রাজা সূর্য খাঁ

১২ই জুন, ২০২০ শুক্রবার ”বিশ্ব শিশু শ্রম নিরসন দিবস”। যখন থেকে Social Awareness & Development (SAD) নিয়ে কাজ করছি তখন থেকেই বেশকিছু সচেতনতামূলক কাজ সম্বন্ধে জানার, লিখার ও গবেষণার সুযোগ হয়েছে। SAD বিশ্বাস করে ” Development Depends on Awareness” বা “সচেতনতার উপর উন্নয়ন নির্ভরশীল “। দেশের উন্নয়ন গণসচেতনতা ছাড়া কোনদিনই চিরস্থায়ী হবেনা। সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদির সমস্যা ও সমাধান নিয়ে প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা থাকতে হবে। আবার এই সচেতনতা অনেকাংশে নির্ভর করে সঠিক তথ্যের উপর। সঠিক তথ্যই সমস্যা সমাধানের পথ দেখায়। আর SAD, সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজে গণসচেতনতা সৃষ্টির কঠিন কাজটি করার চেষ্টা করছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই 12ই জুন ”Child Labour Day-2020″/”শিশু শ্রম দিবস-2020″ উপলক্ষ্যে “শিশুর হাতে শ্রম নয়, কলম হোক শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার” শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। এটিতে ‘শিশু শ্রম’ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান, সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কক্সবাজারের প্রেক্ষিতে আলোচনা, কারণ, আইন, প্রভাব ও উত্তরণের বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। International Labour Organisation (ILO) এই দিনটি উদযাপন করছে “COVID-19ঃ Protect Children From Child Labour-2020 ” শিরোনামে।

শিশু শ্রম;
শিশু শ্রমিক বলতে সেই সমস্ত পেশাকে বুঝায় যেটা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাড়ায় (হতে পারে তা চাকরির পদ্ধতির কারণে বা সঠিক নিয়ন্ত্রণের কারণে) এবং যা বয়স অনুযায়ী নয় এবং যেখানে সঠিক দিকনির্দেশকের প্রয়োজন হয় এমন কাজে যদি কোন শিশু ব্যবহৃত হয় তবে তা শিশু শ্রমিকের পর্যায়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে বৈশ্বিকভাবে, প্রায় 21 কোটি 15 লক্ষ শিশু কাজ করে তার মধ্যে আবার অনেকে পূর্ণ সময় কাজ করে। এদের অনেকেই স্কুলে যায় না, সঠিক পুষ্টি পায় না এবং খেলাধূলার পর্যাপ্ত সময় পায় না। তাদের অর্ধেকের বেশি অতি খারাপ ধরনের শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করে, যেমন শিশু দেহব্যবসা, মাদক পাচার, সমরাস্ত্রের যুদ্ধক্ষেত্র এবং অন্যান্য বিপদজনক পরিবেশে।
আর্ন্তজাতিক গবেষণায় পাওয়া যায় যে তিন ভাগ বয়স্কই শিশু থাকা অবস্থায় শারীরিক নির্যাতনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং ৫ জনের মধ্যে 1 জন নারী এবং 13 জনের মধ্যে 1 জন পুরুষ শিশুকালে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। মানসিক নির্যাতন এবং অবহেলাও সাধারণ শিশুকালীন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে। 2014 অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী 15 বছরের নিচে 41,000 শিশুই হত্যার শিকার হয় প্রতি বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বয়ান দেয় যে এই সংখ্যা সঠিক নয়, একেবারেই কম। সত্যিকারের শিশু হত্যার পরিসংখ্যান আরো অনেক বেশি।

