বিদেশ ডেস্ক:
কাশ্মিরের লাদাখে চীনা বাহিনীর হাতে অন্তত ২৩ ভারতীয় সেনা নিহতের ঘটনায় দৃশ্যপটে উপস্থিতি বাড়ছে রাশিয়ার। ওই হামলার কদিনের মাথায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের উদ্যোগ নেয় মস্কো। এর মধ্যেই রাশিয়া সফরে যান ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। চীন-ভারতের সীমান্ত বিরোধ মেটাতে দৃশ্যত এখন মরিয়া রাশিয়া। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, বেইজিং-দিল্লি বিবাদে মস্কোর কেন এতো উৎসাহ?

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের খবরে বলা হয়েছে, গত দুই সপ্তাহ ধরেই চীন প্রশ্নে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে চলছে দিল্লি। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত তিন সপ্তাহে বিভিন্ন স্তরে রুশ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এবং মস্কোয় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত।

বুধবারের চীন-ভারত-রাশিয়া (রিক) বৈঠকের নেপথ্যেও রয়েছে মস্কো। চীনের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে রাশিয়ার গ্র্যান্ড প্যারেডে যোগ দিতে মস্কো সফরে রয়েছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। এ প্যারেডে যোগ দিতে বুধবার রাশিয়া পৌঁছাবেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

চীনের সরকারি মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস রাশিয়ায় রাজনাথের সঙ্গে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। তবে এমন খবর অস্বীকার করেছে দিল্লি।

এদিকে মস্কো সফরে রাশিয়া কাছ থেকে দ্রুত এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী সরঞ্জাম আমদানি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এ বছরের শেষ দিকে এসব সরঞ্জাম ভারতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। তবে এসব কিভাবে আরও দ্রুত সরবরাহ করা যায় তা নিয়ে রুশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছেন রাজনাথ।

প্রশ্ন উঠছে, পুরনো বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ফের বাড়ানোর ফলে কৌশলগত অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কের ভারসাম্য কী কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হবে? গোটা বিষয়টি কীভাবে দেখবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? রাশিয়াই বা কেন এতটা উৎসাহ নিচ্ছে ভারত-চীন বিবাদে?

কূটনীতিকদের মতে, এখানে প্রত্যেকটি দেশ নিজের স্বার্থের জন্য অন্য দেশকে কাজে লাগাচ্ছে। এক একজনের স্বার্থ এক এক রকম। সেই স্বার্থ যেমন একদিকে বাণিজ্যিক, পাশাপাশি ভূকৌশলের খেলাও তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। গোটা বিষয়টিতে যুক্তরাষ্ট্রের খুশি হওয়ার কারণ নেই; এটা ঠিকই। কিন্তু একে কেন্দ্র করে নতুন করে ভারত-আমেরিকা মতবিরোধ তৈরি হবে — এমনটাও মনে করা হচ্ছে না। দু’দিন আগেই ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, তিনি চীন-ভারতের এই সংকটে মধ্যস্থতা করতে চান।

‘ডিল মেকিং’ ট্রাম্পের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। এক্ষেত্রে তাকে অবজ্ঞা করে ভারতের রাশিয়া-সংযোগ তিনি যে ভালো চোখে দেখবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কূটনৈতিক শিবির এটাও বলছে, আমেরিকা-রাশিয়ার বর্তমান বৈরিতার আবহ থাকলেও ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিই চেয়ে এসেছেন। ফলে দিল্লি যদি কোনও বিষয়ভিত্তিক কারণে মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়, তাহলে পরে নিজেদের প্রয়োজনে রাশিয়ার কাছে পৌঁছাতে ভারতকে কাজে লাগাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

এ বিষয়ে অতীতের উদাহরণ টেনে সাবেক কূটনীতিক রণেন সেন বলছেন, আফগানিস্তান সমস্যার সমাধানের জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন, তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের সঙ্গে কথা বলতে। তবে কূটনীতিকদের মতে, যা করা হবে, তা ওয়াশিংটনকে অন্ধকারে রেখে না করাটাই শ্রেয়। রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভারত-রাশিয়া এস-৪০০ আমদানি চুক্তিটি পুরনো এবং তা করা হয়েছিল ওয়াশিংটনকে জানিয়েই। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রের মতে, এই নিয়ে তাই ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্বেগ বাড়ার কোনও কারণ নেই।

দিল্লির যুক্তি, ভারত-চীন সম্পর্কের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। ট্রাম্প এবং শি জিনপিং-এর সম্পর্ক এখন অহি-নকুল। এখন যদি বেইজিং কারও কথায় কিছুটা গুরুত্ব দেয়, সেটা হলো মস্কো। দুই দেশের বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য স্বার্থ পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি মস্কোও চায়, তাদের সামরিক পণ্যের বিশাল দুই ক্রেতা, ভারত এবং চীনের মধ্যে অস্থিরতা যেন মাত্রাছাড়া পর্যায়ে না পৌঁছায়।

কারণটা যে শুধু বাণিজ্যিক তা-ই নয়, এর ভূকৌশলগত দিকও রয়েছে। এই মুহূর্তে রিক (রাশিয়া, চীন, ভারত), ব্রিকস (ব্রাজিল, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) এবং এসসিও (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন)-এর চলতি বছরের নেতৃত্ব মস্কোর হাতে। ভারত-চীন এই তিনটি সংগঠনেই রয়েছে। রাশিয়া আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় তথা নিজের প্রভাব আরও সংহত করতে এই সংগঠনগুলোকে কাজে লাগাতে উন্মুখ। সেক্ষেত্রে চীন-ভারত সহাবস্থান মস্কোর জন্যও জরুরি। সূত্র: আনন্দবাজার।