মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান, পিতা-মৃত-একরামুল হুদা, বয়স-৬৪, কক্সবাজার পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব টেকপাড়ায় বেগম পাড়া গলির মমতাজ ভিলা’য় থাকেন। টেকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটু পূর্বের গলি। শহরের দক্ষিণ টেকপাড়া সিকদার মহল এর পূর্বে বায়তুল মোয়াজ্জেম জামে মসজিদে সহকারী ইমাম হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় ৩ যুগ ধরে। মসজিদে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় তার শরীরে জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা সহ করোনা ভাইরাস উপসর্গ দেখা দেয় ২২ মে সকাল থেকে। হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান-কে মসজিদ কমিটির লোকজন একইদিন বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ফলে বাড়িতেই পরিবারের অন্যান্য সদস্য সবাই আতংকিত হয়ে যায়, তারাও করোনা সংক্রামিত হওয়ার ভয়ে। ২৩ মে সকালে হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান-কে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। সেখানে তারা স্যাম্পল সংগ্রহ করে সদর হাসপাতালের আইসোলেশন আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করান। পরদিন ২৪ মে রাত ৮ টার দিকে হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান-এর স্যাম্পল টেস্টের রিপোর্ট ‘পজেটিভ’ আসে। একইদিন কক্সবাজার সদর উপজেলায় ১১ জন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়। সেদিন ছিলো ঈদুল ফিতরের আগের রাত। এসব কারণে হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান-কে রাত একটার দিকে রামু ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিতে সদর হাসপাতাল থেকে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তত্বাবধানে এম্বুলেন্স যোগে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানে ২৫ মে রাত থেকে ৪ জুন বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ছিলেন তিনি। হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান-এর বর্ননা মতে, রামু’তে থাকা এই ৯ দিন রামু ডেডিকেটেড আইসোলেশন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার শরীরের বিন্দু পরিমাণ উন্নতি হয়নি। বরং সময় সময় তার শরীরের অবস্থার অবনতি হয়েছে। তার বর্ননাতে দেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা ও ভয়ংকর করোনা পরিস্থিতি সামলানোর জন্য রাষ্ট্র অপ্রস্তুত থাকার চিত্র ফুটে উঠেছে স্পষ্টভাবে। সীমিত সম্পদ সম্পদ ও অপ্রতুল সুযোগ দিয়ে ঢাল, তলোয়ার বিহীন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী, আয়া, ওয়ার্ডবয় সহ সংশ্লিষ্ট সবার অসহায়ত্ব ছিলো চোখে পড়ার মতো। করোনা ভাইরাস যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনের অকুতোভয় সেনানীদের চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করা ছিলো না। তাঁদের হাত মুখ বন্ধ। দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ন্যুনতম চিকিৎসা বান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য যে সুবিধা ও উপকরণ দরকার তার ৬০%-৭০% সেখানে নাই। যেখানে অপর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রীর কারণে, সময়মতো ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসক সহ গত ১৪ জুন পর্যন্ত ৩৫ জন চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন। সেখানে রামু ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালের সম্মুখ যোদ্ধাদের রাষ্ট্রের ভঙ্গুর ও দুর্নীতিগ্রস্থ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাছে নিজেদের আত্মসমর্পিত হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই।

অবস্থা দেখে হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান-এর স্বজনেরা তাকে রামু ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে উখিয়ার SARI Isolation & treatment centre এ ভর্তির ব্যবস্থা করেন। ৮ জুন বেলা আড়াইটার দিকে উখিয়া SARI Isolation & treatment centre এ হট নাম্বারে ফোন করার পর পরই কোন বিলম্ব ছাড়া রামু ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে বিকেল সাড়ে ৩ টার দিকে এম্বুলেন্স চলে আসে। হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান-কে রামু থেকে উখিয়া SARI Isolation & treatment centre এ নিয়ে যায়।

টিনের চাউনি, বাঁশের বেড়া। ১৪৪ শয্যা বিশিষ্ট এ Isolation & treatment centre টি নির্মাণ করা হয়েছে মাত্র ৪০ দিনে। জাতিসংঘের অংগ প্রতিষ্ঠান UNHCR এর অর্থায়নে এনজিও ব্র্যাক এর তত্বাবধানে নির্মাণ করা হয়েছে এ আইসোলেন চিকিৎসা সেন্টার। উদ্বোধন করা হয় ২১ মে। আনুষাঙ্গিক প্রস্তুতি, রিহার্সেল, ঈদুল ফিতরের বন্ধ সব কিছু মিলিয়ে রোগী ভর্তি শুরু করা হয় ২৭ মে থেকে।

হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান-এর বর্ননা অনুযায়ী SARI Isolation & treatment centre আর রামু ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালের মধ্যে পার্থক্য হলো-করোনা চিকিৎসায় রোগীদের জন্য স্বর্গ আর নরক এর মতোই। তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনা সংকটে উখিয়া SARI Isolation & treatment centre কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় অনেকটা “মায়ের দুধ” এর মতোই। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিজের চিকিৎসার জন্য হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান পর পর ২ টি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ায় ২ টি হাসপাতালের চিকিৎসা সুবিধা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি সহজেই পার্থক্য করতে পেরেছেন বলে জানান।

উখিয়া SARI Isolation & treatment centre টি RELIEF INTERNATIONAL নামক একটি আন্তর্জাতিক এনজিও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন। এখানে একজন রোগী ভর্তি হওয়ার পর রোগী কিংবা রোগীর স্বজনদের কিছুই করতে হয়না। রোগীর চিকিৎসা, ওষুধ, মান ও পুষ্টি সম্মত খাওয়া দাওয়া, জামা সবকিছুই treatment centre কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে চলে যায়। কোন ওষুধ পত্র, খাদ্য বা অন্যকিছু সেখানে ভিতরে নেওয়া যাবেনা। এটি একটি অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতালের মতো হলেও সবকিছুর প্রতিটি পর্যায়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষার চেষ্টায় কর্তৃপক্ষ আপোষহীন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদারকি ও নজরদারি থাকে ২৪ ঘন্টা। জীবাণুমুক্ত না করে কোন সামগ্রী ভিতরে নেওয়া যায়না।

এসএআরআই-আইসোলেশন এন্ড ট্রিটমেন্ট সেন্টারটির ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল চীফ কো-অর্ডিনেটর কাজী হায়দার জানান, প্রতিদিন ৩শিফটে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, ওয়ার্ডবয় মিডওয়াইফ, ক্লিনার, আয়া সহ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এসএআরআই-আইসোলেশন এন্ড ট্রিটমেন্ট সেন্টারটিতে ডিউটি করে থাকেন। মেডিকেল টিম ও সংশ্লিষ্ট আরো কর্মী সহ মোট প্রায় ২০০ জনের থাকার জন্য আবাসিক ব্যবস্থা উখিয়ার ইনানীতে একটি বড় আবাসিক হোটেলে করা আছে। ২টি বাস ও ২টি আধুনিক মডেলের মাইক্রোবাস নিয়ে তারা যাতায়াত করে। রয়েছেন পুষ্টিবিদ। আবার তাদের ব্রেকফাস্ট সহ ৩বেলা উন্নতমানের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসম্মত খাওয়া, ২বেলা নাস্তা চুক্তিবদ্ধ অপর একটি রেস্টুরেন্ট থেকে আনা হয়। উখিয়ার এই হাসপাতালটিতে সবসময় ২টি এম্বুলেন্স স্টেনবাই থাকবে। ১টি এম্বুলেন্স আভ্যন্তরীণ রোগী আনা নেওয়া করে। অপর এম্বুল্যান্সটি দুরে কোথাও রোগী রেফার করা হলে সেখানে রোগী নিয়ে যায়।

উখিয়ার SARI Isolation & treatment centre টি ব্যবস্থাপনাকারী প্রতিষ্ঠান RELIEF INTERNATIONALএর চীফ কো-অর্ডিনেটর কাজী হায়দার আরো জানান, নরমাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছাড়াও অক্সিজেন সংকটে পড়া রোগীদের ভেন্টিলেটর এর বিকল্প হিসাবে হাই স্পীড মেডিকেল অক্সিজেনের ব্যাবস্থা রয়েছে সেখানে। ১৫ জুন ৪০ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সেখানে ভর্তি রয়েছে। উখিয়ার SARI Isolation & treatment centre টিতে চিকিৎসা সেবা নিয়ে সুস্থ হওয়ার পর হাফেজ মাওলানা মোঃ মাহবুবুর রহমান সহ ১০ জন গত ১৪ জুন নিজ নিজ বাড়িতে ফিরেছেন। এদের ২ জন মহিলা। এটি ছিলো-এখানে সুস্থ হওয়া প্রথম ব্যাচ।

উখিয়া কলেজের একটু দক্ষিণ পার্শ্বে প্রায় ৩ একর জমির উপর কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের সামান্য ভিতরে এই ট্রিটমেন্ট সেন্টারটি চালু করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। অত্যাধুনিক সুবিধা সম্বলিত হাসপাতালটির সকল চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফ, স্বাস্থ্য কর্মী, এ্যাম্বুলেন্স, খাদ্য সহ মাসিক সকল ব্যয়ভার UNHCR (ইউএনএইচসিআর) কর্তৃপক্ষ বহন করে থাকেন।