যাম্পাসজীবন। যেখানে নিত্যদিনের বিচরণ, ভালো লাগা, খারাপ লাগার স্মৃতি মিশে আছে, সে প্রাঙ্গণ ছেড়ে এত দিন থাকতে হবে, কিংবা থাকলেও যে বারবার এই ক্যাম্পাসের কথা এত বেশি মনে পড়বে, বোধ হয় কেউ ভাবেনি।
সব সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপগুলোতে ক্যাম্পাসের ছবি খুঁজে ফিরি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় সাড়ে তিন শ কিলোমিটার দূরে আছি। তারপরও প্রতিদিনই জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে আমার চেনা চত্বর? কেমন আছে রাতের কার্জন হল কিংবা শেষ রাতের ডিএমসির সামনের খাবারের দোকানগুলো? কেমন আছে রাতজাগা ভীষণ আলোকিত বিজনেস ফ্যাকাল্টি কিংবা মুহসীন হলের ছোট্ট বাগানটি? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো যেন ক্যাম্পাসের ছবিগুলোর মধ্যেই খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। কেউ কোনো কাজে ক্যাম্পাসের দিকে গেলেই বলি ছবি তুলে পাঠাতে। দূরে থেকেও মনে হয় কাছাকাছি আছি, ক্যাম্পাসেই আছি।
জানি না কবে সবার ফেরা হবে। অনেকেই হয়তো ফিরবে না, কত কিছু বদলে যাবে। কিন্তু তারপরও এই যে একটা অদৃশ্য সুতায় বাঁধা পড়ে আছি, এ এক অদ্ভুত মায়া। তাই এত দূর থেকেও ক্যাম্পাসের ছবিগুলো দেখলেই মনের অজান্তে বলে উঠি, ভালো থেকো টিএসসি, ভালো থেকো হাকিম চত্বর, ভালো থেকো কার্জন হল আর ভালো থেকো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জাকিয়া হোসেনশুধু দিন গুনছি
জাকিয়া হোসেন, ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা

চারদিকে আতঙ্ক, বিষণ্নতা, হাহাকার দেখি। প্রতিটা মুহূর্ত এক অনিশ্চয়তায় কাটছে। প্রতিটি ভোরই সৃষ্টিকর্তার কৃপা। তবু আশা হারাইনি। একদিন আবার একটা সোনালি ভোর আসবে, সেই ভোরে আমরা নতুন দিনের স্বপ্ন দেখব। আবার ফিরব প্রিয় আঙিনায়, প্রিয় ক্যাম্পাসে। তত দিনে ক্যাম্পাসের গাছগুলোও নিশ্চয়ই সবুজে সবুজে ভরে উঠে আমাদের স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় থাকবে। কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো তার লাল রঙে রাঙিয়ে দেবে চারপাশ। আমাদের আড্ডায়, কোলাহলে ক্যাম্পাস ফিরে পাবে তার প্রাণশক্তি।
জানি প্রিয় ইডেন কলেজ আজ আমার মতোই ভালো নেই। আমাদের শূন্যতা নিশ্চয়ই সেও তীব্রভাবে অনুভব করছে। বান্ধবীদের সঙ্গে শেষ আড্ডাটা এখনো মনে পড়ে। সেদিন অনেকের সঙ্গে দেখা না হওয়ার কষ্টের পাশাপাশি অপ্রত্যাশিত ছুটি পেয়ে কিছুটা আনন্দও হয়েছিল। নিজের জন্য সময় পাচ্ছি, অনেক পরিকল্পনাও করতে শুরু করেছিলাম। করোনাকালীন এই বন্দিজীবনে একটু সুন্দর সময় কাটানোর জন্য প্রিয় বই পড়ি, সিনেমা দেখি, ছবি আঁকি। বাংলা সাহিত্য আমার আগ্রহের জায়গা। তাই এই বিরতিতে বাংলা সাহিত্যের বিপুল ভান্ডারের লেখক ও তাঁদের লেখনীর সঙ্গে একটা যোগসূত্র করার চেষ্টা করছি। তবু কোথাও কেন যেন উচ্ছ্বাস নেই, প্রাণ নেই। শুধু মনে হয়, মনে মনে আসলে আমরা সবাই শুধু দিন গুনছি। আমরা আমাদের সেই ব্যস্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। যেখানে একটানা বোরিং ক্লাস, প্র্যাকটিক্যাল, অ্যাসাইনমেন্টের চাপে ক্লান্ত হব। কিন্তু ক্যানটিনের ফুচকা, ভেলপুরি বা পুকুরপাড়ের চায়ের আড্ডায় আমাদের ক্লান্তি দূর হবে। আমরা ছুটে বেড়াব ক্যাম্পাসের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। পুরোনো দিন ফিরে পাব কি না জানি না, নতুন দিনের স্বপ্ন তো দেখতেই পারি।
দেবাশীষ রনিকরোনাকালের ভালোবাসা
দেবাশীষ রনি, গণিত বিভাগ, সরকারি এমসি কলেজ, সিলেট

