ইমাম খাইর #
বিশ্ব মহামারী করোনা ভাইরাসের এই কঠিন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও জনবল সংকটের মাঝেও কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে সেবা অব্যাহত আছে।
২০ জনের অধিক চিকিৎসক-নার্স করোনা আক্রান্ত হলেও থেমে থাকেনি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটির সেবা কার্যক্রম।
তবে, প্রথম দিকে হাসপাতালে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেনের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক করোনা রোগির মৃত্যুর অভিযোগ উঠে।
কর্তৃপক্ষের আবেদন, তদবিরের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দাতা সংস্থা এগিয়ে এসেছে।
অল্প সময়ের মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।
হাসপাতালের এই উন্নয়নকে বাংলাদেশের একমাত্র ও বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে দাবি করেছে কক্সবাজার স্বাস্থ্য বিভাগ।
উন্নয়নের পেছনে সদ্য বদলি হওয়া সুপার ডাক্তার মহিউদ্দিনের অবদানের কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করছে।
অনেকে বলছেন, তার মতো একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল মিলবে কিনা অজানা।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সহায়তায় কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ১০টি ভেন্টিলেটর সুবিধাসহ ২০ শয্যার আইসিইউ (ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট) বা নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এবং এইচডিইউ’র (হাই ডিফেন্ডেন্সি ইউনিট) সুবিধা স্থাপন করা হয়েছে। যা গত ২০ জুন উদ্বোধন হলেও ২৮ জুন থেকে চিকিৎসা সেবা শুরু হয়েছে। এতে সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ৫৫ লাখ ব্যয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ সেন্ট্রাল লিকুইড অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করে দিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা UNICEF (ইউনিসেফ)। যার কাজ পুরোদমে চলছে। এটা বাংলাদেশে জেলা পর্যায়ের কোন হাসপাতালে প্রথম।
এ ছাড়াও করোনা দুর্যোগের সময় বিভিন্ন এনজিও সংস্থা, ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের জন্য ইকুইপমেন্টসহ হাসপাতালের জন্য হাই ফ্লো ন্যাজেল ক্যানোলা অক্সিজেন মেশিনসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে। ডাক্তার মহিউদ্দিনের চেষ্টাতেই বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা বা চিকিৎসা সয়ংস্পূর্ণতা অর্জন করেছে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল।
ডাক্তার মহিউদ্দিন বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও এনজিওর কাছে এক প্রকার হাত পেতে চিকিৎসার ব্যবস্থার এই উন্নয়ন করেছেন। গত ৫ জুন স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ পার ২ অধিশাখা উপসচিব শারমিন আক্তার সাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার মহিউদ্দিনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সিএমএসডি) হিসেবে বদলী করা হয়।
তার স্থলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডাক্তার মোঃ জাকির হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এদিকে, ডাক্তার মহিউদ্দীনের হঠাৎ বদলী নিয়ে কক্সবাজারে বিভিন্ন মহলে এখনো আলোচনা তুঙ্গে।
অভিযোগ উঠেছে, মহিউদ্দীনের বদলীতে হাসপাতালের একটি শক্তিশালি সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে।
তারা অনিয়ম, কমিশন বাণিজ্য ধরে রাখতে বদলী করিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসক জানান, সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে সদর হাসপাতালে কিছুই হয় না। দুই বছর ধরে সরকারের দেয়া সিটি স্ক্যান মেশিন চালু করা হয়নি। তাতে সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে।
সিটি স্ক্যান মেশিনসহ আরও অনেক উন্নতমানের চিকিৎসা সরঞ্জাম এখন নষ্টের পথে।
