আনছার হোসেন:
করোনা কী জয় করা যায়? আমি অবশ্য ‘করোনা জয়’ এই শব্দটাতে বিশ্বাসী নই। আরে ভাই, আপনার পক্ষে কী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব! আপনি কী করোনাভাইরাস চোখে দেখেছেন! হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে! কোনটাই আপনি করতে পারেননি।

আমিও পারিনি। করোনাভাইরাসকে আমি চোখে দেখিনি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। তাহলে অদেখা, অদৃশ্য এক জীবাণুর সাথে আমি কিভাবে যুদ্ধ করবো! সেখানে আবার জয়ী হওয়ার প্রশ্ন কিভাবে আসে!

আসলে করোনাভাইরাস নামের ওই অনুজীবের সাথে যুদ্ধ নয়, পথ্য দিয়ে চিকিৎসা করা যায়।

বলুন তো, আপনি যুদ্ধ করলেন কখন? আপনি তো পড়ে ছিলেন বিছানায়। জ্বরে আপনি কাবু ছিলেন। কাশি আপনাকে কথাই বলতে দেয়নি। শ্বাসকষ্ট আপনার জীবনের আনন্দই ভুলিয়ে দিয়েছিল। তাহলে যুদ্ধ করলেন কখন!

আমার যখন প্রথম জ্বর জ্বর ভাব হলো, সেটা ছিল তিনদিন। তারপর জ্বর এলো, সেটাও আবার ১০০ ডিগ্রীর নিচে। তারপরও আমি পাঁচদিন কিছু খেতে পারিনি। পানি খেয়েছি ‍বিছানায় শুয়ে কোল্ড ড্রিংকের স্ট্র দিয়ে! ওই পাঁচদিন পানি আর ওষুধ ছাড়া কিছুই খেতে পারিনি। বিছানা থেকে উঠার শক্তিও আমার ছিল না। করোনা প্রথম টেষ্ট দিতে যখন হাসপাতালে যাচ্ছিলাম, তখনও আমার শরীরে শক্তি ছিল না। মোটর সাইকেল চালিয়ে নয়, মোটর সাইকেলের পেছনে বসে হাসপাতালে গেছি।

তাহলে আমি ‘যুদ্ধ’ করলাম কই?

আসলেই আমি যুদ্ধ করিনি। যুদ্ধ করার শক্তিও আমার ছিল না। আর অদৃশ্য শক্তির সাথে ‍কখনও যুদ্ধ করা যায় না। তেমন ভাবে করোনাভাইরাসের সাথেও যুদ্ধ করা যায় না। যারা বলছেন, ‘করোনা যুদ্ধে জয়ী’ তারা আসলে শিরকী কথা বলছেন।

আমি বিশ্বাস করি, করোনা নামের মহামারি দিয়েছেনও আল্লাহ, সুস্থ করছেনও আল্লাহ। এখানে আমাদের হাত শুধু কিছু ওষুধ খাওয়া আর গরম পানির ভাপ, গরম পানির গার্গল আর লেবু, আদা, লবঙ্গ, দারুচিনি মিশ্রিত গরম পানি খাওয়া পর্যন্ত।

অতএব, দয়া করে কেউ বলবেন না, আপনি ‘করোনা যুদ্ধে জয়ী’ হয়েছেন। বলুন, ‘করোনামুক্ত’ হয়েছেন, নয়তো বলুন, সুস্থ হয়েছেন।

করোনা মুক্তির মন্ত্র কী ছিল
করোনাভাইরাস যেভাবে বিশ্বজুড়ে তার অদৃশ্য তান্ডব চালাচ্ছিল, তা আমার জানা-ই ছিল। তাই আমি কোন অবহেলা করিনি। প্রথম যে দিন আমার উপসর্গ দেখা দেয়, তখনই আমি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করি। সেদিন ছিল ঈদের পরদিন। ওইদিন রাতে আমার পরিচিত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ইউনুস ভাইয়ের সাথে (মেডিসিন বিশেষজ্ঞ) ফোনে যোগাযোগ করি।

প্রথমদিন আমার কোন জ্বর ছিল না। জ্বর উঠার আগে যে শিরশির করা ভাব হয়, সেটিই ছিল। ডা. ইউনুস পরামর্শ দিলেন, জ্বরের জন্য নাপা এক্সটেন্ড, সাথে যেন এন্টিবায়োটিকও শুরু করে দিই। আমি ‍উল্টো প্রশ্ন করি, আমার তো জ্বর নাই, তাহলে এন্টিবায়োটিক কেন! তিনি সুন্দর বলেছেন। বললেন, এখন যখন করোনাকাল এন্টিবায়োটিকটা শুরু দেন। সাথে যেন ‘স্কেবো ৬’ নামের একটি ট্যাবলেটের দুটো ডোজ খেয়ে ফেলি। এক সপ্তাহ পর যেন আরও দু’টো। আমি তাই করলাম।

