আবদুল হাকিম (মাসুম):
নিষ্ঠুর করোনার থাবা। অকালে কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। মানুষের সামাজিক রীতিনীতির চরম বিপর্যয়। পেটের চাহিদার তো আর শেষ নেই। আমার মতো মধ্যবিত্তদের অসহায়ত্ব কাকে বুঝাই? কেউ খোঁজও নেয় না, আছে বলে। আবার কারো কাছে মুখও খুলি না, সম্মান যাবে বলে।
নিয়তির বিপত্তি। প্রশাসনের আবার কড়া লক ডাউন। সপ্তাহে দুই দিন বাজার। বৃহষ্পতি ও রোববার। কক্সবাজার পৌরসভাস্থ বড়বাজার।

জুনের ১১ তারিখ বৃহষ্পতিবার। শেষ জ্যৈষ্ঠের সকাল। রোদে মেঘে লুকোচুরি। মুখে মাস্ক পরে বাজারের দিকে পা বাড়াতেই চোখ চানাবড়া। পথে বাজারে মানুষের ঘিচিঘিচি। কোথাও তিল ধারনের ঠাঁই নেই। মানুষ আর মানুষ। মনে হচ্ছে যেন রমজানের ঈদের শেষ কেনা বেচা। উৎসুক মন নিয়ে বাজারে ঢুকলাম। পরিচিত একজন থেকে জিজ্ঞেস করলাম- আজ এত্তো মানুষ কেন? লোকটা ভর্ৎসনা স্বরে বললো- বাঁচার জন্যে লড়াই, আবার মরার জন্যেও লড়াই। তার কথাগুলো ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে মাছের বাজারে ঢুকে গেলাম।
ভিড় ঠেলে ঠেলে মাছের বাজারটা পুরো দুই ছক্কর দিলাম কিন্তু কোনটা কিনবো বুঝে উঠতে পারছি না। কারণ পকেটে টাকা যা আছে তা যদি মাছ কিনতেই শেষ হয়ে যায় তাহলে অন্য তরিতরকারি কিনেই কিভাবে?
লইট্যা মাছ ১৫০ টাকা কেজি, মাইট্যা মাছ ৪০০ টাকা/৫০০ টাকা দরে, এক কেজিতে ৫/৬ টা ধরবে। এতো ছোট। একটু সাইজ বড় হলেই সেদিকে তো তাকানোই যায় না,যা চড়া দাম।
ইলিশ, কোরালসহ অন্যান্য মাছের তো কথায় নেই। একে তো চড়া দাম,তাছাড়া তাজা মাছ তো বাজারেও নেই। কয়দিন আগে জালে ধরা পড়েছে আল্লাহই ভালো জানেন।
মনে শক্তি সঞ্চয় করে কেজি মতো মাছ নিয়ে বুক টান করে ভিড় ঠেলে বের হয়ে পড়ি। কোন মতে মাছের বাজার থেকে বের হয়ে সবজির দোকানের দিকে এগিয়ে যাই। বিভিন্ন সবজির দাম শুনে তো হাত পা অবশ হয়ে যাবার মতো।
টমেটো ৯০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, বেগুন – ঝিঙে ৭০ টাকা কেজি। পকেটের অবশিষ্ট টাকা আন্দাজ করে দাঁড়াইয়া রইলাম কিছুক্ষণ। মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাগ্য ভালো যে, এখানেও মানুষের এমন ভীড় যেন আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের খেলার দিনের ষ্টেডিয়ামের গ্যালারী। সামনে – পিছনে, ডানে- বায়েঁ, মানুষের ধাক্কায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম। না হলে তো ততক্ষণে পড়ে গিয়ে মাটিতে বিছানা পেতে নিতাম।
সাহস নিয়ে সবজি কিনতে গিয়ে দেখি সব বাসি। মনে হয় ফরমালিনে সবজির চেহারা সুরতকে কোন মতে টিকিয়ে রেখেছে। সাতপাঁচ ভেবে আধা কেজি আধা কেজি করে দুই ধরণের সবজি নিয়ে ওখান থেকে সরে পড়ি। এরপর ডিম,পাউরুটি কেনা শেষ করি।
গিন্নির দেওয়া বাজারের খতিয়ান আর মনে পড়তেছেনা। কারন ততক্ষণে পকেটে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। ছোট মেয়েটার আইসক্রীমের বায়না আর বড় ছেলের আবদার হাওয়া হয়ে শুন্যে মিলিয়ে গেলো।
অনেক হতাশা আর নানা অগোছালো ভাবনা নিয়ে বাসার দিকে কোন মতে পা দুইটাকে এগিয়ে দিই। ফিরতি পথে চলতে চলতে মনে পড়ে যায় ঐ লোকটার কথা, যেটার ভাবার্থ এখন ভালো করেই বুঝেই ফেলেছি- বাঁচার জন্যে লড়াই, আবার মরার জন্যেও লড়াই। আর বাঁচা-মরার এ লড়াইয়ে আমার জীবন যদি নি:শেষ হয়ে যায় তাহলে আমার ছোট্ট মেয়ের বায়না ও বড় ছেলের আবদার পূরণও কি নি:শেষ হয়ে যাবে?

আবদুল হাকিম (মাসুম)
পেশকারপাড়া, পৌরসভা, কক্সবাজার।