ভাইরাস হলো জীব ও জড় জগতের মাঝে এক সেতুবন্ধন। কারণ ভাইরাস পোষক জীবদেহের বাইরে নিষ্ক্রিয় জড় পদার্থের মত আচরণ করে এবং অন্যের শরীর ছাড়া ভাইরাস নিজে নিজে বেঁচে থাকতে পারে না। তাই ভাইরাসের বেঁচে থাকার জন্য দরকার একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হওয়া। যখন একটি ভাইরাস আমাদের শরীরে ঢোকে; তখন তার নিজের জীন থেকে ডিএনএ বা আরএনএ আমাদের কোষে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আমাদের কোষের এনজাইম ব্যবহার করেই সে আরও অনেক প্রতিরূপ ভাইরাস কপি তৈরি করে।

ভাইরাসের এই আক্রমণ শুরু হয়ে গেলে আমাদের শরীরও এর বিরুদ্ধে একটা প্রক্রিয়া শুরু করে। আমাদের কিছু কোষ ভাইরাস এন্টিজেনকে ওই কোষপৃষ্ঠে প্রকাশ করে। তখন এটা থেকে আমাদের শরীরের অন্যান্য কিছু কোষ এই ভাইরাস এন্টিজেনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে এবং ভাইরাস ধ্বংস করতে থাকে। এই এন্টিবডি বনাম ভাইরাস যুদ্ধে এন্টিবডি একবার জয়ী হয়ে গেলে আমাদের শরীরের কিছু মেমোরি কোষ এই ভাইরাসের কোডটা ধরে রাখে। এভাবে কিছু ভাইরাসের বিরুদ্ধে সারা জীবন ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যায়, আর কয়েকটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে মাত্র কয়েক মাসের জন্য।

এভাবে কোন জাতির শতকরা প্রায় ৭০-৮০ ভাগের মধ্যে এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেলে পাওয়া যায় ওই ভাইরাল রোগের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি। যেহেতু ভাইরাসের বেঁচে থাকার জন্য তার পোষক শরীর লাগে, কিন্তু যেখানেই ভাইরাস ঢুকবে; সেখানেই এন্টিবডি তৈরি হবে। তাই ভাইরাসের নিজেকেই মারা যেতে হয়। কিন্তু এভাবে হার্ড ইমিউনিটি পেতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে, যা অমানবিক এবং যদি ভাইরাস অনেক মিউটেশন করে তাহলে বারবার এই হার্ড ইমিউনিটির ধাক্কা খেতে হবে।

এখানে ভাইরাস সংক্রমিত রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করে? ভ্যাকসিনের কাজ হলো- রোগাক্রান্ত হওয়ার পর ওই রোগের বিরুদ্ধে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, সেটা রোগ হওয়ার আগেই তৈরি করা। অর্থাৎ আমাদের শরীর আগে থেকেই প্রস্তুত থাকবে ওই রোগের বিরুদ্ধে। এভাবে ভ্যাকসিন রোগের সংক্রমণ কমিয়ে আনে। সমাজের বৃদ্ধ, শিশু ও অসুস্থদের প্রতিরক্ষা দেয় এবং কালক্রমে একসময় রোগটাকে বিলুপ্ত করে ফেলার চেষ্টা করে। যেমন গুটি বসন্ত এখন আর পৃথিবীতে নেই। পোলিও রোগও বিলুপ্ত হওয়ার পথে। কিন্তু ভ্যাকসিন সময় নিয়ে বানানো উচিত। অতি তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিন বানাতে গেলে উল্টো আরও ক্ষতি হতে পারে। অতি তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের উদাহরণ কিন্তু ইতিহাসে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পীতজ্বরের ভ্যাকসিন তাড়াতাড়ি তৈরি করায় পরে দেখা যায় যে, যাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল; তাদের যকৃতে সমস্যা হয়েছে। একবার নতুন একটি পোলিও ভ্যাকসিনে পোলিও দূর না করে উল্টো পোলিও সংক্রমিত করেছিল বেশ কয়েকজনকে। এ কারণে যদিও বর্তমানে করোনা ভ্যাকসিন অতি জরুরি, তথাপি এ নিয়ে তাড়াহুড়া করা অনুচিত।