পরে সেই ওষুধে যুক্ত হলো ভিটামিন সি ট্যাবলেট, ভিটামিন ডি ট্যাবলেট আর জিংক বি ট্যাবলেট। সাথে সকাল-রাতে দুইটি গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট।

ডা. ইউনুস ভাইয়ের পর বন্ধু ডাক্তার শাহজাহান নাজিরের সাথে পরামর্শ করলাম। সে আবার কক্সবাজারে একমাত্র সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ। সে-ও প্রায় একই রকম পরামর্শ দিল। তবে সাথে একটি ওষুধ যুক্ত করে সে, সেটি গ্যাষ্ট্রিকের ওষুধ।

এই তো গেলো ডাক্তারি চিকিৎসা। এবার আসুন প্রাকৃতিক চিকিৎসায়।

বড় সাইজের একটি লেবু, আদা, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি, সামান্য সরিষার তেল আর এক চিমটি হলুদের গুড়া পানিতে দিয়ে তা গরম করে সেই গরম ভাপ প্রতিদিন তিন থেকে চারবার, সরিষার তেল আর হলুদের গুড়া বাদ দিয়ে প্রায় একই রকম উপাদান দিয়ে গরম পানি খাওয়াও চলতে থাকে। তবে গরম পানির গার্গলটা আমি করতে পারিনি।

এই দুই চিকিৎসার সাথে আমি চালিয়ে যাই কুরআনিক চিকিৎসাও। কী সেই চিকিৎসা?

কুরআনিক চিকিৎসার সবটা অবশ্য আমি করতে পারিনি। শুধু সকাল বেলা মধু আর কালো জিরা খেয়েছি। এই দু’টি জিনিসকে আল্লাহর রাসূল (স.) মৃত্যু ছাড়া সব রোগের ওষুধ বলেছেন। রাসূলের (স.) এই বাণীর প্রতি আমার রয়েছে পূর্ণ বিশ্বাস।

মুফতি কাজী ইব্রাহিমকে নিশ্চয় অনেকেই চেনেন। তিনি ইতালি প্রবাসী এক যুবকের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেছেন। ওই যুবক স্বপ্নে ‘করোনাভাইরাস’ নামের অদৃশ্য ভাইরাসটির সাথে কথা বলেছেন। অনেক কথার মাঝে করোনাভাইরাস নিজেই তার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য একটি ফর্মূলা দেয় ওই যুবককে। সেই ফর্মূলাটি ছিল 1.Q7+6=13।

মুফতি ইব্রাহিম সেই ফর্মূলাটি একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 1 মানে এক আল্লাহ। এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস। Q মানে কুরআন। 7 মানে কুরআনের প্রথম সূরা ফাতেহার ৭ আয়াত। আর 6 মানে হলো মধু, কালো জিরা, তীন ফল, জয়তুন ফল, খেজুর আর জমজমের পানি।

মুফতি ইব্রাহিমের এই ফর্মূলার প্রতি আমার কেন জানি না, শতভাগ বিশ্বাস জন্মেছে। তাই এই থিউরিটাও আমি ফলো করেছি। তবে সবটুকু করতে পারিনি। যা পেরেছি তা হলো, মহান সেই আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছি। মাঝে মাঝেই সূরা ফাতেহা ৭ বার পড়ে পানিতে ফু দিয়ে সেই পানি পান করেছি। আর খেয়েছি মধু, কালো জিরা আর জমজমের পানি। বাকি তিনটির মধ্যে এক-দুইদিন খেজুর খেয়েছি। তবে তীন আর জয়তুন ফলের দেখা পাইনি বলে খাওয়া হয়নি।

আমার করোনাভাইরাস টেষ্টের রিপোর্ট আসে ২ জুন। মনে আশা ছিল, আমার পজিটিভ আসবে না। কিন্তু না, রিপোর্ট এসেছে পজিটিভ। সাথে আমার এক চাচাতো ভাই ইমনের রিপোর্টও পজিটিভ।

এবার আরেক দফা ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলাম। ডা. ইউনুস ভাই একটি ওষুধ চেঞ্জ করলেন। এজিথ্রোমাইসিনের স্থলে ডক্সিক্যাপ ১০০ এমজি দিনে দুইবার খেতে বললেন। আর সবগুলো চালিয়ে যেতে বললেন।

তিন ধরণের চিকিৎসাই এক সাথে চালিয়ে গেলাম। তবে আমার বিশ্বাস, ওষুধ শুধু খেয়েছি। এটি কেবল উপলক্ষ মাত্র। আসলে সুস্থতার মালিক কেবল তিনিই, যিনি এই জগতটাকে সুন্দর করে পরিচালিত করছেন। তিনিই তার বান্দাদের অসুখ দিয়ে পরীক্ষা করেন, আবার তিনিই সুস্থ করে দেন।

