মো. সাইফুল ইসলাম:
১.
অনেক আগ থেকেই মসজিদের প্রতি আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করতো। সেই ভালো লাগা থেকেই তার্কিতে আসার পর তুরস্কের বড় বড় মসজিদগুলোর ছবি খুঁজে বের করে পোস্ট করে লিখেছিলাম ছবির সবগুলো মসজিদে একদিন সিজদাহ দিবো।
আমার সে পোস্টের একটি ছবিতে জুবায়ের স্যার কমেন্ট করেছিলেন যে, এটি মসজিদ নয়। জাদুঘর। এটায় তুমি সিজদাহ দিতে পারবে না। এই ছবিটি ডিলিট করে দাও। আমার চোখ তো ছানাবড়া। কি বলেন স্যার! গুগল কি তাহলে আমাকে মিসগাইড করলো! দেখতে মসজিদের মতো, এত সুন্দর একটি স্থান, গুগলে মসজিদের ছবি সার্চ করায় আমাকে সাজেস্ট করলো, আর আপনি বলছেন এটা মসজিদ না! যাক, তখন ছবিটা ডিলিট করার পাশাপাশি তা নিয়ে গুগলমামা থেকে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করি।
তখনই আমার কাছে আয়াসোফিয়ার পুরো ইতিহাস এবং চলমান সংকট স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। হৃদয়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করি। খুব করে চাই, মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে আয়াসোফিয়া আবার মসজিদ হোক। প্রথমবার ইস্তাম্বুল সফরে গিয়ে টিকিট নিয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত মসজিদরূপী জাদুঘরে (আয়াসোফিয়া) ঢুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখতে থাকি।
২.
হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু সত্যি বলতে কি তুরস্কের অন্যান্য বড় বড় মসজিদগুলো যেমন, চামলিজা, সোলাইমানিয়া, ফাতিহ, সুলতান আহমেদ, খোজাতেপে, মালেকা হাতুন ইত্যাদি মসজিদগুলোতে বসলে কিংবা সিজদাহ্ দিয়ে যে তৃপ্তিটুকু পাই, মনে মনে সেদিন সে ধরনের তৃপ্তি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু জাদুঘরে কি আর সে প্রশান্তি আছে!
ভাবনায় এটা আসেনি যে এত তাড়াতাড়ি আমার সেই সুপ্ত ইচ্ছা আর অসতর্কতাবশত বলা “ইনশাআল্লাহ এই জায়গায় একদিন সিজদাহ দিবো” কথাটি সত্যি হয়ে ধরা দিবে।
যে যাই বলি না কেন! রাজনৈতিক এজেন্ডা, দাবার শেষ চাল বা জনপ্রিয়তা ফিরে পাবার সরকারের শেষ গেম ইত্যাদি কথা আমরা রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি কিংবা অন্ধ ভক্ত বা সমালোচক হিসেবে বলতেই পারি। এগুলোর বাস্তবতা ও সত্যতাও আছে। এসব নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে হাজার কথা আছে, থাকতেও পারে।
কিন্তু দিন শেষে আমার কাছে আয়াসোফিয়া জাদুঘর থেকে আবার মসজিদ হয়েছে, অজানা ভাবে বলা সেই ইনশাআল্লাহ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এটাই সবচেয় বড় বিষয়, একটি ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছি সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক আমি যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি, গত ৪ দিনে আমি তুরস্কসহ এখানে থাকা সারাবিশ্বের হাজার হাজার মানুষের মাঝে এই চিন্তাটাই বেশি কাজ করছে দেখছি।
৩.
পরের দিন জুমার নামাজের মাধ্যমে মসজিদ খুলবে, তাই খোঁড়া পায়ে হাজার কিলোমিটার দূর থেকে আগের দিন রাতে এসে মানুষজনকে আয়াসোফিয়া প্রাঙ্গণে শুয়ে থাকতে দেখেছি। শুক্রবারে ফজর পড়েই ইস্তাম্বুলের সকল অলিগলি থেকে ‘ইয়া আল্লাহ, বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার’ শ্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপাতে দেখেছি নারী, পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ, এমনকি শিশু-কিশোরদেরকেও। প্রচণ্ড ভীড় ঠেলে ৮০/৯০ বছরের বৃদ্ধ মহিলাদেরকে আয়াসোফিয়া পানে এগিয়ে যেতে দেখেছি।
কাঠফাটা রোদে ত্বক পুড়ে, করোনার ভয় মাথায় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গত ছয় মাসের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জমায়েতে মানুষজনকে সন্তুষ্টচিত্তে বসে থাকতে দেখেছি। দেখেছি কোরআন তেলাওয়াত শুনে একসাথে সবাই দাঁড়িয়ে তাকবীর দিতে। কেউ এদেরকে দাওয়াত করে আনতে হয়নি, টাকা দিয়েও না। লক্ষ লক্ষ মানুষ আল্লাহর ঘরের প্রতি ভালোবাসা দেখাতেই ছুটে এসেছে পরিবারের সবাইকে নিয়ে।
৪.
রাজনীতিবিদদের কাছে হতে পারে এটা রাজনৈতিক এজেন্ডা, কারো কাছে এটা স্রেফ একটা মসজিদ পুনরায় চালু করে দেয়া, কারো কাছে রাজনৈতিক সমাবেশ কিংবা আরও অনেক কিছু হতে পারে। কিন্তু আমার মতো হাজারো মানুষের কাছে এমনকি তুরস্কের হাজারো সাধারণ মানুষের কাছে এটা একটি আবেগ, একটি বিজয়, একটু ভালোলাগা, ভালোবাসা। মুনিবের দরবারে সিজদাহ্ দিয়ে শোকরিয়া আদায় করার মতো একটি বিষয়।
হয়তো আপনি ভাবতে পারেন, আমি আপনার মতো এত বিজ্ঞ নই, রাজনৈতিক বিশ্লেষক নই, ভিতর-বাহিরের এত খবর রাখি না, তাই সোজাসাপটা হিসাব মিলিয়ে ফেলেছি। এখানে নতুন বিধায় রাজনৈতিক কুটচালও আপনার মতো করে বুঝি না। এমন হাজারটা কথা আমাকে বলতে পারেন।
তবুও আমি বলবো, আয়াসোফিয়া পুনরায় মসজিদ হওয়া আমার জন্য আনন্দের, গর্বের, উচ্ছ্বাসের, ভালোলাগার, ভালোবাসার, সম্মানের, আবেগের, চেতনার।
এভাবে সকল অযুহাত আর রাজনীতি ছাপিয়ে একদিন আমাদের প্রাণের বায়তুল মোকাদ্দাস, মসজিদে আকসাতেও সিজদাহ্ দেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবো, এই স্বপ্নবুনি। বায়তুল্লাহর মতোই মুক্ত থাকবে পৃথিবীর সকল প্রশান্তির জায়গা আল্লাহর ঘরগুলো। এটাই আমার লালিত স্বপ্ন।

 

মো. সাইফুল ইসলাম
তুরস্ক থেকে।