জাহাঙ্গীর আলম


জীবনের সাথে লড়াই চলছে সে অনেক আগ থেকে। সবশেষে বিগত বার বছর ধরে কাজ করে চলছি প্রিয় সংগঠন কোস্ট ট্রাস্টের সাথে। সম্প্রতি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। প্রতিটি দিন প্রতিটি মিনিট বঁচে থাকার আকুল প্রার্থনা কাজ করছিল মনে প্রাণে। ১৭-১৮ জুন ২০২০খ্রি: দুইদিন শরীরে জ্বর ছিল। মনে হয়েছিল হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারব। পরামর্শ নেওয়া শুরু করেছিলাম প্রিয় ডা: আবিদুর রেজা এবং প্রিয় আমিনুল ভাই কাছ থেকে। ১৮ জুন রাতে চিন্তা করলাম কাল সকাল শুরু হলেই অফিসেই চলে যাব। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই কথা বললাম প্রিয় অভিবাবক/বড় ভাই/পিতৃতুল্য সংগঠনের প্রিয় অভিবাবকের সাথে নিজের শরীরের বিষয় নিয়ে। আর দেরী নেই মুহুর্তে অফিসের গাড়িযোগে চলে আসলাম প্রিয় অফিসে আলাদা কক্ষে।
১৯জুন দিন যত গড়াতে থাকে শরীরে অবস্থা বেশ টের পাচ্ছিলাম শরীরটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। একটু পর পর ফোন করে যাচ্ছেন প্রিয় অভিবাবক রেজা ভাই। ওনি বেশ ভালোভাবে বোঝতে পেরেছিলেন আমার অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক নয়। ডা: রিসালাতকে এবং ডা: আবিদুর রেজাকে দিয়ে আমাকে ফোন করিয়েছেন বারবার। সহকর্মী জুলফিকার ডা: রিসালাত এবং ডা: আবিদুর রেজার পরামর্শে অক্সিমিটার দিয়ে বারবার অক্সিজেনের পালস মেপে দেখছিলেন আমার সব আঙ্গুল গুলোতে। কিছু একটা অপর প্রান্ত হতে বোঝতে পারছিলাম কোন বিপদ ঘটতে যাচ্ছে। আমার অক্সিজেনের পালস ছিল ৭২-৭৫ এর মধ্যে।
মুহুর্তেই ডা: আবিদুর রেজা বললেন আংকেল অফিসে আর পাঁচ মিনিটি থাকা ও ঠিক হবেনা এখনি আপনাকে হাসপাতালে চলে যেতে হবে। দুই চোখে অন্ধকার দেখছিলাম এত রাতে কোন হাসপাতালে যাব? কি করব? চোখে মুখে যেন অন্ধকার দেখছিলাম। আবারও প্রিয় অভিবাবকের সাহস “তুমি অফিসের গাড়ি নিয়ে সদর হাসপাতালে রওয়ানা দাও”।
সহকর্মী জুলফিকার, রিয়াজ এবং বাদশার সহায়তায় রওয়ানা দিলাম প্রিয় সহকর্মী শাহিনুরের সহায়তায় সদর হাসপতালে। হাসপাতালে ডুকতেই লাশ আর লাশকে ঘিরেই চারপাশে কান্না। মনটা বেশ ভারী লাগছিল। ততক্ষনে হাসপতালের তত্ত্বাবধায়ককে ফোন করেছেন অনেকে কক্সবাজার চেম্বার এর সভাপতি মোর্শেদ ভাই, সাংবাদিক ইমরুল ভাই এবং চ্যানেই আই এর মানিক ভাই। ধরাধরি করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো মেডিকেল কলেজের চতুর্থ তলায়। চারপাশে নীরব আর আতংক কাজ করছিল সবার মনে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা শেষে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো করোনা রোগীর ওয়ার্ডে। চারপাশে শুয়ে আছে করোনা রোগী। অজানা ভয় কাজ করছিল।
এইবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনরোধ করল রোগীর সাথে রাতে কাউকে থাকতে হবে এবং বাধ্যতামূলক। এমন সময় আমার সকল চিন্তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এলেন প্রিয় সহকর্মী রিয়াজ।
বললেন, টেনশানের কোন কারন নেই। আমি আপনার সাথে থাকব ভাই। পিতামাতার একমাত্র পুত্র সন্তান রিয়াজ। তারদিকে তাকাছিল্লাম আর ভাবছিলাম আমি এমন কি করলাম ছেলেটার জন্য যে এক বাক্যে আমার সাথে রাতে জীবন বাজী রেখে থাকার জন্য রাজী হয়ে গেল!
আমার চোখ থেকে কখন যে পানি গড়িয়ে পড়ল টেরই পেলাম না। অক্সিজেন একটার পর একটা শেষ হচ্ছে। আর মনের মধ্যে অজানা আতংক কাজ করছিল, অক্সিজেন পর্যাপ্ত আছে তো?
ডা: আবিদুর রেজা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ডিউটিরত ডাক্তারদের সাথে প্রতিনিয়ত কথা বলে যাচ্ছিলেন বেশ টেরপাচ্ছিলাম। রাত যত বাড়ছে তত আতংক ও বাড়তে ছিল। বেঁচে থাকার আকুতি করছিলাম মনে মনে।
ঘরে ১১দিনের নবজাতক শিশু কন্যা। একটু কোলে নেয়ার সৌভাগ্যও আমার হয়নি। আর বড় মেয়ের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। সে ১৯ জুন সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি কাপড় গুছিয়ে অফিসে চলে এসেছি।