জাতিসংঘ ও শিশু শ্রম :
ILO জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা। 1992 সালে আই এল ও’র আন্তর্জাতিক শিশু শ্রম দূরীকরণ কর্মসূচী [আইপেক] যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে 80 টি দেশে এই কর্মসূচী চালু আছে। 1998 সালে আইএলও সর্বসম্মতিক্রমে কর্মক্ষেত্রে মৌলিক নীতি ও অধিকার সম্পৃক্ত ঘোষণা গ্রহণ করে। এর মধ্য দিয়ে আইএলও কর্মক্ষেত্রে নীতি ও অধিকার এর সাথে শিশুশ্রম দূরীকরণ এর দৃঢ় অঙ্গিকার ব্যাক্ত করেছে। প্রতি বছর 12 জুন, বিশ্ব দিবস শিশু শ্রমিকদের দুর্দশা এবং তাদের সহায়তার জন্য কী করা যেতে পারে তা তুলে ধরতে বিশ্বজুড়ে সরকার, নিয়োগকর্তা ও শ্রমিক সংগঠন, সুশীল সমাজ, পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে কয়েক মিলিয়ন মানুষকে একত্রিত করে।

কক্সবাজারের প্রেক্ষিতে শিশুশ্রম :
বিবিএসের হিসাবে বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় 40 শতাংশই শিশু। 5 থেকে 17 বছর বয়সী শিশু রয়েছে 3 কোটি 96 লাখ 52 হাজার। জনসংখ্যার অনুপাতে শিশুর হার সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে, প্রায় 33.7%। এরপরই রয়েছে যথাক্রমে চট্টগ্রাম (20.6%)। কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা 22,89,990 জন ( 2011 সালের হিসেব অনুসারে)। আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার 1.33%। সেই হিসেবে কক্সবাজারে প্রতিবছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় প্রায় 30,457 জন। তাহলে গত নয় বছরে মোট বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় 2,74,112 জন এবং বর্তমানে মোট জনসংখ্যা 25,64,102 ( পঁচিশ লক্ষ চৌষট্টি হাজার একশত দুইজন)। 5 থেকে 17 বছরের শিশুর হার মোট জনসংখ্যার 20.6% হলে কক্সবাজারে বর্তমানে শিশুর সংখ্যাদাঁড়ায় 5,28,206 জন ( পাঁচ লক্ষ আটাশ হাজার দুইশত ছয়জন)। বাংলাদেশে অর্থনীতির খাত অনুযায়ী শিশুশ্রমিকদের বণ্টনের চিত্র হচ্ছে: কৃষি 35%, শিল্প 8%, পরিবহন 2%, অন্যান্য সেবা 10% এবং গার্হস্থ্যকর্ম 15%। সেই হিসেব অনুসারে কক্সবাজারে মোট শিশুর—-

★কৃষি ক্ষেত্রে-1,84,872 জন (এক লক্ষ চুরাশি হাজার আটশ বাহাত্তর জন)
★শিল্প ক্ষেত্রে – 42,257 (বিয়াল্লিশ হাজার দুইশত সাতান্ন জন)
★ পরিবহন ক্ষেত্রে – 10,565 ( দশ হাজার পাঁচশো পয়ষট্টি জন)
★ অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রে – 52, 820 ( বায়ান্ন হাজার আটশ বিশ জন)
★ গার্হস্থ্যকর্মের ক্ষেত্রে – 79,231 ( উনআশি হাজার দুইশ একত্রিশ জন)

এদের অনেকেই স্কুলে যায় না, সঠিক পুষ্টি পায় না এবং খেলাধূলার পর্যাপ্ত সময় পায় না। এদের মধ্যে অনেকেই বিপর্যস্ত পেশার (যেমন- দেহ ব্যবসা, মাদক, চোরা চালান ইত্যাদি) সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া কক্সবাজার শহরের নাজিরার টেক, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন আর কুতুবদিয়ার শুঁটকি পল্লী গুলোতে প্রায় 10,000 (দশ হাজার) শিশু ক্ষতিকর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে। যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে এর চেয়েও খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের কক্সবাজারকে।

বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে শিশুশ্রম :
বর্তমানে দেশে প্রায় 16 লাখ 98 হাজার 894 টি শিশু বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত। এর প্রায় 75 দশমিক 35 শতাংশ (12 লাখ 80 হাজার 195টি শিশু) নিয়োজিত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

যদিও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে 2021 সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং 2025 সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

