মুহাম্মদ শাফাআতুজ্জামান নাঈম

প্রিয় মাতৃভূমির গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা অর্জন প্রায় শিক্ষার্থীর জন্যই একটি স্বপ্ন। এক্ষেত্রে তুলনামূলক মেধাবী শিক্ষার্থীরা এক ধাপ এগিয়ে।শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক দের উৎসাহ উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়ে একটি উজ্জ্বল একাডেমীক ক্যারিয়ার গঠনে বদ্ধপরিকর প্রতিভাবান শিক্ষার্থীর মাথায় বিদেশে উচ্চ শিক্ষার বিষয়টি স্থান করে নেয়।পাশাপাশি পার্টটাইম হিসেবে যে কোন কাজ করে আর্থিক সুবিধা পাওয়া গেলে তা যেন সোনায় সোহাগা।

অধ্যবসায়ের সাথে লেখাপড়া করে স্বীয় মেধা ও প্রতিভার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে আমার দেশেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া, দেশ ও জাতির কল্যাণে কিছু করা অবশ্যই সম্ভব।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের আমার দেশের সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসায় উচ্চ শিক্ষা অর্জনের উদাহরণ অনেক। বাংলাদেশে এক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের বিদেশী প্রধান শিক্ষক এর সাথে পরিচয় হতে গিয়ে জানতে পারলাম তিনি অনার্স, মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।অনুরূপভাবে ইস্তাম্বুলে এক অনুষ্ঠানে এক জনের সাথে পরিচয় হল যার গ্রাজুয়েশন iiuc থেকে। আমরা ছোটকালে চট্টগ্রামের দারুল মা’আরিফ,পটিয়া মাদ্রাসায় হিফজ প্রতিযোগিতায় গিয়ে অনেক বিদেশি ছাত্রদের দেখতে পেতাম। এরূপ উদাহরণ অসংখ্য ।অতএব, বিদেশে যে যেতেই হবে এমন ভাবা সঠিক নয়।তাছাড়া রিজিক ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর একমাত্র মালিক যে আল্লাহ তা কোন মতেই ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

মূল কথায় আসি,আবারও বলতে চাই বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য নিজের ভবিষ্যৎ কে নষ্ট করে,পিতা মাতার একমাত্র সম্বল বিক্রি করে, চলমান জীবন যাত্রাকে এলোমেলো করার কোন প্রয়োজন নেই।এলোমেলো যেন না হয়ে যায় ।আমার দেখা কত মেধাবী, প্রতিভাবান, আদর্শ শিক্ষার্থীর জীবন যে এলোমেলো হয়ে গেল তা বর্ণনাতীত। এসব দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া আবশ্যক।

ক্লাসে সব সময় ১-৩ হওয়া,এস.এস.সি ; এইস. এস.সি তে গোল্ডেন এ+,এ+ পাওয়া কয়েক শিক্ষার্থীর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এ লেখার প্রেরণা। এদের মাঝে স্বয়ং আমার প্রিয় কয়েক ছাত্র ও আছে।যাদের মাঝে আমি একটি চমৎকার ভবিষ্যৎ দেখেছিলাম ও বটে।

প্রথমেই প্রতারিত হওয়া ভাইদের সুন্দর জীবন কামনা ও ছদ্মবেশী, ভাল মানুষ রূপি প্রতারকদের বিচার মহান বিচারক আল্লাহর কাছেই অর্পণ করলাম। খুব কাছে থেকে দেখা,উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার পথ থেকে ছিটকে পড়া ভাইদের মনের আকুতি,তাদের হৃদয় ভাঙা মনোকষ্ট, কাউকে বুঝাতে না পারার কঠিন দু:খ ও মনের গহিনে চাপা পড়া পাহাড় সম কষ্টের অনুভূতিই আমাকে এ লেখা লিখতে বাধ্য করেছে।

কিশোর বয়সে এস,এস,সি ও এইস,এস,সি তে ভাল ফলাফল কারি যে কোন ছাত্রই উপকারির ছদ্মবেশে কাছে এসে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি পার্টটাইম আর্থিক সুবিধার কথা শুনানো যে কারো প্রতি আমার দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের সাথে সম্মুখীন হওয়া যে কেউ সহজেই যে অনুপ্রাণিত হতে পারে।কারণ শিক্ষার পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্চলতা,এক লোভনীয় প্রস্তাবও বটে।ফলে অনেকেই পিতার শেষ সম্বল টুকু বিক্রি করে, এমন কি ভাল কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাতিল করে বিদেশে পাড়ি জমানোর ইতিহাস /ঘটনা আমরা দেখেতে পাই।