ওই চিকিৎসকের মতে, উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে অস্থিরতায় ভুগছিল সিন্ডিকেটের অনেকেই।
এটাই মহিউদ্দীনের বদলীর কারণ হতে পারে।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাক্তার মোঃ শাহীন আব্দুর রহমান চৌধুরী সুপার মহিউদ্দিনের বদলীকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, মহিউদ্দিন স্যার অত্যন্ত যোগ্যতা সম্পন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। করোনার দুঃসময়ে তিনি বিচক্ষণতার সাথে হাসপাতাল পরিচালনা করেছেন। তার যোগ্যতার মূল্যায়ন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বদলী করা হয়েছে। স্যারের বতলী স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
এদিকে, ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ নামের সামাজিক সংগঠনটি সদর হাসপাতালকেন্দ্রীক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রথম থেকে সোচ্চার দেখা যায়। তারা মাঠে ময়দানে বিভিন্ন প্রতিবাদ সভা, সমাবেশ করেছে। বিবৃতি দিয়েছে গণমাধ্যমে।
সংগঠনটির সমন্বয়ক নাজিম উদ্দিন বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে জেলার ৪০ লাখ মানুষকে হুমকিতে ফেলায় সিভিল সার্জনের
অপসারণ চেয়েছিলাম। কিন্তু হাসপাতালের পেশিশক্তির সিন্ডিকেট অপসারণ করেছে তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার মহিউদ্দীনকে। তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ছিলনা। বরং তার কারণে বেসরকারী হাসপাতালভিত্তিক সিন্ডিকেট কোণঠাসা ছিল।
হাসপাতালে ব্যাপক উন্নয়ন করেও ডাক্তার মহিউদ্দিনকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে দাবি করেন নাজিম উদ্দিন।
সদর হাসপাতালের বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার মহিউদ্দীনের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন সিভিল সার্জন ডাক্তার মাহবুবুর রহমান।
তবে কেন, কি কারণে হঠাৎ বদলী করা হয়েছে এ ব্যাপারে তার জানা নাই।
জানতে চাইলে সদ্য বদলী সুপার ডাক্তার মহিউদ্দীন বলেন, করোনার তাণ্ডবের আগে গত ২২মার্চ ইউএনএইচসিআরের কাছে চিঠি লিখি। তাদের কাছে আকুতি-মিনতি করে রোহিঙ্গাসহ ৪০লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ৩৬কোটি টাকা ব্যয়ে ভেন্টিলেটর সুবিধাসহ ২০ শয্যার আইসিইউ (ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট) এবং এইচডিইউ’র (হাই ডিফেন্ডেন্সি ইউনিট) করে দেয়ার অনুরোধ জানালে তারাও সাড়া দেয়।
একইভাবে অাধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই লাইন স্থাপন করে দিতে প্রবাসী বন্ধু ডাক্তার আবদুল্লাহ সহায়তায় জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা (ইউনিসেফ) এর কাছে অনুরোধ জানালে তারাও সাড়া দেয়।
এভাবে সদর হাসপাতালের জন্য অনেকের দ্বারেদ্বারে গিয়েছি। সবাই কমবেশি সাড়া দিয়েছে।
তিনি বলেন, ৩০ লক্ষ কক্সবাজারবাসীকে চিকিৎসার জন্য আর ঢাকা চট্রগ্রাম যেতে হবে না। কক্সবাজারের মত চিকিৎসা ব্যবস্থা এ মুহুর্তে বাংলাদেশের কোথাও নাই।
হঠাৎ বদলীর কারণ জানতে চাইলে চাপা ক্ষোভ নিয়ে ডাক্তার মহিউদ্দীন বলেন, আমাকে কেন বদলী করা হয়েছে সেটা আমি বলতে পারবনা।
চট্রগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহারিয়ার ডাক্তার মহিউদ্দিনের উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থার অবদান স্বীকার করে গণমাধ্যমকে বলেন, কোন পেশিশক্তি তার বদলীতে হাত ছিল কিনা আমার জানা নাই। তবে, ডাক্তার মহিউদ্দিনের বদলীর কথা শোনার পর পরই আমি স্বাস্থ্য সচিবকে ফোন করে বলেছিলাম, এই করোনাকালে তাকে বদলী না করলে ভালো হবে।
কিন্তু স্যার আমাকে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ডাক্তার মহিউদ্দীনের মত একজন দক্ষ মানুষের প্রয়োজন। হয়তো সে কারণে তাকে বদলি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ডাক্তার মহিউদ্দিন ২০১৯ সালের মে মাসে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে সুপার পদে যোগদান করেন। ১ বছর পরে গত ৭ জুলাই তাকে বদলী করা হয়।