অর্থনীতির খাত অনুযায়ী শিশুশ্রমিকদের বণ্টনের চিত্র হচ্ছে: কৃষি 35%, শিল্প 8%, পরিবহন 2%, অন্যান্য সেবা 10% এবং গার্হস্থ্যকর্ম 15%। কিন্তু পরিবহন খাতে শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য ব্যাপক। অর্থাৎ যেখানে 0.1% মেয়ে শ্রমিক সেখানে ছেলে শ্রমিক হলো 3%। তবে শিশুশ্রম নিয়োগের প্রায় 95%-ই ঘটে অনানুষ্ঠানিক খাতে। এদের জন্য সাপ্তাহিক গড় কর্মঘণ্টা আনুমানিক 45 এবং মাসিক বেতন 500 টাকার নিচে। মেয়ে শিশুশ্রমিকের মাসিক বেতন ছেলে শিশুশ্রমিকের তুলনায় গড়ে প্রায় 100 টাকা কম। বাংলাদেশের আনুমানিক 20% পরিবারে 5-14 বছরের কর্মজীবী শিশু রয়েছে। এই সংখ্যা শহুরে পরিবারগুলির জন্য 17% এবং গ্রামীণ পরিবারের জন্য 23%।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে শিশুশ্রমের কারণ:
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা হচ্ছে শিশু শ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ। লেখাপড়ার খরচ দিতে না পেরে এবং সংসারের অসচ্ছলতার গ্লানি একজন মা-বাবাকে বাধ্য করে তার সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করতে।

শিশুশ্রম বন্ধে বাংলাদেশের আইন:
আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন-1974, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সকল প্রকার নিষ্ঠুরতা, জোর জবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুঘর্টনার আশঙ্কা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে সকল কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে। আমাদের শ্রম আইনেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, 14 থেকে 18 বছর বয়সী বা কিশোর যারা সপ্তাহে 42 ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। তবে কোনো শিশু (চৌদ্দ বছর পূর্ণ হয় নাই এমন কোনো ব্যক্তি) যদি কোন ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। আর ৫ থেকে 17 বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে 42 ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী শিশু অধিকার: 7 বছরের নিচে শিশুর কোনো আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নিচে শিশুর বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, 12 বছরের নিচে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ। 14 বছরের নিচে কারখানায় কাজ নিষিদ্ধ। 15 বছরের নিচে পরিবহন খাতে কাজ নিষিদ্ধ। 16 বছরের নিচে শিশু অপরাধীকে কারাগারে রাখা বেআইনি।

শিশু শ্রম প্রতিরোধ ও নির্মূল করার জন্য কক্সবাজার ভিত্তিক এক ডজন কার্যকরি পন্থা নিয়ে আলোচনা করা হলো:

1.নিজেকে দিয়ে শুরু করুন ;
যে লোকেরা অনাহারের পরিবর্তে জীবিকা নির্বাহের এবং নিজেকে টিকিয়ে রাখার সুযোগ দেওয়ার নামে তাদের বাড়িতে বা কাজের জায়গাগুলিতে শিশুদের নিযুক্ত করে, এবং ভান করে তাঁরা বড় একজন দানশীল। এি দানশীলের ভান ধরে অনেকেই নিজেদের বাসায় নিয়ে আসে আর গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করে।যেসব শিশুকে সস্তা শ্রমের চেয়ে বেশি কিছু মনে করে না তাদের থেকে তারা প্রচুর উপকৃত হয়। সর্বদা এইসব শিশুরা তাদের সেবায় থাকে, তাদের প্রতিটি ডাকে উত্তর দেওয়ার জন্য তাদের বাড়ির এক কোণে থাকে এবং তার মালিকের সর্বোত্তম প্রয়োজনে রূপায়িত হতে পারে। তবে আমাদের যা মনে রাখা দরকার তা হলো পরিবর্তন আপনার নিজের থেকেই শুরু হোক। আপনার ঘর পরিষ্কার করতে, ছোটদের যত্ন নেওয়া, আপনার থালা বাসন পরিষ্কার করা বা গাড়ি ধোওয়াতে শিশুদের বিরত রাখার সর্বোত্তম চেষ্টা করুন । পরিবর্তে, দরিদ্র বিমোচনে অবদান রাখুন আর তাদের পরিবার বজায় রাখার জন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করুন। যথাসম্ভব আপনার কাজগুলিতে প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা পরিচালিত করুণ। আর যে পরিবারে প্রাপ্ত বয়স্ক নেই তাদের সহযোগিতা করুন জীবন পরিচালনা করতে, অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা পেতে। আপনাকে এটি করতে উৎসাহ দেওয়ার যথেষ্ট মানবিক কারণ রয়েছে, যদি তা কাজ করে না, দয়া করে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন যে শিশুশ্রম অবৈধ!