একটা ভ্যাকসিনের জন্য দুটি বিষয় প্রয়োজন- নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতা। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ ইতিহাসে আমরা আগেই দেখেছি, তাড়াতাড়ি করে ও যথাযথ গবেষণা না করে ভ্যাকসিন বের করায় তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। এতে ক্ষতি দুটি- রোগীর ক্ষতি সাথে আবার জনসাধারণের সেই ভ্যাকসিনের উপর আস্থা কমে আসে। এ কারণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রথম জরুরি কাজ।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রধানত তিন ধরনের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে-
১. ইন্যাক্টিভ ভ্যাকসিন: এক্ষেত্রে করোনাভাইরাসকেই নিষ্ক্রিয় করে মানুষের শরীরে ঢোকানো হবে। এটা দিয়ে আমাদের শরীর সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করবে। এরপর যদি নতুন করে আবার একটা সক্রিয় ভাইরাস ঢুকে পড়ে, তাহলে আমাদের শরীর আগে থেকেই প্রস্তুত। জলবসন্ত, এমএমআর ভ্যাকসিন ও পোলিও ভ্যাকসিন এভাবেই কাজ করে। এ পদ্ধতি আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত এবং প্রচলিত। কিন্ত এই পদ্ধতিতে অনেক মাস লেগে যায় ভ্যাকসিন তৈরি করতে। কারণ ভাইরাসকে আগে কালচার করা লাগে, তাকে নিষ্ক্রিয় করা লাগে ইত্যাদি। এ কারণে মাত্র ১০টা ভ্যাকসিন আবিষ্কারক এ পদ্ধতিতে চেষ্টা করছে করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য।

২. এন্টিজেন ভ্যাকসিন: এ ভ্যাকসিনে করোনাভাইরাসের যে এন্টিজেনটা দিয়ে আমাদের শরীর তার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে, সেই অংশটুকুই বা সেই এন্টিজেনের জন্য দায়ী ভাইরাসের জীনটুকু অন্য একটা ভাইরাস বা ছত্রাক দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করানো হয় যেটা আমাদের ক্ষতি করে না। এটির নিরাপত্তা আরও বেশি কিন্তু কার্যক্ষমতা প্রথমটির মত নিশ্চিত করতে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন প্রোগ্রামে এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয়। ৭৫ এর বেশি এমন ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। আগে হেপাটাইটিস বি, হুপিংকফের ভ্যাকসিন এভাবে তৈরি করা হয়েছিল।

 

৩. এমআরএনএ ভ্যাকসিন: এ ধরনের ভ্যাকসিন হচ্ছে একদম ‘nextgen’ অর্থাৎ এমন কোন ভ্যাকসিন যা এখনো বাজারে নেই। সফল হলে এরা সবচেয়ে নিরাপদ ভ্যাকসিন হবে। এ ভ্যাকসিনগুলোতে যে কাজ করা হচ্ছে, তা হলো করোনাভাইরাসের যেই আরএনএ আমাদের শরীরে প্রবেশ করে অনেকবার প্রতিলিপন করছে, সেই আরএনএকে আলাদা করে শুধু ওটাকেই আমাদের শরীরে প্রবেশ করানো। এমআরএনএগুলো আমাদের কোষে ঢুকে এন্টিজেন তৈরি করবে এবং সেটার বিরুদ্ধে আমাদের শরীর এন্টিবডি তৈরি করবে এটাই পরিকল্পনা। এমআরএনএগুলোকে লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করানো হবে। ৩০টি কোম্পানি কাজ করছে এ বিষয় নিয়ে।

ভ্যাকসিন প্রস্তুতের পর এর নিরাপদ ব্যবহারের জন্য ৪টি ধাপ আছে, যেমন-
১. প্রথমে প্রিক্লিনিক্যাল ধাপ, যেখানে এ ভ্যাকসিনগুলোকে ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে। প্রথমে কিছু কোষের উপর এবং এরপর জীবিত প্রাণী যেমন ইঁদুর বা বানরের উপর পরীক্ষা করে দেখা হবে যে এটা নিরাপদ কি-না, এন্টিবডি তৈরি হচ্ছে কি-না ইত্যাদি। অনেক ভ্যাকসিন এই প্রথম ধাপেই ব্যর্থ হয়েছে।

২. এরপর আসে ফেজ-১। এখানে এ ভ্যাকসিনগুলোকে কমসংখ্যক মানুষের উপর দেওয়া হয়, যেমন ১০-৩০ জন। এদের মধ্যে প্রথমে দেখা হয় যে, কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো কি-না, গুরুতর কিছু হলে ওখানেই সেই ভ্যাকসিনের ব্যবহার শেষ। এরসাথে আবার দেখা হবে যে, এন্টিবডি ঠিকমত কাজ করছে কি-না।

৩. ফেজ-২তে এসে শুরু হবে আরেকটু বড় ট্রায়াল। কয়েকশ মানুষের উপর। কিছু মানুষকে করোনা ভ্যাকসিন এবং কিছু মানুষকে অন্য একটি প্লাসেবো দিয়ে দেখা হবে যে, এই দুই গ্রুপের মধ্যে কী পার্থক্য আছে বা কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি-না। এতদূর এসেও কিন্তু অনেক ভ্যাকসিন আর এগোতে পারে না।

