আবদুল হাকিম (মাসুম)
পৃথিবীর সকল মানুষের এটাই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হওয়া প্রয়োজন যে, তারা পৃথিবীর জীবনে মানুষ সহ সকল প্রাণীর প্রতি উত্তম আচরণ করবে এবং নিজের অনুপম চারিত্রিক গুণাবলীর মাধ্যমে অন্যের কল্যাণ সাধন করবে। এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের আচরণ সর্বোত্তম হওয়া প্রয়োজন। কারণ মুসলমানদের রয়েছে এ ব্যাপারে আলাদা ধর্মীয় গুরুত্ব ও মর্যাদা।

শুধুমাত্র নামাজ-রোজা, হজ্ব-যাকাত, তাসবীহ- তাহলীলের মধ্যে নিজেকে মগ্ন রাখা এবং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতি সম্পর্কে উদাসীনতার পরিচয় দেওয়ার নাম ইবাদত নয়। নামাজ-রোজা, হজ্ব-যাকাত, তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি মানুষকে দুনিয়া আখেরাতের বৃহৎ কল্যাণ অর্জনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এসব থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তা ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্টীয় জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে হবে, তাহলে যথাযথ ইবাদতের হক আদায় করা হবে ।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছে যে, মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেকে, নিজের পরিবারকে, নিজের এলাকা, রাস্তা- পথ তথা চলাফেরা ও বসবাসের স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে এবং এভাবে নিজের সহ অন্যের কল্যাণ সাধন করবে । নির্মল বাতাস ও ছায়ার জন্যে বৃক্ষ রোপণ করবে, এসব বৃক্ষ থেকে শুধু মানুষই কল্যাণ লাভ করে না, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ অসংখ্য প্রাণীও এসব বৃক্ষ থেকে উপকার লাভ করে। এসব বৃক্ষে পিপিলীকার থেকেও ক্ষুদ্র প্রাণী বাসা বাঁধে, পাখী নিজের বাসস্থান গড়ে তোলে, এর ফরমুল আহার করে, ছায়া লাভ করে, সেই সাথে মানুষ পায় নির্মল বাতাস ।

আল্লাহ পাকের অপরূপ সৃষ্টি বৃক্ষ। বিশ্বের শোভাবর্ধনে বৃক্ষের ভূমিকা অপরিসীম। বৃক্ষের নির্মল বাতাস আমাদের দেহমনে শিহরণ জাগায়। বৃক্ষের বিশুদ্ধ ও হিমেল বাতাস আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে বৃক্ষের ছায়া আমাদের দেহমনে প্রশান্তি ও স্বস্তি আনে। বাতাসে পাতার ঝিরঝিরি শব্দ যেন ইতারের তান। এ তানে শোনা যায় মহান মালিক আল্লাহর প্রশংসা। বৃক্ষ ও মানুষ একে অপরের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। আর সেই অক্সিজেন গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। তেমনি প্রশ্বাসের সাথে আমরা যে কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি তা গ্রহণ করে গাছ বেঁচে থাকে।

একটি গাছ বৎসরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ অপরিহার্য। বৃক্ষ আল্লাহপাকের গুনগান করে। তাঁর ধ্যানে সর্বদা মত্ত থাকে সিজদা করে। পরিপূর্ণভাবে প্রভুর হুকুম মেনে চলে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে “তুমি কি দেখ না, আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আকাশমন্ডলীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র নক্ষত্রমন্ডলী, পর্বতরাজি ও বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে।”

রাসূল (সা:) নিজ হাতে বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইবাদত হিসেবে একে গণ্য করা হয়েছে। নবীজি (সা:) বৃক্ষরোপণ করতে তার উম্মতকে বারবার তাগিদ দিয়েছেন। দেশে প্রচুর পরিমাণ গাছ থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে আমরা প্রশান্তি লাভ করি। ফলে মানুষ সহজে রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় না। জমির উর্বরা শক্তি ও ফলন বাড়াতে গাছের ভূমিকা অপরিসীম। মহানবী (সা:) কৃষিকাজ ও বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করেছেন। যাতে উদ্ভিদ বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ পরিবেশ অক্ষুন্ন থাকে।

আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন, যদি কোনো মুসলিম বৃক্ষ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে, মানুষ কিংবা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে [বোখারি ২৩২০; মুসলিম ৪০৫৫]

বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে হাদিসে বারবার প্রেরণা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ পাককে খুশি করতে হলে, তাঁর কাছ থেকে যথার্থ মূল্যায়ন ও প্রাপ্তি পেতে হলে বান্দাকে বৃক্ষরোপণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বান্দার লালন-পালনে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ থেকে কেউ উপকৃত হলে তার সওয়াব বান্দার আমলনামায় লেখা হবে। বান্দা মরে গেলেও এর সওয়াব কবর থেকে পাবে। বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বৃক্ষ রোপণে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। কোনো বান্দার লাগানো গাছের ফল কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিংবা রোগাক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয় তবুও তার ন্যায্য প্রাপ্তি বান্দাকে দেয়া হবে।
মহানবী (সা:) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষ রোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহপাক তাকে সদকার নেকি দেবেন’ [মুসনদে আহমদ: ১৬৭০২]।

শিশুর পুষ্টির জন্য মায়ের দুধ যেমন অপরিহার্য তেমনি পরিবেশ রক্ষার জন্য বৃক্ষ অপরিহার্য। পরিবেশ শান্ত, শীতল ও মনোমুগ্ধকর রাখে মাটি থেকে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ। অপ্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করাকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করেছেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা:) । তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবে’ (আবু দাউদ: ৫২৪১)।
তবে কোনো গাছ এমন স্থানে অবস্থিত হয় যার জন্য মানুষের চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটে, ঘর-বাড়ির ক্ষতি হয় এবং মানুষের দরকারে কাটার প্রয়োজন হয়, তাহলে গাছ কাটতে কোনো নিষেধ নেই। আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন, ‘আমি এক ব্যক্তিকে দেখেছি জান্নাতে সে ওই গাছের ছায়ায় চলাচল করছে যা সে রাস্তার মোড় থেকে কেটেছিল, যা মানুষকে কষ্ট দিত (মুসলিম: ৫৮৩৭)।

সমকালীন বিশ্বে পরিবেশবিদরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ লাগানোর প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। রেডিও টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে ফলাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে । অথচ আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বৎসর আগে মানবতার মূর্তপ্রতীক মহানবী (সা:) বৃক্ষরোপণের প্রতি বারবার তাগিদ দিয়ে গেছেন। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং বিশ্বকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে আমাদেরকে বৃক্ষরোপণের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

আবদুল হাকিম (মাসুম)
পেশকার পাড়া
কক্সবাজার পৌরসভা
কক্সবাজার।