সেই মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার ভাষা আমার নেই। নিশ্চয় দয়াবান আল্লাহ আমার এই অযোগ্যতা মাফ করে দেবেন। তবে পৃথিবীর কোটি কোটি বিশ্বাসী মানুষদের মাঝে আমিও একজন।

কৃতজ্ঞতা
ভালোবাসা কিংবা আন্তরিকতা মাপার কোন যন্ত্র কী পৃথিবীতে আছে! যদি থাকতো আমি একবার মেপে দেখতাম। আমার জন্য এই মানুষ গুলোর ভালোবাসা, দরদ, সহমর্মিতা ও আন্তরিকতার স্কেলটা কতটুকু উপরে আছে! সেই মাপটি হয়তো আমি করতে পারবো না, কিন্তু তাদের জন্য আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা মেপে দেখাতে পারবো না। তবে আপনাদের বলছি, সেই কৃতজ্ঞতার মাপকাঠি ‘অসীম’!

আমি অসুস্থ হওয়ার পর কত মানুষ যে আমার খবর নিয়েছেন, আমার জন্য দূর থেকে দোয়া করেছেন, মসজিদে মসজিদে দোয়া পড়িয়েছেন, ঘরে ‘ভালোবাসা’ পাঠিয়েছেন, আমি সেই ভালোবাসা, আন্তরিকতার জবাব দেয়ার ভাষা আমার নেই। নাম জানা, নাম না জানা সেই সকল মানুষের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা।

আমি করোনা পজিটিভ হওয়ার ৬ দিনের মাথায় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসিনতা নিয়ে একটি ফেসবুক লাইভ করেছিলাম। সেই ফেসবুক লাইভ দেখে কত মানুষ অঝোরে কেঁদেছেন আর আমার জন্য দোয়া করেছেন সেই খবরের কিছু কিছু আমি পেয়েছি। অথচ যারা আমার জন্য চোখের পানি ফেলেছেন তাদের সাথে আমার রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। অনেকের সাথে আমার কখনও দেখাই হয়নি। অথচ একজন অচেনা, অজানা পর্যটন শহরের একজন অল্পজানা সাংবাদিকের অসুস্থতায় তারা চোখের পানি ফেলেছেন। সেই কৃতজ্ঞতা আমি কিভাবে প্রকাশ করবো? আমার ভাষা নেই।

বলতে চাইলে অনেকের নাম বলা যায়। কিন্তু নাম বলতে গেলে আবার অনেকের নাম মানুষ হিসেবে আমার ভুলে বাদ পড়ে যাবে, তাই কারো নাম বলতে চাইছি না। সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।

করোনা নামের অসুস্থতায় এমন অনেকেই আমার খোঁজ নিয়েছেন যাদের আমি কখনও আশা করিনি। এমনও কেউ খোঁজ করেছেন, যার সাথে আমার ২৫ বছর ধরে যোগাযোগ নেই। তার কণ্ঠটাও ভুলে গিয়েছিলাম। তেমন মানুষও বহু চেষ্টায় নাম্বার সংগ্রহ করে আমার অসুস্থতার খোঁজ নিয়েছেন। এটি আমি কেমন করে ভুলি।

আপনাদের সবার প্রতিই আমার কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা। আপনাদের এই আন্তরিকতার উত্তম প্রতিদান আল্লাহ আপনাদের দেবেন। তিনিই সবকিছু দিতে পারেন, আমরা তো অবলা মানব, আমাদের এই পৃথিবীতে তেমন কিছুই করার ক্ষমতা নাই। অথচ আমরা ক্ষমতার বড়াই করি মাত্র।

ইদানিং দেখি কেউ একজন অসুস্থ হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ব্যক্তির সুস্থতা চেয়ে দোয়া কামনা, আবার অসুস্থ মানুষকে তিরস্কার করে তীর্যক মন্তব্য করতে দেখা যায়। মহান আল্লাহর শুকরিয়া, আমার অসুস্থতায় তেমন কিছু চোখে পড়েনি। এটা মহান আল্লাহর বড় রহমত। প্রতিটি মানুষ আমার সুস্থতা চেয়ে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছেন।

সেই সকল মানুষরা আমার অন্তরে রয়ে যাবেন। ইয়া আল্লাহ, শেষ বিচারে এই মানুষ গুলোকে তুমি নাজাত করে দিও। ওরা তোমার এক বান্দার জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করেছেন। এই দোয়ার উত্তম প্রতিদান তুমি দিও।

আনছার হোসেন
সম্পাদক
কক্সবাজার ভিশন ডটকম