বিবিসি বাংলা:

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪০ লাখ জনবল বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের ওপর নির্ভরশীল কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষ আছেন কঠিন বিপদের মধ্যে।

সরকারি সহায়তার ক্ষেত্রে এখনও সম্ভাবনাময় এই খাতটি উপেক্ষিত থেকে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

রঞ্জনা সৌমী এবং তার ব্যবসায়ী অংশীদার গত কয়েক বছর ধরে সিলেট এবং খাগড়াছড়িতে দুটি রিসোর্ট পরিচালনা করে আসছেন।

তারা ভেবেছিলেন সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে ভালো লাভ করতে পারবেন। কিন্তু বছরের শুরুতেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় সব ভেস্তে গেছে।

রঞ্জনা সৌমী বলছেন একে তো গত চার মাস ধরে রিসোর্টগুলো থেকে কোন আয় নেই, উল্টো এই রিসোর্ট দেখভালে তাকে খরচ করে যেতে হচ্ছে মোটা অংকের টাকা।

“বিনিয়োগ যা করার করে ফেলেছি। কিন্তু মার্চ মাস থেকে কোন আয় নেই। অথচ রিসোর্ট মেইন্টেইন করতে খরচ করতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে কর্মচারীদের ছাঁটাই করেছি। যাদের একটা দুটা কটেজ, আর এগুলোর আয় দিয়েই চলে তাদের অবস্থা খুব খারাপ,” মিসেস সৌমী বলেন।

আয় রোজগার নেই পর্যটন সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের।

আয় রোজগার নেই পর্যটন সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের।

৪০ লাখ জনবল চরম বিপাকে

এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত পর্যটনের বিভিন্ন মৌসুম থাকলেও সরকারি কড়াকড়ি এবং মানুষের আতঙ্কের কারণে পর্যটন স্পটগুলোয় মানুষের আনাগোনা দেখা যায়নি।

এমন পরিস্থিতিতে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।

জীবন জীবিকা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৭০% জনবল। সংখ্যার হিসেবে সেটা ৪০ লাখেরও বেশি।

তারা রোজগারহীন অবস্থায় থাকায় তাদের ওপর নির্ভরশীল কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষ কঠিন বিপদের মধ্যে আছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড।

এই বিপর্যয়কর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকারের বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- টোয়াবের পরিচালক মো. শাহেদুল্লাহ।

তিনি বলেন, “চার মাস পর্যটন সংশ্লিষ্ট সবকিছু বন্ধ। কিন্তু পরিচালনা খরচ তো বন্ধ নেই। ব্যাংকের সুদ, ভূমির ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল তো চলছেই। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কেউ কেউ পেশা বদলেছেন।”

বিলাসবহুল হোটেল।

পর্যটক না থাকায় বিলাসবহুল হোটেলগুলো ফাঁকা পড়ে আছে।

১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি, অথচ..

পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী , করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে ভ্রমণ ও পর্যটন খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

অপরদিকে প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেলস এসোসিয়েশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে শিগগিরই পর্যটন স্পটগুলো সীমিত পরিসরে খুলে দেয়ার কথা জানিয়েছেন পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মহিবুল হক।

হোটেল, রেস্তোরাঁ বা বিনোদন স্পটগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, বিশেষ করে যারা সেবা নেবেন বা যারা সেবা দেবেন, তাদের আচরণ কেমন হবে সে ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কথাও জানান তিনি।

তবে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা চাইলে ব্যাংকগুলো থেকে বন্ধকী ঋণ নিতে পারবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন সরকারের কাছে সহায়তার দাবি জানিয়ে আসলেও বাস্তবে কেউ সহজ শর্তে ঋণ নিতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছেন টোয়াবের পরিচালক মি. শাহেদুল্লাহ।

তিনি বলেন, “যাদের ঋণের তেমন একটা প্রয়োজন নেই, তারা সহজেই ঋণ পাচ্ছে। অথচ পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের পথে বসার দশা হয়েছে কিন্তু তারা ঋণ পাচ্ছে না। উল্টো পর্যটন খাতের ব্যবসায়ী দেখে ব্যক্তিগত ঋণও দেয়া হচ্ছে না।”

এমনটা চলতে থাকলে পর্যটন খাত ভেঙ্গে পড়বে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।।

বান্দরবান।

বর্ষাকাল পর্যটনের মৌসুম হলেও কোন ব্যবসা করতে পারেননি এ খাত সংশ্লিষ্টরা।

বাজেটে নগন্য বরাদ্দ

বিগত কয়েক মাস যাবত পর্যটন খাতে স্থবিরতা দেখা গেলেও সুনির্দিষ্ট কোন দিক নির্দেশনা আসেনি এবং সাম্প্রতিক বাজেটে এই খাতকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা প্রতিফলিত হয়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন খাতে ৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এবারে এই খাতে গত অর্থবছরের তুলনায় ২৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হলেও সেটা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।

এর মধ্যে বরাদ্দের প্রায় ৮০% ব্যয় ধরা হয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন খাত বাবদ। আর বাকি ৭২৫ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে পর্যটনের অন্যান্য খাতের জন্য।

উপায় কী

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে এবং প্রাদুর্ভাব কেটে যাওয়ার সাথে সাথেই পর্যটন ব্যবসা আগের রূপে ফিরে যাবে সেটাও বলা যাচ্ছে না।

এমন অবস্থায় পর্যটন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের টিকিয়ে রাখতে সহজ শর্তে ঋণ দেয়া না হলে বীমা করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

পর্যটন এলাকাগুলোয় কীভাবে নিরাপত্তা বজায় রেখে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায় এ ব্যাপারে সরকারকে নীতিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের শিক্ষক সামশাদ নওরীন।

তিনি বলেন “বিনিয়োগকারীদের যদি বীমা করা থাকতো তাহলে কিংবা তাদের জন্য যদি বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে অনেক মানুষের জীবন জীবিকা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো। পর্যটনের সাথে অর্থনীতির অনেকগুলো খাত জড়িত, একে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।”