2. .সচেতনতা বৃদ্ধি;
সচেতনতা বৃদ্ধি শিশুশ্রম প্রতিরোধ বা নির্মূলের প্রকল্পগুলির মূল প্রস্তর। শিশু শ্রম সম্পর্কে লোকদের জানতে হবে,বিশেষত এটির নিকৃষ্টতম রূপগুলি এবং কেন এটি সম্পর্কিত শিশু এবং সামগ্রিকভাবে উভয়েরই জন্য ক্ষতিকারক। অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্র বাবা-মা এবং তাদের সম্প্রদায়ের অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্করাও শিশু হিসাবে কাজ করেছিলেন তাদের শৈশবে। আর তাই বেশিরভাগ মানুষ এই শিশু শ্রম কে কোন অপরাধই মনে করেনা। তারা মনে করে পরিবারের অতিরিক্ত আয়ের প্রয়োজন মেটাতে পারে সন্তানের কাজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ। পিতামাতারা নিজেরাও বঞ্চিত ছিলো প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। পরবর্তীতে তাঁদের সন্তানদের নিয়েও কোন সচেতন হয়না বা হতে পারেনা। প্রচন্ড অভাব ও অশিক্ষা থেকে শিশুশ্রমের প্রতি মানুষের অসচেতনতা সৃষ্টির বড় কারণ। শিশুশ্রমের অন্তর্নিহিত কারণ যাই হোক না কেন, অসচেতনতার কারণগুলো খুঁজে বের করে নিরসনের উপায় বের করতে হবে। যে করেই হোক সম্প্রদায়কে এর ক্ষতিকারক প্রভাব এবং ক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করতে হবে যা তাদের বাচ্চাদের সুরক্ষা এবং তাদের পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করতে পারে। শিশু কাজের ক্ষতিকারক শিশুশ্রম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিক বিষয়গুলো হ’ল তথ্য সরবরাহ, যোগাযোগ, শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ লক্ষ্যে সরাসরি সম্প্রদায়গুলোকে সংযুক্ত করা। সচেতনতা বৃদ্ধি জ্ঞানীয় উপর একত্রিতকরণ বোঝায় বা মানসিক স্তর, মানুষের জ্ঞান এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করে, এটি ব্যবহারিক পরিবর্তনগুলিতেও অবদান রাখতে পারে।

৩. শিশু শ্রম আইন সম্পর্কে নিজে জানুন;
সমাজকে শিশুশ্রমমুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপগুলির মধ্যে একটি হ’ল শিশুদের সুরক্ষার জন্য আমাদের সংবিধানের বিধানগুলি, পাশাপাশি তাদের শোষণ বন্ধ করার জন্য এবং অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের জন্য বিভিন্ন আইন সম্পর্কে আপনার নিজের জানা। এই জাতীয় বিধান এবং আইনগুলির একটি সরলিকৃত তালিকা আমরা একে অপরকে জানাতে পারি।

৪. সজাগ থাকুন এবং অপব্যবহারের প্রতিবেদন করুন;
আপনার চারপাশে যে কোনও ধরণের শিশু নির্যাতন বা শোষণ ঘটছে সে সম্পর্কে সচেতন হন। মনে রাখবেন, এ জাতীয় বাচ্চাদের হয়ে আপনাকেই তাদের কণ্ঠস্বর হওয়া উচিত। আপনার এলাকার শিশু শ্রম ও নির্যাতন নিয়ে কাজ করে তাদের নিয়ে জানুন। আপনার আশেপাশে যখন শিশুশ্রমের যে কোনও ঘটনা আসে, তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে জানান বা হেল্পলাইনে কল করুন অথবা আপনার এলাকার এনজিওগুলোর সাথে যোগাযোগ করুন। আপনি এই সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষকে ব্যক্তিগতভাবে বা ফোন কল বা চিঠির মাধ্যমেও অবহিত করতে পারেন। অপরাধী যদি প্রভাবশালী কেউ হয় সে ক্ষেত্রে ফোন কল বা চিঠিগুলি আপনার পরিচয় বেনামে রাখতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

5. শিশু শ্রমিকদের পিতামাতার সাথে কথা বলুন;
শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের সাথে আমাদের চারপাশে কাজ করে। দীর্ঘমেয়াদে শিশু শ্রমের শিশুদের উপর যে গুরুতর প্রভাব পড়ছে সে সম্পর্কে এই বাবা-মায়ের সাথে কথা বলার একটি উজ্জ্বল সুযোগ দেয়। এই শিশুদের পিতামাতাদের পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করুন এবং তাদের বাচ্চাদের কাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য প্ররোচিত করুন, এভাবে বাচ্চাদের একটি পৃথক ও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করুন। অভিভাবকরা দারিদ্র্য এবং নিরক্ষরতার মতো কারণ উল্লেখ করার সম্ভাবনা থাকলেও আপনি তাদের শিশু শ্রম সম্পর্কে সঠিক ধারনা দেয়ার চেষ্টা করুন। তাদের সন্তানদের শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিলে দারিদ্রতা তাদের জীবনে স্থায়ীভাবে থেকেই যাবে তা তাদের বুঝাতে চেষ্টা করুন। যদি এই পরিবারগুলির জন্য আমরা অর্থনৈতিকভাবে উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করি তাহলে তাদের বাচ্চাদের অবশ্যই মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা করতে সহযোগিতা করতে হবে।

6. শিশু শ্রম নির্মূলের জন্য কাজ করা অগ্রণী আন্দোলন অথবা সংস্থার স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করুন;
শিশু শ্রম সম্পর্কে বুঝতে এবং এ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কী করা হচ্ছে এবং কী করা দরকার তা নিয়ে এগিয়ে যেতে এই সংস্থাগুলির নিকটতম আঞ্চলিক কার্যালয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে পারেন । তাঁদের সাথে যুক্ত হলে বুঝতে পারবেন এই শিশুদের কতটা নৃশংসতা ও অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হওয়ার বিষয়ে আপনি অবাক হয়ে যাবেন, অনেক ক্ষেত্রেই। এবং এই সংস্থাগুলির সর্বদা তাদের কাজে সহায়তার হাত প্রয়োজন হয়। আপনার সাপ্তাহিক ছুটি থেকে কয়েক ঘন্টা সময় নিয়ে যান এবং যে কোনও উপায়ে তাদের সহায়তা করুন। আপনি চাইলেই কাজটি কঠিন হবেনা।

৭. সু-সচেতন ভোটার হোন;
আপনার নির্বাচনী এলাকার প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির দিকে মনোযোগ দিন। শিশু শ্রম নির্মূলকরণ যদি তাদের প্রতিশ্রুতির অংশ না হয়, তবে আলোচনার ফোরাম এবং আপনার সাথে তাদের অন্যান্য আলাপচারিতার বিষয়টি সামনে আনুন। যদি তারা শিশুশ্রম নির্মূলের কোন প্রতিশ্রুতি বা ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে তাদের পরিহার করুন। আর নয়তোবা তাদের বুঝাতে আপনার ক্ষমতার সর্বোত্তম ব্যবহার করুন। দরকার হলে তাদের সবাই পরিহার করুন। আপনার চারপাশের অন্যান্য ভোটারদের মধ্যেও এই সচেতনতা ছড়িয়ে দিন।

8. অতিরিক্ত শিশু শ্রম যুক্ত সমাজ অথবা সম্প্রদায় চিহ্নিত করুন আর সমাধানের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করুন;
আপনার আশেপাশের অতিরিক্ত শিশু শ্রম যুক্ত সমাজ অথবা সম্প্রদায় খাঁজ বের করুন। তারপর তাদের সাথে শিশু শ্রমের কুফল নিয়ে আলোচনা করুন। সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে শিশু শ্রম নিরসন নিয়ে কাজ করা সংস্থা বা জনপ্রতিনিধিদের সাথে সমাধান নিয়ে আলোচনা করুন। তবে খেয়াল রাখতে হবে তথ্যগুলো যেন সঠিক ও গ্রহণযোগ্যতা হয়।