১৯ জুন ২০২০ খ্রি: হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমার মা কান্না করে যাচ্ছিলেন অনবরত। মায়ের কান্না শোনে বড় মেয়ে আরিয়া বোঝে গিয়েছেন তার বাবার কিছু একটা হয়েছে।
রাত ১১.০০টায় ফোন করলাম প্রিয় ভাবী (মা সমতুল্য) মিসেস রেজা ভাইকে। ভাবীকে বললাম আমি বাঁচতে চাই। ভাবী আমি উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা যেতে চাই। ভাবী এক বাক্যে বললেন, আপনার ভাইকে আমি এখনি বলছি এবং আপনার ভাই আপনার জন্য সর্বোচ্চ করবে আমি তা জানি। পরক্ষণে মোবাইলে প্রিয় কামাল ভাইকেও বিষয়টি জানালাম। ওনি সাথে সাথে আমাকে আশ্বস্ত করলেন এবং অভয় দিলেন। ততক্ষনে প্রিয় অভিবাবক এয়ার এম্বুলেন্স যোগাড় করার কাজ শুরু করেদিয়েছেন কামাল ভাইকে সাথে নিয়ে। প্রতিটি মুহুর্তে আমাকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছেন। সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন।
১৮জুন সকাল ০৭টায় কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ারুল নাসের স্যার ফোন দিয়ে জানলেন আমার খোঁজ খবর।
আমাকে বললেন, তোমাদের অফিস হতে এয়ারএ্যাম্বুলেন্স খোঁজা হচ্ছে। সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমি করব।
২০ জুন ২০২০ খ্রি: সারাদিন আমাকে চট্টগ্রামে যেকোন একটি আইসিউতে নেওয়ার জন্য প্রিয় অভিবাবক পাগল প্রায়। সবার সাথে যোগাযোগ করেই চলছে। আমি তা বোঝতে পারছিলাম। আর আমার শতভাগ বিশ্বাস ছিল, আমার অভিবাবক আমার জন্য কিছু না কিছু করবেই, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সকাল থেকেই আত্নীয় স্বজনদের উপস্থিতি বেশ টের পাচ্ছিলাম। ততক্ষনে এম্বুলেন্স প্রস্তুত চট্রগ্রামে যাওয়ার জন্য। আশা করেছিলাম সাথে যাবে আমার স্ত্রীর বড় ভাই এবং তাতে বেশ ভরসা করেছিলাম। ওনি অন্তত সব চিনে জানে সচেতন মানুষ। মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে অনুরোধ করেছিলাম, ভাই আমার সাথে চলেন। কিন্তু সেদিন কুমিল্লা হতে তাঁর স্ত্রী উখিয়া আসার বাহনা এবং চাকরির বাহনা দিয়ে আর গেলনা। মৃত্যুপথযাত্রী হিসেবে চিন্তা করছিলাম, এম্বুলেন্সে বসে কত কিছুই না করেছি এদের জন্য।
আর আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলল, ভাই তুমি যাও, আমি কাল সকালে আসব। সেই সকাল এখনও হয়নি। কিন্তুটা আইসিউতে বসে কান্না করেছি ঘুমের মধ্যে। লোকটা কি করে না এসে পারল?
এক অজনার মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রামে এম্বুলেন্সে যাত্রা শুরু করেছিলাম।
বারবার শহর দিয়ে বের হওযার সময় ভাবছিলাম এই শহরে আর ফিরতে পারবতো? চুনতি পর্যন্ত গিয়ে প্রিয় আবু মোর্শেদ খোকা ভাই খবর দিলেন, সার্জিস্কোপে একটি আইসিইউ পাওয়া গেছে। কিছুটা শান্তি কাজ করছিল। সার্জিস্কোপে পৌঁছেই আামরা সাথে যাওয়া তিনজনই চলে গেলেন নিজেদের হোটেলে। আর আমাকে নিয়ে গেলো হাসপাতাল কর্তপক্ষ আইসিউতে।
হাসপতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে অক্সিজেন দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু আমার সাথে যাওয়া লোকজনের অনুপস্থিতির কারণে আমাকে চিকিৎসা দিতে তিন ঘন্টা বিলম্ব করেছেন। আমার স্ত্রীর বড় ভাই যদি আমার অনুরোধটুকু রাখতেন হয়তো আমি আরো তিনটা ঘন্টা আগে চিকিৎসা পেতাম। যাই হোক আল্লাহ ওনার মঙ্গল করুক।
পিতৃতুল্য অভিবাবক/বড় ভাই যে অবদান আামাকে বাঁচানোর জন্য আপনি করেছেন আমি সারাজীবন এই উপকারের কথা মনে ধরে রাখব।
আমাদের মনির ভাই সার্বক্ষনিক সাহস যুগিয়েছেন। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
ধন্যবাদ ইউএনএইচসিআর এর কর্মকর্তা সুব্রতদাকে সার্বক্ষনিক খোঁজ নেওয়ার জন্য।
কামাল ভাই মনে থাকবে, আপনার অবদানের কথা আমৃত্যু।

চলবে…


জাহাঙ্গীর আলম ,সহকারি পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট।