Sayeed Ibrahim Ahmed

ইংরেজীতে প্রবন্ধটি লিখেছেন Sayeed Ibrahim Ahmed, senior lecturer in Finance, AIUB.

“..এই শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবেনা-  স্রষ্টার কৃপায় এই জাতি স্বাধীনতার নবজন্ম লাভ করবে – এবং জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাবেনা “, ১৮৬৩ সালে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের এই উক্তিটি সাম্প্রতিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যা এবং গত কয়েক বছর ধরে চলমান ট্রাম্প প্রশাসনের অসাংবিধানিক কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে বস্তুত প্রশ্নবিদ্ধ।
২০১৬ সালের নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে আমেরিকান কর্পোরেশনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষে কর্পোরেট কর কমাতে তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলো। তবে  চলমান অতিমারি (Pandemic) এসব নীতি ও এর সুবিধাভোগীদের ব্যাপারে অনেক আমেরিকানদের মনে চিন্তার অবকাশ তৈরি করেছে।
একই অবস্থান গ্রহণ করা যায় সদ্য বাংলাদেশ সরকার প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ব্যপারেও। এটিকে গরীব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাজেট বলা হলেও তা সত্যের অপালাপ মাত্র।
গড়পড়তা বাংলাদেশিদের কথা ভাবুন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের অধিকাংশ সময় কেটে যায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছোটাছুটি করতে করতে। ঢাকা শহরের তীব্র গরমে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করার জন্য তারাও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ব্যবহার করতে পছন্দ করে। দিনভর কঠোর পরিশ্রম করেও এই  অতিমারিতে (প্যান্ডেমিক) কাজের ফাঁকে বিদেশে থাকা আত্মীয় পরিজনদের খবরাখবর নিতে মোবাইল ফোনে তারা কিছু সময় ব্যয় করতে চায়।
এসব সেবা এখনও দেশের গড়পড়তা নাগরিকের নাগালে থাকলেও ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এসব সেবা তারা আগের মতো ভোগ করতে পারবেনা।
এসব ছোট ছোট বিলাসিতা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভাল নাগরিকের সনদ লাভের জন্য একই ব্যাক্তিদেরকে বছর শেষে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। করমুক্ত আয়সীমা ২,৫০,০০০ টাকা থেকে ৩,০০,০০০ টাকায় উন্নীত হওয়ায় কিছু মানুষ খুশিতে লাফালেও গড়পড়তা নাগরিকের এতে কোন সুবিধা হবেনা।
অতিরিক্ত কিছু ব্যয়যোগ্য আয় প্রাপ্তি হলেও দিনমজুরদের মোবাইল ও পরিবহনের মতো মৌলিক সেবা বাবদ খরচ বেড়ে যাবে। প্রধান নির্বাহী ও মধ্যম সারির কর্মকর্তারা প্রায় সমপরিমাণ কর পরিশোধ করবেন।
যেমন আগের আয়করের হিসাব অনুযায়ী কেউ ৪৭,৫০,০০০ টাকা আয় করলে তাকে কর হিসেবে পরিশোধ করতে হতো ৯,৮৫,০০০ টাকা। যদি আমরা ২০২১ সালের জন্য প্রস্তাবিত আয়করের হিসাব কে বিবেচনা করি, তবে ঐ একই ব্যাক্তিকে কর প্রদান করতে হবে ৯,৮২,০০০ টাকা।
ব্যাপারটা মজার হয়ে উঠে এই জায়গায়, আগে ৪৭,৫০,০০০ টাকার বেশি আয়ের জন্য করের হার ছিলো ৩০%, এখন যেখানে ১,৬০,০০,০০০ টাকার বেশি আয়ে করের হার ২৫%। ধরা যাক এক ব্যক্তির বার্ষিক আয় ১ কোটি টাকা। সে ৪৭,৫০,০০০ টাকার অতিরিক্ত আয়ের জন্য কর হিসেবে আগে যেখানে পরিশোধ করতো ৳ ১৫,৭৫,০০০  এখন পরিশোধ করবে ৳ ১৩,১২,৫০০ ।
সবার কাছে স্পষ্ট যে, পক্ষপাতীত্বের চর্চা এখনও ধনীদের নিয়ন্ত্রণে। গরীব-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রক্ত, ঘাম ও অশ্রুর মাধ্যমেই পুঁজিপতি ও শাসকগোষ্ঠীর অধিকাংশ আয় অর্জিত হয়। তাছাড়া এককালীন ১০% কর পরিশোধের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার যে  প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা কেবল ঐ দুস্কর্মীদের বরাবরের মতো তাদের প্রতারণাপূর্ণ পন্থা অবলম্বনে উৎসাহীত করবে, কারণ তারা জানে যে এরূপ সুযোগ  ভবিষ্যতেও চলমান  থাকবে।
কেউ কেউ বলতে পারেন যে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ে  আরোপ করা  ৫০% জরিমানা অবৈধ পুঁজিপ্রবাহকে রোধ করবে, কিন্তু ওভার ইনভয়েস বা আন্ডার ইনভয়েস হওয়া ফরমাশের (order)  সঠিক সংখ্যা কিভাবে জানা যাবে?
কোম্পানি আইন ১৯৯৪ সংশোধনের মাধ্যমে দ্রুত ব্যবসায়িক নিবন্ধকরণ ও বিরোধ নিষ্পত্তির কোম্পানি হিসেবে ‘একক-ব্যক্তি সত্ত্বা’ গঠনের লক্ষ্যে নেওয়া আইনি সংশোধনের পদক্ষেপ  ‘প্রাপ্তির স্বচ্ছ ঘোষণার’ (টিডিআর) বিপরীতদিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে।
ব্যাক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে জমানো টাকার উপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করাটা অধিক মানুষদের কর জালে নিয়ে আসার সরকারী উদ্যোগের দ্বৈত সংকট বৈকি। মধ্যবিত্ত শ্রেণী ব্যাংকে আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হবে, যার ফলে ব্যাংক যে অহেতুক দুর্দশায় ইতিমধ্যে পতিত হয়েছে তা আরও তীব্রতর হবে।
ব্যাংকিং খাতে  কররেয়াত সুবিধা যেমন দেওয়া হয়নি, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও কোন ধরনের প্রণোদনা পায়নি। স্বল্প বিনিয়োগ চাহিদা ও অসংগত ঋণ দিয়ে ব্যাংক কিভাবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বিশ্বব্যাংক যেখানে জিডিপির ১.৬% প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে, সেখানে জিডিপির  ৮.২% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা  নির্ধারণ এবং অবাস্তব রাজস্ব আয়ের কর্মসূচীতে  বিদ্যমান গাণিতিক ফাঁকিবাজি বুঝতে সাধারণ মানুষদের খুব গভীর চিন্তার দরকার হয়না। এই বছরের বেসরকারি বিনিয়োগ ধরা করা হয়েছিল জিডিপির ১২.৭%, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে পরবর্তী বছরের জন্য এই হারকে  দ্বিগুণ করে ২৫.৩% নির্ধারণ করা হয়েছে!
সবার দ্বিমত থাকলেও অর্থমন্ত্রী বিশ্বাস করেন যে এই অতিমারি (প্যান্ডেমিক) চলাকালীন সময়েও বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হবে ১৬.৭ %, যা এখনকার প্রায় দ্বিগুণ!  এমনকি একজন অর্থনৈতিক পরিভাষায় অনভিজ্ঞ ব্যাক্তিও বলতে পারবে যে অতিমারির কারণে মন্থর অর্থনীতিতে এই প্রাক্কলন হাস্যকর ও অর্জনযোগ্য নয়, এবং বেসরকারি খাতে স্বল্প ঋণ-লভ্যতার কারণে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া আরও মন্থর হয়ে পড়বে।
কৃষি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেকে বর্ধিত বরাদ্দের প্রত্যাশা করলেও এই খাতগুলোতে বলতে গেলে কিছুই দেয়া হয়নি। অতীত পর্যালোচনা অনুযায়ী বরং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দ কমিয়ে আনা হয়েছে  ৯,৮৩৬ কোটি টাকায়। পরিহাসের বিষয় হলো করোনা অতিমারি (প্যান্ডেমিক) মোকাবিলায় আলাদা করে ১০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা হেতু প্রস্তাবিত সামগ্রিক বরাদ্দের চেয়ে বেশি।
সামাজিক সুরক্ষা জাল কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ নির্ধারন করা হয়েছে ৯৫,৫৭৪ কোটি টাকা – গত বছর যা ছিলো ৮১,৮৬৫ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ জিডিপির ৩.০১ %, কিন্তু  সামাজিক সুরক্ষা জাল থেকে যদি বেসামরিক পেনসন বাদ দেওয়া হয়, তখন বরাদ্দ দাঁড়ায় জিডিপির ১.৫%– যা খুবই নগন্য।
এমআরটি-৫ ( সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্প) এবং এমআরটি ১ ( ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এবং নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্প) ২,০৯১ কোটি টাকার বিশাল অংকের বরাদ্দ পেতে যাচ্ছে।
এই দুই মেগা প্রকল্পের নির্মাণ কাজ এখনও শুরুই হয়নি ভাল করে। নির্মাণ কাজ শুরু করতে যেহেতু বিলম্ব হয়েই চলেছে তবে আরেকটু দেরি হলে কি এমন ক্ষতি হতো? মানুষ যদি বেঁচে থাকে তবেই তো ব্রিজ, রাস্তা এসব ব্যবহার করতে পারবে। অন্যদিকে এসব বরাদ্দ যদি সামাজিক সুরক্ষায় স্থানান্তর করা হয় তবে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার উন্নতি হবে, যেহেতু কাজের খোঁজে মানুষকে ঘর থেকে বেরুতে হবেনা।
১৫,৬৯১ কোটি টাকা  রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য  বরাদ্দের পরিবর্তে  দ্বিপাক্ষিক সহায়তা কমে যাওয়ায় সম্ভাব্য রাজস্ব  ঘাটতি পুরণে ব্যবহৃত হলে তা দ্রুত পুনরুদ্ধারকে সহায়তা করতো।
সর্বোপরি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ বরাবরের মতো অপ্রতুলই রয়ে গেলো। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড এবং ভাইরাসটির সংক্রমণ সীমিত রাখার কোন উপায় থেকে থাকলে তা কেবল শিক্ষা – যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এই রোগের ঝুঁকি সম্বন্ধে অবগত হয়। শিক্ষায় জিডিপির অন্তত  ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার ইউনেস্কোর পরামর্শ থাকা সত্বেও আমাদের বরাদ্দ জিডিপির ২.০৯ শতাংশে স্থির রয়ে গেছে।
তারপরও,  পিপিই তে কর-স্ল্যাব কমানোর প্রেক্ষিতে  স্বাস্থ্য বরাদ্দ গত অর্থবছরের  ২৫,৭৩২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে  নতুন বাজেটে ২৯,২৪৭ কোটি টাকা করাকে ইতিবাচকভাবে দেখতেই হবে!
কর বৃদ্ধি বা হ্রাস প্রাপ্ত অগ্রাধিকার গুলো কারও কারও কাছে বিভ্রান্তিকর হতে পারে। স্বর্ণে আমদানি ভ্যাট কমানোতে সাধারণ মানুষের কোন উপকার হবেনা। বরং এটি আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণের রিজার্ভ বৃদ্ধির একটি তরিকা, যেহেতু সাধারণ ব্যাক্তি বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক বাজার এবং অন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বৈধ ভাবে ‘স্বর্ণের বার’ ক্রয় করতে পারেনা। রসুন, চিনি, ডিটার্জেন্ট, এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন এর মতো স্বল্প খরচের সামগ্রীতে শুল্ক কমানো হয়েছে, কিন্তু বর্ধনশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন ক্ষুদ্র মোটরযান, এসি, এবং ফ্রিজের উপর উচ্চ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
মানুষের অভ্যাসগত পণ্য যেমন সিগারেট ও মোবাইল ফোন বড় পরিমাণে অতিরিক্ত চার্জ বহন করবে। সিগারেটের উপর উচ্চ সম্পূরক শুল্ক ” পাপ কর” হিসেবে জায়েজ করা যায়, কিন্তু “ডিজিটাল বাংলাদেশের” গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ  মোবাইল অপারেটরদের সাথেও একই আচরণ ইতিবাচকভাবে নেওয়া যায়না।
এই বছরের বাজেট আরও সম্যক ও দরিদ্রদের জন্য উদার প্রণোদনায় পূর্ণ হওয়া উচিত ছিলো। এর বদলে তাদের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হলো প্রথম করদাতা হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার ২,০০০ টাকা প্রণোদনা। পশ্চিমা বিশ্বের কল্যাণ রাষ্ট্রসমূহে নাগরিকদের কাছেই ফেরৎ পাঠানোর জন্য যে করারোপ করা হয় এই ধারণা আমাদের দেশের সাধারণ জনগণের বুঝতে আরও অনেক বছর সময় লাগবে।
একটি ‘পুনর্বণ্টন পরিকল্পনা’ সমাজের সকল শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার পরিবেশ তৈরি করে। কিন্তু হায়! আমরা কেবল আশাই করতে পারি! তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা একটি উচ্চমাত্রার বৈচিত্র‍্যহীন অর্থনীতির লাভ হাতিয়ে নিতে থাকবে। যতদিন অবধি ব্যবসায়ীরা আমলাদের ভূমিকা পালন করবে ততদিন  একটি ”ধনীদের জন্য, ধনীদের দ্বারা, ধনীদের বাজেট” প্রণীত হতেই থাকবে।

মূল প্রবন্ধ লিংকঃ  https://bit.ly/2ZNjTz5 

ভাষান্তরঃ রুবেল কুমার শীল, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সহযোগিতায়ঃ ইমরুল শাহেদ, প্রকৌশলী।
রাশেদ রাহগীর, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চবি।