9. শিশু শ্রম মুক্ত পণ্য ক্রয় করুন ;
আপনার আশেপাশে অনেক ব্যবসায়ী দেখবেন অবৈধভাবে শিশুদের ব্যবহার করে পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করছেন। আপনার দৈনন্দিন ব্যবহার করা অনেক পণ্যই এটার সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে। কেনার আগে সচেতন থাকুন, আপনি যেন শিশু শ্রম বৃদ্ধির কারণ না হয়ে দাঁড়ান।

10. নৈতিকভাবে বিনিয়োগ করুন;
আপনি যদি কোনও বিনিয়োগকারী হন তবে আপনার সংস্থাগুলি যেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সামর্থ্যবান হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। আপনার বিনিয়োগ করা কোন সংস্থায় যেন শিশুশ্রম অন্তর্ভুক্ত না হয় তা নিশ্চিত করুন। খেয়াল রাখবেন আপনার বিনিয়োগ যেন শিশু শ্রম বৃদ্ধিতে অবদান না রাখে।

11. অন্যকে শিশু শ্রম সম্পর্কে শেখান বা জানান; ;
স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান,অলাভজনক প্রতিষ্টান এবং অন্যান্য গোষ্ঠীগুলিতে শিশু শ্রম সম্পর্কিত সমস্যা সম্পর্কে তাদের শিক্ষিত করতে এবং ইতিবাচক পদক্ষেপে উত্সাহ দেওয়ার জন্য উপস্থাপনা দিন। এজন্য বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিশু বিষয়ক প্রতিষ্টানে আলোচনা সভার ব্যবস্থা করা যায়।

12. শিশু শিক্ষা প্রসারে অবদান রাখুন;
যেসব সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর শিশুরা বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে তাদের শিক্ষার প্রসারে অবদান রাখতে পারেন। অনেক চেষ্টার পরেও যেসব জায়গায় শিশু শ্রমের অবাধ বিচরণ দেখা যায় সেসব অঞ্চলে নিজেদের অর্থায়নে অন্তত বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পারি। এই প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে সেইসব জায়গায় অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগের একটা সুযোগ থাকবে। আর বিনামূল্যে শিক্ষা দেয়ার কারণে তারা আপনাদের সম্মান করবে ও কথা শুনবে। শিশুদের শিক্ষা দানের সাথে সাথে তাদের অভিভাবকদের সচেতন করার বিরাট একটা সুযোগ থাকবে। তবে এটা সুখবর যে, আমাদের কক্সবাজারে এই ধরনের বিনামূল্যে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা দেয়ার অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের যাত্রা শুরু করছে। তবে এর চেয়ে পঞ্চাশগুণ প্রতিষ্টা করা দরকার। এই মানবিক কাজে আপনার সময় আর অর্থ ব্যয় করুন। সমাজ ও দেশের দুটোর জন্যই মঙ্গল হবে।

প্রতি বছর ১২ জুন ঘটা করে শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হলেও ২০২১ সালের মধ্যে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে কিনা বলা মুশকিল। কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগদানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে কার্যকর এবং গৃহকর্মে নিয়োগ ও ভাঙ্গাড়ি খাতকেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

লিখা:- রাজা সূর্য খাঁ
Founder Director of
English Discussion Club (EDC)

তথ্যসূত্র ;
শিশুশ্রম ( উইকিপিডিয়া)
জাতিসংঘ ও শিশু শ্রম ( বিকাশ পেডিয়া)
কক্সবাজারের প্রক্ষিতে শিশু শ্রম ( দৈনিক সংগ্রাম, বৃহস্পতিবার ১৩ জুন ২০১৯; উইকিপিডিয়া; বাংলাদেশের জনমিতি- উইকিপিডিয়ার হিসেব অনুসারে)