বিদেশে শিক্ষা,ব্যবসা,ভ্রমণ বা চাকরির উদ্দেশ্যে যাওয়া কোনমতেই সহজ নয়,কত প্রসেসিংই করতে হয়।সব প্রসেসিংই ঝামেলাপূর্ণ।এত কষ্ট করে, দেশ ও আত্নীয় স্বজন ফেলে এক বুক আশা নিয়ে বিদেশে যাওয়ার পর সব প্রতিশ্রুতই শতভাগ মিথ্যা। কঠিন এক বাস্তবতার সম্মুখীন গ্রামের সহজ, সরল,প্রতিভাবান, মেধাবী ও সুন্দর ভবিষ্যৎ এর আশায় উদগ্রীব ছাত্র।এ এক নিষ্টুর বাস্তবতা। অমার্জনীয় প্রতারণা। ভর্তি বাতিল, পিতার শেষ সম্বল বিক্রি, নিজের পরিশ্রম সব যেন মুহুর্তেই শেষ। না সুযোগ আছে সামনে যাওয়ার,না পিছনে ফিরে আসার।নতুন দেশ,অপরিচিত সংস্কৃতি,অজানা ভাষায় নিজের হৃদয়ে জমা পড়া কঠিন কষ্টটুকুও যেন কাউকে প্রকাশ জরা যায় না।এ কঠিন বাস্তবতার নিষ্টুরতা,নির্দয়তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বুঝে।এ কষ্ট যেমন অবর্ণনীয় তেমনি অসহনীয় ও বটে।

সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস,বাকি দিনগুলি বা সপ্তাহে তিন দিন কাজ করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিদেশে গিয়ে দেখা যায় সপ্তাহে ছয় দিনই ক্লাস,আর কাজ করতে চাইলে তাও সপ্তাহে ছয় দিন বা পাচ দিন করতে হবে।সময় ১২ ঘণ্টা। একটু খুলে বললে সকাল ৯.০০ টা রাত ৯.০০ টা অথবা রাত ৯.০০ টা থেকে সকাল ৯.০০ টা।সারা জীবন বই খাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকা তরূণ কে যখন ১২ ঘন্টা পরিশ্রমের কথা বলে, তা মেনে নেওয়া যে কতই হৃদয় বিদারক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।চোখে অন্ধকার দেখা প্রতারিত যুবকের পিছনে ফিরে আসার পথটাও ততক্ষণে বন্ধ প্রায়।কারণ মাথায় ঋণের বোঝা। অবশেষে ক্লাস বাদ দিয়ে হলেও ঋণ পরিশোধের চেষ্টায় জীবনের প্রথম পরিশ্রম করতে লেগে পড়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

সাধারণত পরিবার,স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় ভাল ছাত্র হিসেবে মর্যাদায় সিক্ত হওয়া, কোন ভারি কাজে অনভ্যস্ত, এমন কি সামান্য টিওশনি করতে গিয়েও যারা খুভ মূল্যায়িত হয়েছিল তারাই আজ কঠিন এক বাস্তবতার সাগরে ডুবে গিয়ে বাচার তাড়নায় তীর পাণে সাঁতরানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত/প্রচেষ্টারত। এ যেমন লজ্জা তেমনি অতি বেদনাদায়ক ও বটে।কারণ ফিরে যেতে হলেও অন্তত এক বছর কাজ করে ঋণের টাকাটা হলেও যোগাড় করা যেন কর্তব্য। নতুবা অভাবি পিতার কষ্টের সীমা থাকবে না। চির/ চীর দু;খিনী মায়ের হৃদয়ের জ্বালা বহুগুণে বেড়ে যাবে।

অনন্যোপায় হয়ে মিথ্যা এক অভিনয়ের আশ্রয়। মাতা -পিতার দু:খ লাগবে সুখে থাকার কত মিথ্যা অভিনয়ই না আজ তাদের নিত্য সংগী। কথা বলে জানতে পেরেছি ওয়ার্ক টাইম এর কাজ এর সময়ে পকেট থেকে টাইম দেখার জন্য মোবাইলটা বের করে নিষেধ। এতেই বুঝা যায় কাজের চাপ ও নির্দয়তা।আহারে নিষ্টুরতা,আহারে বাস্তবতা,তুমি সত্যিই নির্দ

অবশেষে কোনমতে জীবনে না করা কাজগুলি করে,পশুর মত খাটুনি খেটে কেউ দেশে ফিরে এসে ঋণ শোধ করে,কেউবা জীবনের তাড়নায় রয়ে যায় প্রবাসে,চালিয়ে যায় জীবন যুদ্ধ।স্বপ্ন মোড় নেয় অন্যদিকে। ততক্ষ্ণণে কিন্তু প্রায় সব শেষ। আমি স্বচক্ষে এমনও দেখেছি,যে ছেলেটি ব্যারিস্টার হবে ‘ল’ পড়ে, এমন আশায় কঠিন পরিশ্রমও করেছে,মাসের পর মাস কোচিং করেছে, ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হওয়ায় গ্রামের ছোট এক কুলিং কর্ণারের মালিক।কারণ পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় পরিবারের গ্লানি,ছোট ভাই-বোনের লেখা-পড়া, বিয়ে-শাদী,বৃদ্ধ মাতা-পিতার চিকিৎসা।অনন্যোপায় সে।নিমিষেই কিছু স্বার্থলোভী মানুষের কারণে ভেংগে চুরমার হয়ে গেল সাজানো সব স্বপ্ন।আজ মেধা, প্রতিভা সব থাকতেও সে যেন বোবা, প্রতিবন্ধী এক শিক্ষিত যুবক।

যারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে জীবনের নিষ্টুর,কঠিন এক বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে গেল,উত্তাল সাগরে বয়ে চলা নৌকার পালটি যার হাত থেকে নিমিষেই খসে পড়ল, তাদের জন্য আমার পরম মর্মব্যথার পাশাপাশি শান্তনা হল,আজকে আপনি হেরে যান নি,হেরে গেছে মানবতা। হেরে গেছে সমাজের স্বার্থপর এক ছদ্মবেশী অর্থলিপ্সু জাতি।হেরে গেছে শান্ত,ভদ্র, শিক্ষিত ও সরল যুবকের বিশ্বাসের কাছে বর্ণচোরা, দালাল ও বণিক সমাজ।ধিক তাদের প্রতি,শত ধিক যারা সম্ভাবনাময়, টগবগে,মেধাবী, প্রতিভাবান তরূণ -যুবকদের আস্থার প্রতি প্রতারণা করে আজ সমাজে এলিট শ্রেণীর পরিচয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়।ব্যথাতুর হৃদয়ের শত শত অভিশাপ তাদের প্রতি।দেখবে তোদের ঘৃণিত আত্না, সাময়িক প্রতারিত সত্য-নিষ্ঠ যুবকগুলি একদিন ঘুরে দাঁড়াবেই।সবকিছু মহান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে,তারই ইচ্ছাই হিসেবে মেনে নিয়ে আত্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে সত্য-ন্যায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে ছাড়বেই ইনশাআল্লাহ। কারণ ব্যর্থতাই সফলতার চাবিকাঠি এ কথাটি তাদের সবারই ভাল করে জানা আছে।

আসলেই প্রকৃত সত্য হচ্ছে বান্দার প্রতি অতি করুণাময়, রহমান- রহিম আল্লাহরর সিদ্বান্তই চূড়ান্ত। যদিওবা অনেক ক্ষেত্রে বান্দা হিসেবে তা বুঝতে পারা বা বুঝে উঠা আমাদের দুর্বল ঈমানের কারণে হয়ে উঠে না।অনেক ক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টা ও চাওয়া অনুযায়ী কোন বিষয় না হলে বা না পেলে আমরা কত কিছকেই না দোষারোপ করি,ব্যথিত হই। পরবর্তীতে বুঝতে পারি আআল্লাহু পাকের ইচ্ছাই ভাল ছিল।
অতএব, সতর্কতা, সাবধানতা ও পরিশ্রমের পাশাপাশি মহান আল্লাহর সিদ্বান্তের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আর এও মনে রাখতে হবে যে,যে আল্লাহর প্রতি সর্বাবস্থায় নির্ভরশীল হয়ে পড়্রে তার জন্য একমাত্র তিনিই যথেষ্ট।আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

সতর্কতা ও করণীয় :
উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি কোনমতেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে যাওয়া মানেই নতুন কিছু শেখা, পৃথিবীকে কাছে থেকে জানা ও বিভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতা অর্জন হওয়া। সংকীর্ণ চিন্তা ভাবনা থেকে সরে এসে মন মানষিকতার বিকাশ সাধন হয় অতি সহজেই।তবে এক্ষেত্রে খুব বেশি সাবধানতা ও সতর্কতা আবশ্যক।আজকে তথ্য প্রযুক্তির যুগে নিজেই একটু চেষ্টা করলে সব তথ্য ভালভাবে জেনে নেওয়া যায়।কিংবা যে দেশে যাওয়া হচ্ছে ঐ দেশ থেকে পড়ে আসা বা অধ্যয়নরত ভাইদের সাথে পরামর্শ চাওয়া যেতে পারে। এতে করে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে যায়।

লেখকঃ লেকচারার,ইসলামিক ষ্টাডিজ বিভাগ
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।