স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে আছি প্রায় ১০০ দিন পেরিয়ে গেল। আমি ছবি তুলতে ভালোবাসি। শখের বশে ছবি তুলে আর সেগুলো ফেসবুকে আপলোড করে সময়টা কাটছিল। এ ছাড়া বই পড়া, নাটক-সিনেমা দেখা। হঠাৎ ভাবলাম, নতুন স্বাভাবিকতায় আমাদের প্রকৃতির জন্য ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ কিছু করা যায় কি না। শুরু করলাম বৃক্ষরোপণ।
অনেক দিন ধরেই আমি প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত। বছরজুড়েই ভালো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে আমাদের সংগঠন। বন্ধুসভার ভালো কাজের একটি হলো, ‘একজন বন্ধু দুটি গাছ’ কর্মসূচি। প্রতিবছর জুন মাসে প্রথম আলো বন্ধুসভার প্রত্যেক বন্ধু অন্তত দুটি গাছ লাগিয়ে এই কর্মসূচি পালন করেন। গত তিন বছরের জুনে কাজটি খুব সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। এ বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে কর্মসূচিটি শুরু হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। ভেবে দেখলাম, গত তিন বছরে যে চর্চাটা গড়ে উঠেছে, সেটা চালিয়ে নেওয়া উচিত।
১১ জুন এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে দেখা করি বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি শাহ সিকান্দার ও আরেক সদস্য মিহরাব আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে। আলোচনা করে ঠিক করলাম, নিজেদের উদ্যোগেই আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী গাছ রোপণ করব। ১৬ জুন শহরতলির টুকেরবাজারে শাহ খুররম ডিগ্রি কলেজে ২টি কড়ইগাছের চারা রোপণ করে আমাদের এই উদ্যোগের মূল কাজ শুরু হয়। ২০ জুন হাজির হই আমার নিজের ক্যাম্পাসে, যেখানে বসে আমরা বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা করেছিলাম। সঙ্গে নিয়ে যাই ১০টি রেইনট্রি, কাঠবাদাম, মেহগনি, টেকরই ফল ও চাপালিশগাছের চারা। দুজনে মিলে সেগুলো রোপণ করি। পরবর্তী সময়ে কোথায় গাছ লাগাব, সেটাও ঠিক করে নিই।
ধীরে ধীরে আমরা সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম এলাকা, পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, টুকেরবাজার, বাদাঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতের শতাধিক গাছ লাগাই। শুধু গাছ লাগানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না আমাদের এই ভালোবাসার কাজ। জামের বিচি, কাঁঠালের বিচি, লিচুর বিচি, আমের আঁটিসহ বিভিন্ন জাতের পাঁচ থেকে ছয় হাজার ফলের বীজও রোপণ করেছি। যতবার কাজটি করতে গিয়েছি, ততবারই এক অন্য রকম ভালোলাগা, ভালোবাসার অনুভূতি কাজ করেছে।
আমাদের এই গাছ লাগানোর কাজ এখনো চলমান। গাছ লাগাতে গিয়ে খুব একটা ছবি তোলা হয় না। ছবি তুলে দেওয়ার মতো তখন সঙ্গে কেউ থাকেও না। একদিন বৃক্ষরোপণ শেষে ফেরার সময় এক লোক বলছিলেন, ১০-১৫ বছর পর যখন গাছগুলো বড় হবে, তখন তৃপ্তি নিয়ে বলতে পারবেন, এগুলো আপনার লাগানো। ভাবলাম, সত্যিই তো! রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে লাগানো এসব গাছ তখন নিশ্চয়ই আমার খুব আপন মনে হবে।
বিশ্বজুড়ে এই দুর্যোগের সময় ঘরে বন্দী থেকে আমরা উপলব্ধি করেছি, বাইরের পৃথিবীটা কত সুন্দর, আর আমরা এর ওপর কত অবিচারই না করেছি। বন, জঙ্গল, নদী, সমুদ্র, মানুষের অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়নি। করোনাকাল আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, পৃথিবীটা আমার একার নয়। পশুপাখি, গাছপালা, নদী, সাগর, এই পৃথিবী সবার। সবাইকে ভালোবাসতে হবে। তাই আমি আমার এই উদ্যোগের নাম দিয়েছি করোনাকালের ভালোবাসা।……
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসারের উদ্যোগসমূহ একটু পড়ে দেখুন;……..