৪. ফেজ-৩ হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি ধাপ। এখানে এসে কয়েক হাজার মানুষের উপর ট্রায়াল হয়। কিছু মানুষকে করোনা ভ্যাকসিন, কিছু মানুষকে অন্য একটা ভ্যাকসিন দিয়ে দেখা হবে যে, তাদের উপর কোন ক্ষতি করা হচ্ছে কি-না। তাদের এক বছর বা তার বেশি ফলোআপ করা হবে, কারণ দেখতে হবে যে, এই এন্টিবডি যে তৈরি হচ্ছে; সেই এন্টিবডিগুলো ন্যূনতম বছরখানেক থাকছে না-কি। আর এভাবেই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লম্বা এক পথ অতিক্রম করতে হয় ব্যবহার উপযোগী হতে।

in-(3).jpg

করোনা ভ্যাকসিনের দৌড়ে আছে প্রায় ১৭০টা গ্রুপ। কিছু ল্যাবে, কিছু মানুষের উপর ট্রায়াল শুরু করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে তিনটি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান।

১. একদম সামনের সারিতে আছে অক্সফোর্ডের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন। তারা আগে থেকেই MERS করোনাভাইরাসের উপর কাজ করছিল। MERS আর কোভিডের মধ্যে মিল থাকায় তারা তাদের এখনকার কাজটাই একটু পাল্টে কোভিড নিয়ে কাজ করা শুরু করে। তাদের চূড়ান্ত ট্রায়ালের কাজ শুরু হয়েছে। এই ট্রায়ালে তারা ৫০০০ মানুষকে তাদের ভ্যাকসিন দেবে, আর ৫০০০ মানুষকে অন্য একটি ভ্যাকসিন দেবে। তাদের বলবে না, কোনটা দেওয়া হয়েছে। এটা দেওয়ার পর এদের প্রতি মাসে ফলোআপ করা হবে যে, কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি-না বা এন্টিবডি তৈরি হচ্ছে কি-না এবং এন্টিবডি তৈরি হলে কতটা কার্যকরি এবং কতদিন বিদ্যমান থাকছে। তাদের ট্রায়াল চলবে ১ বছর, কিন্তু সেপ্টেম্বরে তারা একবার মাঝপথে থেমে দেখবে যে কতটা কাজ হচ্ছে। যদি ভালো কাজ দেখা যায়, তাহলে তখনই মাঠে নামানোর কাজ শুরু করে দেবে। তবে এর পেছনে অনেক কিন্তু থেকে যায়। এই ভ্যাকসিনটাতে বানর থেকে নেওয়া একটা এডেনোভাইরাসে করোনাভাইরাসের আরএনএ প্রবেশ করানো হচ্ছে। এই এডেনোভাইরাসটি আমাদের ক্ষতি করে না। কিন্তু যেহেতু শরীরে ঢুকেছে, আমাদের শরীর তার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করবে বলে আশা আছে। এই ট্রায়াল এখন ফেজ-৩তে আছে।

২. চীন একটি ভ্যাকসিন তৈরি করছে আরেকটি ভিন্ন এডেনোভাইরাস দিয়ে। এই এডেনোভাইরাস মানুষের মধ্যে সাধারণ ঠান্ডা-জ্বর তৈরি করে থাকে। ওই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে, তার মধ্যে করোনাভাইরাসের আরএনএ দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। ফেজ-১ এবং চলমান ফেজ-২তে ভালো এন্টিবডি লেভেল ও খুব জরুরি T-cell response দেখা গেছে। এখন একটাই সমস্যা, এই এডেনোভাইরাস যেহেতু সাধারণ মানুষের এমনিতেই হয়ে থাকে, অনেকের এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে আগে থেকেই ইমিউনিটি ছিল এবং এদের উপর ভ্যাকসিনটা তেমন কাজ দেয় না, যদিও অন্যদের উপর ভালোই কাজ দিয়েছিল। এটার কাজ শেষ হতেও বছরখানেক লাগবে।

৩. সবচেয়ে নতুন প্রযুক্তিতে এসেছে মডার্না কোম্পানির একটা mRNA ভ্যাকসিন, যেখানে করোনাভাইরাসের আরএনএকে লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হবে। সেই আরএনএ আমাদের শরীরে ঢুকে ভাইরাসের এন্টিজেন তৈরি করবে। যার বিরুদ্ধে কাজ করে এন্টিবডি উৎপন্ন হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত নতুন ভ্যাকসিন তৈরি করেছে মডার্না। ৬৩ দিনে এই ভ্যাকসিন শূন্য থেকে একজনের উপর ট্রায়াল করা হয়। এ ভ্যাকসিন অনেক নিরাপদ কিন্তু আসলে কতটা কাজ করে তা দেখা দরকার। জুলাই মাসে ফেজ-৩তে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আরও বছরখানেক লাগবে বুঝতে যে, কাজ হচ্ছে কি-না।

সর্বশেষ কথা হলো, ভ্যাকসিন তৈরি অনেক সময় ও ব্যয়বহুল একটি কাজ। তাড়াতাড়ি করার জন্য অনেকগুলা ধাপে অনেক কিছু জায়গা মত লাগসই হতে হবে। যেটা না হওয়ার সম্ভাবনাও কিন্তু আছে। তবে আশা করা যায়, ১৭০টি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকের কেউ না কেউ কার্যকরী কিছু একটা হয়তো বের করবে।