করোনা টেস্ট ল্যাব ও আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন জরুরী

কাফি আনোয়ার :

দেশে লকডাউন উঠে গেলেও কমেনি করোনাভাইরাস সংক্রমণের আধিপত্য।
কক্সবাজার সদরের পাহাড়, সমতল ও উপকুল অধ্যুষিত জনবহুল জনপদ বৃহত্তর ঈদগাঁহ’তে করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিত্র দিন দিন আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে মহল্লায়,ঘরে ঘরে।
কোভিড-১৯ শনাক্ত রোগীর হিসাব কাগজেকলমে গণনাযোগ্য হলেও প্রকৃত সংখ্যা বেশুমার।
যে কারণে ঈদগাঁহ’কে অনেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হটস্পট হিসেবে দেখছে।
পুলিশ কর্মকর্তা,ব্যাংকার,চিকিৎসক,ব্যবসায়ী,রাজনীতিবিদ’সহ ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। কোভিড-১৯ এর উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও কম নয়।
গতকাল ( বুধবার, ৩ জুন) কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে কামাল ইবনে শরীফ (৫৫) নামে ঈদগাঁহবাজারের প্রবীণ এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও জনসাধারণ করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে নিজস্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগ্রহণ এবং সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে যথেষ্ট উদাসীন।
সরেজমিনে জেলার বৃহত্তম বাণিজ্যিক উপশহর ঈদগাঁহবাজার এবং এর আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মাস্ক ছাড়া ঘুরাফিরা করছে অধিকাংশ মানুষ, বেশির ভাগ দোকানপাট খুললেও মালিক-কর্মচারীর মুখে নেই কোন মাস্ক( মুখোশ। স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশক স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করতে দেখা গেছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে।
জলখাবারের দোকান, রেস্টুরেণ্ট,ভাতঘরগুলিতে কর্মচারীদের হ্যান্ডগ্লাভস, মাস্ক ও ক্যাপ ব্যবহার এবং সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার প্রবণতা একেবারে হতাশাব্যঞ্জক। গণপরিবহণগুলির চিত্র আরো ভয়ংকর।
এ প্রসংগে কিচেনপ্লাস রেস্টুরেন্টের মালিক মোক্তার আহমদ এমইউপি বলেন, ব্যবসায়ি এবং জনপ্রতিনিধি হিসেবে গত ২ মানূষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। আমার কর্মচারী থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।
ঈদগাঁহতে যেভাবে স্বাস্থ্যবিধিকে অবহেলা করা হচ্ছে তাতে অচিরেই এই এলাকা বিরানভূমিতে রুপ নেবে।
জানা গেছে, ইতোপূর্বে লকডাউন চলাকালে সরকারী নির্দেশনা অমান্য করে দোকান খোলা রাখার কারণে ঈদগাঁহবাজারে একাধিবার ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
কক্সবাজার সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার ( ভূমি) শাহরিয়ার মুক্তারের নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালত ঈদগাঁহবাজারের শতাধিক ব্যবসায়ীকে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড এবং সর্বশেষ ২০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে সীলগালা করা”সহ একাধিক অভিযানের মাধ্যমে সতর্কবার্তা দেয়া হলেও ব্যবসায়ীসমাজ কিংবা লোকসমাজে তার কোন দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব নেই। মানুষকে
ঘরে রাখা যায়নি,বজায় রাখেনি সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব,মানেনি স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারী নির্দেশনা।
অপ্রয়োজনে ঘুরাঘুরি, আড্ডাবাজি চলেছে স্বাভাবিক নিয়মেই। যার ফলশ্রুতিতে ঈদগাঁহ এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের হটস্পট।
কক্সবাজার জেলা করোনাভাইরাস সংক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে রেড জোনে অন্তর্ভুক্ত হলে নিঃসন্দেহে ঈদগাঁহ হবে তার প্রধান প্রজননকেন্দ্র।
লকডাউন চলাকালে জনসাধারণকে সতর্ক করতে গিয়ে দুঃসাহসী ও প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে ঈদগাঁহ পুলিশ তদন্তকেন্দ্র। ইতোমধ্যে তদন্তকেন্দ্রের ৫ চৌকস পুলিশ অফিসার করোনাভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়েছে।আইসোলেশনে আছেন তদন্তকেন্দ্রের আইসি মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান।

কোভিড -১৯ পজিটিভ এসেছে
দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ ও ডেন্টাল সার্জন ডাঃ মহিম উদ্দীন, ঈদগাঁহ মডেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ ইউছুপ আলী, কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ রূপস পাল ও তাঁর পরিবারের ৫ সদস্য, তরুণ ব্যবসায়ি হুমায়ুন কবির মিয়াজী, রাজনৈতিক কর্মী মোহাম্মদ আলম।গীর ও তার পরিবারের ৩ সদস্য, ব্যাংকার ছৈয়দ আহমদ’সহ শতাধিক। টেস্ট ছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে আরো অসংখ্য রোগী।