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গুলশান আক্তারের পরিকল্পনা ও নির্দেশনার আলোকে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা এলাকার ১৪৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া নিশ্চিতে চালু করা হয়েছে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম। কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনা নিশ্চিত করতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গঠন করেছেন একটি কমিটি। উল্লিখিত কমিটি প্রতিদিন ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে ক্লাস্টার ভিত্তিক শিক্ষকদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করে প্রতিটি বিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাস সচল রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন।চকরিয়া উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো.আনোয়ারুল কাদের বলেন, এখন বাড়িতে বসে বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাসকরছে শিক্ষার্থীরা। দিনদিন এই অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ বাড়ছে।চকরিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গুলশান আক্তার বলেন, উপজেলায় প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ৬২১৬৮ জন। এসব প্রতিষ্ঠানে ৬২১৬৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে পাঠদান করেন ৯৯০ জন শিক্ষক। আমরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৪২৮জন শিক্ষককে প্রতিটি বিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাসের কার্যক্রমে যুক্ত করেছি।
তিনি বলেন, আইসিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তাদের গ্রুপে এবং উপজেলা শিক্ষা অফিস, চকরিয়া ফেইসবুক পেইজে বিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য নতুন নতুন তৈরিকৃত কনটেন্ট ও ভিডিও আপলোড করবেন।বড়ভেওলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলসাদ আঞ্জুমান রুমা বলেন, ‘শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বের জায়গা থেকেই অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম চালু করেছি। ভালো সাড়া পাচ্ছি। তবে গ্রামীণ এলাকায় হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সমস্যা আছে।চকরিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা উম্মে মোখলেছা খানম রেশমা বলেন, এখন বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হয়েছেন। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে এভাবে ক্লাস চালু করায় অভিভাবকরাও খুশি।এই উদ্যোগের প্রশংসা করে কাজিরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির (এসএমসি) সভাপতি সাংবাদিক এম জিয়াবুল হক বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে উপজেলার ১৪৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ আছে সাড়ে চারমাস ধরে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন অভিভাবকরা। (ক্রমশ:)
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত করোনা মহামারি চলাকালে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কীভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিখন-শেখানো কাজে নিয়োজিত আছে তার একটি চিত্র এখানে তুলে ধারা হলো। পরের পর্বে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কতৃক করোনা মহামারির এ সংকটময় মুহুর্তে আমরা কী কী পদক্ষেপ গ্রহন করবো এবং ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে; তার একটি চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস চালাবো।)
*সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার।
তারিখ: ৩০/০৭/২০২০খ্রি: