আরাফাত মোহাম্মদ নোমান 
সহকারী সচিব

(যুক্তরাজ্যে প্রেষণে অধ্যয়নরত, এমএসসি, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এন্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।


হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সমসাময়িক রাজনীতিতে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মাঝে একটা ধারণার বীজ বেশ ভালোভাবেই প্রোথিত ছিলো। আর এই ধারণাটা হচ্ছে মানুষের জন্য, দেশের জন্য যদি রাজনীতি করতে চাও তাহলে নির্মোহ হও, নির্লোভ হও। জাতির জনক বেশ তীব্রভাবেই অনেকের মাঝে এই চেতনাটুকু ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। একটা মানুষ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারা ভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। ঘর-পরিবার ছেড়ে যে মানুষের জীবনের বড় একটা সময় গেছে গরাদের ছোট্ট কুঠুরিতে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার সীমা-পরিসীমা মাপার মতো কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হওয়া সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তার সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝে এইরূপ মাঠের রাজনীতি করার একটা তাড়না বপন করেছিলেন। অনেকেই তাঁর মতো নির্মোহ, নির্লোভ রাজনীতিও করার চেষ্টা করে গেছেন জীবদ্দশায়।

ঠিক এরকম একজন মানুষকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তার নাম অ্যাডভোকেট ফয়জুল করিম। মহেশখালি উপজেলার মাতারবাড়ি ইউনিয়নের মরহুম হাজী আলী মিয়ার এই পুত্র কৈশোর থেকেই ছিলেন বেশ রাজনীতি সচেতন। ১৯৫১ সালে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেই তিনি কালামারছড়া ইউনিয়নের ইউনুসখালি নাসিরউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতায় থেকে ১৯৬৯ সালে যখন গণঅভ্যুত্থানের ডাক আসে তখন তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে চলে আসেন। এর মাঝে সম্পন্ন করেন নিজের স্নাতক ডিগ্রি। তৎকালীন কক্সবাজার জেলার মহেশখালি উপজেলার মাতারবাড়ি ইউনিয়নের মানুষকে সাথে নিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাইকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নিরলসভাবে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এরই মাঝে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কালবিলম্ব না করে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে দীর্ঘ নয় মাস সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করার কারণে জনাব এডভোকেট ফয়জুল করিমকে ১নংআসামী করে দেশদ্রোহী হিসাবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের মদদপুষ্ট মহেশখালী থানার ওসি মামলা দায়ের করেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। এই মানুষটা এতোকিছু করছে কিন্তু ঘরের জন্য ছিলো তার বৈরাগ্য। ঘরে তার দুই ছেলে এবং পাঁচ মেয়ে। পুরো ঘরের দায়িত্ব তিনি দিয়ে দেন তার স্ত্রী মিরাজুন্নেসা কে। শত অভিমান-অনুযোগের পরেও তার স্ত্রী ঘর সামলে নিচ্ছিলেন বেশ ভালোভাবেই। আর অ্যাডভোকেট ফয়জুল করিমের ধ্যান-জ্ঞান তখন রাজনীতি।

১৯৭৩ সালে আওয়ামীলীগের কর্মীসভায় যোগ দিতে তিনি ঢাকায় আসেন। উঠেন তোপখানা রোডের হোটেল সম্রাটে। তার সাথে আরও ছিলেন সাবেক সাংসদ মরহুম মোহাম্মদ ইসহাক বি.এ, মহেশখালি-কুতুবদিয়ার বর্তমান সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিকের পিতা জনাব মরহুম অ্যাডভোকেট রফিক উল্লাহ, বর্তমান কক্সবাজার-রামুর সাংসদ আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার চৌধুরী কমলের পিতা সাবেক সাংসদ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি জনাব আবসার কামাল চৌধুরী এবং জেলার বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব একেএম মোজাম্মেল হক, অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলামসহ আরও অনেকে। এই কর্মী সমাবেশে এসে অ্যাডভোকেট ফয়জুল করিম হঠাত করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্তমান আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জনাব আমির হোসেন আমুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ফয়জুল করিমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। তৎকালীন কক্সবাজারের সাংসদ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী চিকিৎসাকালীন সময়ে থাকার জন্য এড. ফয়জুল করিমের ছোট ভাই নাজিম উদ্দিন এবং ভাইপো নুরুল আমিনকে তাঁর নাখালপাড়াস্থ এমপি হোস্টেলের চাবি দিয়ে সহযোগিতা করেন। তখনকার রাজনৈতিক হায়ারার্কি বা চেইন অব কমান্ড কতটা বলিষ্ঠ হলে মাঠের একজন কর্মীর অসুস্থতায় তার সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণের প্রত্যক্ষ আদেশ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু নিজেই! সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় খরচে অ্যাডভোকেট ফয়জুল করিমের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৭৮ সালে এলএলবি পাশ করার পর ওকালতিকে পেশা হিসেবে এবং আওয়ামীলীগের রাজনীতিকে নেশা হিসেবে নিয়ে অ্যাডভোকেট ফয়জুল করিম তার জীবন কাটিয়ে দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি মাতারবাড়ীতে প্রথম রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়া মহেশখালী থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেশ অনেক বছর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি লালন করে গেছেন স্বাধীনতার চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ।

এই যে ঘর-সংসার বিমুখ এই মানুষটা সারাটা জীবন উৎসর্গ করলেন রাজনীতিতে; কিন্তু তাই বলে তার নিজের ভাই-বোন এবং সন্তানেরা কিন্তু পিছিয়ে পড়েনি। তারাও মানুষ হয়েছে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৬ ভাই ৫ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি তার ভাইদের গড়ে তুলেছেন শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে। মাতারবাড়ীতে উনার পরিবারকে সবাই সর্ব্বোচ্চ শিক্ষিত পরিবার হিসেবে জানেন ও চিনেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি শিক্ষাকে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতেন। তার পরিবারের সব ভাইয়েরা শিক্ষিত এবং ভাইপো এবং কন্যারাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

অ্যাডভোকেট ফয়জুল করিমের বড় ছেলে কলেজের অধ্যাপক, ছোট ছেলে সরকারি চাকরি করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে। সবার ছোট মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ হতে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন এবং বর্তমানে উপসচিব এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির পিএস-২ (২৪তম বিসিএস, প্রশাসন ক্যাডার) হিসেবে কর্মরত। এক মেয়ে অ্যাডভোকেট (তিনি গত হয়েছেন)। সব মেয়েকেই তিনি বানিয়েছেন গ্র্যাজুয়েট, এর মাঝে তিন মেয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন । তার নাতি-নাতনিরাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত।

এই অ্যাডভোকেট ফয়জুল করিম (জন্মঃ ১৩/০৩/১৯৩৫; মৃত্যুঃ ১৬/০৭/২০০১) আমার নানাভাই। নানাভাইয়ের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম ছোটবেলায়। তবে আজীবন আক্ষেপ রয়ে যাবে এই মানুষটির সাথে কেনো আরও অনেক বছর থাকতে পারলাম না। ১৬ জুলাই আমার নানা ভাইয়ের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই লেখাটা নানাভাইকে উৎসর্গ করলাম। মহান আল্লাহ তায়ালা আমার নানাভাইকে বেহেশত নসিব করুন এই প্রার্থনা।