রবিউল আলম

“Man is a social being.” “Man cannot live alone.” এই প্রবাদগুলো আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। আসলেই তা-ই। আমরা সমাজবিহীন একা একা থাকতে পারি না কখনও। জীবনের গতি পথে প্রতিনিয়তই আমরা অপরের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে থাকি। ছোটদেরকে একটা মোটিভেশন সবসময়ই দেয়া হয়, “তোমাকে স্বনির্ভর হতে হবে।” আসলে ‘স্বনির্ভরতা’ বা ‘Self-dependent’-এর সংজ্ঞা যে কী, আমার এখনও বুঝে আসে না। “স্বনির্ভরতা” শব্দটি ভাঙলে আমরা দুটো শব্দ পাই: ‘স্ব” ও ‘নির্ভরতা’। এখানে ‘স্ব’ মানে নিজের এবং ‘নির্ভরতা’ মানে ভরসা বা সমর্থন। অর্থাৎ, অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা, সমর্থন ছাড়াই নিজে নিজে চলতে পারা। অবশ্য, আমাদের সমাজে একটা ভালো চাকরি বা কিছু একটা করে কিছু টাকা উপার্জন করতে পারলেই তাকে স্বনির্ভর বলা হয়ে থাকে।

কিন্তু আমার প্রশ্ন জাগে, আপনি যে সুন্দর জামা আর কালো চশমাটা পরে নিজেকে স্বনির্ভর হিসেবে খুব গর্বিত ভাবছেন, সেগুলোও তো অন্য জনের বানানো। হয়তো ভাবছেন, “আমি তো এসব টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি।” কিন্তু টাকাটা কোথায় পেয়েছেন, শুনি? আপনি বানিয়েছেন? হয়তো বলবেন, “পরিশ্রমের বিনিময়ে পেয়েছি।” যদি প্রশ্ন করি, পরিশ্রম দেয়ার শক্তিটা কোথায় পেয়েছেন? এবার একটু চুপ। ক্ষণিক ভেবে হয়তো বলবেন, “খাদ্য থেকে।” এখন যদি জানতে চাই, ওই খাদ্য কি সব আপনার?এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে দেখবেন, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, বডিটা ছাড়া আপনার আর নিজের কিছুই নেই। ওই বডিটাও তো আল্লাহর দান। সব কিছুই বাদ দিলাম, আপনি যে শ্বাস নিয়ে বডিটাকে সচল রাখছেন, তাও তো আপনার নয়। তো, আপনি নিজেকে স্বনির্ভর দাবি করছেন কেমন করে?

আসলে, কোনো সৃষ্টিই কখনও স্বনির্ভর হতে পা..রে..না। আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা) হিসেবে আমরাও কখনও পারি না। কোনো না কোনো কিছুর জন্য আমরা অপরের ওপর অবশ্যই নির্ভরশীল, অপরের সহযোগিতা প্রার্থী। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ওভাবেই সৃষ্টি করেছেন। সহযোগিতা নেবো, তাতে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা অন্য জায়গায়। আর তা হলো ‘কৃতজ্ঞতা’। আমরা অপরের সহযোগিতা নিই ঠিকই, কিন্তু তার প্রতি একটু কৃতজ্ঞতা জানানোর বেলায়ই আমাদের যত কার্পণ্য।কৃতজ্ঞতা মানুষকে আপন থেকে আপনতর করে। সহযোগিতাকারীর কষ্ট ভুলিয়ে দেয় মুহূর্তেই। মহান আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে, তার কৃতজ্ঞতা হবে তার নিজেরই জন্য লাভজনক৷” (সুরা লুকমান:১২) আর, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ হয় না।” (জামে তিরমিযি, হাদিস নং ১৯৫৪)এক ব্যক্তি রিক্সাতে করে বাজারে যাচ্ছিলেন। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে তাঁর শরীর থেকে ঘাম ঝরছিলো অবিরত। পথিমধ্যে এক লেবুর শরবত বিক্রেতাকে পেলেন এবং একে একে তিন গ্লাস শরবত খেয়ে ফেললেন তিনি। অতঃপর, চিন্তা করলেন, আমার চেয়ে ওই রিক্সাওয়ালা চাচাই তো বেশি ক্লান্ত হয়েছেন। তাই, চাচাকেও কয়েক গ্লাস দিতে বললেন। কিন্তু চাচা একটা নিয়ে আর নিলেন না এবং ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা-ভরা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন, “বাবা, আল্লাহ তোমার ভালা করুক।”

কৃতজ্ঞতা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করা যায়। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“কাউকে যখন উপহারস্বরূপ কিছু দেয়া হয়, তখন সে যদি এর পরিবর্তে দেয়ার মতো কিছু পায়, তাহলে যেন তা দিয়ে দেয়। আর, যে এমন কিছু না পাবে, সে যেন তার প্রশংসা করে। কেননা, যে প্রশংসা করলো, সেও কৃতজ্ঞতা আদায় করলো। আর, যে লুকিয়ে রাখলো, সে অস্বীকার করলো।” (জামে তিরমিযি, হাদিস নং ২০৩৪)। অন্য এক হাদিসে তিনি বলেন, “কারও সঙ্গে যখন কোনো ভালো আচরণ করা হয়, এরপর সে যদি ভালো আচরণকারীকে বলে, “জাযাকাল্লাহু খায়রান, অর্থাৎ আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন”, তাহলে সে যথোপযুক্ত প্রশংসা করলো।” (জামে তিরমিযি, হাদিস নং ২০৩৫)। সুতরাং, কৃতজ্ঞতা অনেক বড়ো একটা উপায় আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করার। অকৃতজ্ঞদের বিপদে স্বাভাবিকভাবেই কোনো মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় না। আপনারা মিথ্যুক রাখালের গল্প নিশ্চয় শুনেছেন। গ্রামবাসীরা তার চিৎকার শুনে বিপদ ভেবে বারবার ছুটে এসেছেন তাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু সেই মিথ্যাবাদী রাখাল কৃতজ্ঞতা তো প্রকাশ করলোই না, বরং তাঁদেরকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করলো। যার পরিণতি ছিলো খুবই ভয়াবহ।

অবশেষে বলি, আমরা যেহেতু স্বনির্ভর কখনও নই, এবং হওয়াও কখনও সম্ভব নয়, এবং অপরের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই, সেহেতু আমাদের উচিত যতটুকু সম্ভব একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাহলে, আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-বিশ্বাসের ভিত্তি আরও মজবুত হবে। এভাবেই, একদিন আমাদের সমাজ হয়ে উঠবে একটি জান্নাতি ও সুন্দর সমাজ। আর, সর্বোপরি কৃতজ্ঞতা তো আল্লাহর জন্যই যিনি না চাওয়াতেও আমাদের প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন খুব সুনিপুণভাবেই।
চলুন, প্রয়াস চালাই।


ছাত্র, ইংরেজি বিভাগ ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।