এই পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যবিধি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনপ্রয়োগ করে অর্থদণ্ড কিংবা কারাদণ্ড কিংবা জরিমানা করার দাবী উঠছে।
সংক্রামক রোগ ( প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮ এর ২৪(১) ধারা মতে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ১লক্ষ টাকার অর্থদণ্ড বা অনাদায়ে ৬ মাসের কারাদন্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান থাকলেও কার্যত তার কোন প্রয়োগ বাস্তবে কোথাও নেই।
ঈদগাঁহ’র বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম’সহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের নিকট বিভিন্ন দাবী নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন।
তাদের দাবি ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে শাস্তি নিশ্চিত করা এবংজনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা ,ঈদগাঁহবাজারের প্রত্যেকটি প্রবেশমুখে সার্বক্ষণিক পাহারা বসিয়ে মাস্ক এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়া কাউকে বাজারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না দেয়া,
থার্মাল স্ক্যানার বসানো, ঈদগাঁহ’তে একটি পিসিআর ল্যাব স্থাপন, কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে কোন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ১০০ বেডের অস্থায়ী হাসপাতালে রুপান্তর, আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন, স্থানীয় প্রতিনিধিদের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে জনসচেতনতা ও সতর্কতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা, প্রত্যেকটি কমিউনিটি ক্লিনিককে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের কেন্দ্রে রুপান্তর, ব্যাপকহারে বিনামূল্যে জনসাধারণের মাঝে স্যানিটাইজার, মাস্ক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা,সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা’সহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক মনিটরিং সেল গঠন করা।
করোনাভাইরাসের কম্যুনিটি ট্রান্সমিশন প্রসংগে কক্সবাজার জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্য এবং সংক্রামক রোগ,বক্ষব্যাধি ও ট্রফিক্যাল রোগ বিশেষজ্ঞ, কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ শাহ জাহান বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ বর্তমানে স্টেজ-৪ পার করছে এবং কম্যুনিটি ট্রান্সমিশন খুব দ্রুতগতিতে বাড়ছে। উপজেলা সদর থেকে দুরে এবং স্বাস্থ্যসেবার সু্যোগসীমিত যেসব এলাকায় উপজেলা ওয়ার্কিং ইউনিট হিসেবে নিয়মিত করোনা টেস্ট ল্যাব এবং আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন সময়ের দাবি। ঈদগাঁহ সর্বক্ষেত্রে এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য আদর্শ বেইজক্যাম্প হতে পারে।
সেই ক্ষেত্রে ঈদগাঁহ হাই স্কুল অথবা ঈদগাঁহ কলেজকে আইসোলেশন সেণ্টারে রুপান্তরিত করলে ঈদগাঁহ’র বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোভিড নাইনটিন চিকিৎসায় নতুনমাত্রা যোগ হবে।

ঈদগাঁহ’তে করোনা টেস্ট ল্যাব ও আইসোলেশন সেণ্টার স্থাপনের দাবি প্রসংগে জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান রাশেদ বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এই অঞ্চলে ভয়াবহ পর্যায়ে, দিনদিন সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের চিকিৎসায় ঈদগাঁহ’তে টেস্টল্যাব এবং আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন না করলে এই এলাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।

ঈদগাঁহ’তে করোনা টেস্টল্যাব এবংআইসোলেশন সেন্টার স্থাপনের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লেঃ কর্ণেল(অবসর) ফোরকান আহমদ বলেন, বৃহত্তর ঈদগাঁহ’র সাধারণ মানুষ যেভাবে অসচেতন ও অসতর্কভাবে চলাফেরা করছে তাতে ওই অঞ্চলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়াটা স্বাভাবিক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আত্মসচেতনতা বাড়ানো এবং সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা শতভাগ নিশ্চিত করা জরুরী উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, অসচেতনতা ও উদাসীনতার ফল মানুষ ভোগ করবে। ঈদগাঁহ’তে করোনা টেস্ট ল্যাব ও আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন বিষয়ে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে যথাযথ পদক্ষেপ নিবেন বলে আশ্বস্থ করেন।

সচেতন বোদ্ধামহলের ধারণা সরকারের নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি সাধারণ মানুষ থোড়াই কেয়ার মনোভাবের কারণে ঝুঁকি বাড়ছে দিন দিন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারী স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালনে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করার পাশাপাশি সচেতনমহলের উত্থাপিত দাবিগুলো ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করতে পারলে মহামারি করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে ঈদগাঁহবাসীকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা যাবে।