মোহাম্মদ আকিব
অঁজপাড়া গায়ে বাস করত একটি দরিদ্র পরিবার। লিটন পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। বয়স তার দশ বছর। গ্রামের একটি সরকারি বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির বেশ নামকরা ছাত্র।বড় বোনের নাম তরী এবং ছোট দুইবোনের নাম যথাক্রমে রিয়া ও কুলসুমা আক্তার। রিয়া কুলসুমার চেয়ে বছর দুই একের বড়।
বাবা দিনমজুর। যেদিন কাজ পাওয়া যায়না, সেদিন দুবেলা দুমোঠো খেয়ে একটু স্বস্তিতে থাকার সৌভাগ্যটাও যেন জুটেনা তাদের! অভাবের টানাপোড়ন কিছুটা কমাতে মা’ও কাজের সন্ধানে সারাদিন ছুটে বেড়ায় অন্যের বাড়ি বাড়ি। বেলাশেষে কেউবা অল্প টাকাকড়ি, কেউবা কাজে ফাকিবাজির অজুহাতে ধমকের সুরে তাড়িয়ে দেয়। এরপরও ডালভাতের সাথে মোটামুটি ভালভাবেই চলছিল সংসার।
হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ল তার বাবা।
গ্রামের বিভিন্ন ডাক্তার এবং ওঝার কাছে চিকিৎসার কমতি রাখেনি। অবশেষে মায়ের বিয়ের সময়কার স্বর্ণের বালাটি বিক্রি করে শহরের এক চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।কিছুদিন পর সেই টাকাও শেষ হয়ে যায়! বন্ধ হয়ে যায় লিটনের বাবার চিকিৎসা। এরপর মাসখানেক ছটপট করার পর অবশেষে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়ে, চিরতরে বিদায় নিলেন তিন সন্তান এবং তাদের মা’কে ছেড়ে। সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল!
যেই মানুষটি সারাদিন অন্যের বাড়িতে কাজ করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাদের জন্য দুমোঠো খাবারের জোগান দিতো, সেও চলে গেল না ফেরার দেশে। দুবেলা খেয়ে বেচে থাকাও যেন এখন আর সম্ভবনা। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পেতো, ফেরার সময় সেই টাকা দিয়ে হাট থেকে ক্রয় করে নিয়ে আসতেন অল্প চাল আর অল্প ডাল এবং সাথে ক’টা গোল মরিচ অথবা শাকপাতা।
এদিকে পড়াশোনার খরচ বহন করতে না পারায় লিটন স্কুল ছেড়ে বসেছে। একজন ভাল ছাত্রকে হারিয়ে শিক্ষকরা যেমন চিন্তিত, ঠিক তেমনি একজন সঙ্গীকে হারিয়ে মর্মাহত তার সহপাঠীরাও। প্রতিদিন দলবেঁধে তার বন্ধুদের বিদ্যালয়ে যাওয়া আসার দৃশ্যটি খুবই কষ্ট দিত লিটনকে। অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো তাদের দিকে। চোখদুটো যেন বেদনার সুরে কিছু বলতে চায়। কি আর করার! কপালের লিখন তো অপরিবর্তনীয়।
কাজের সন্ধানে বেরুলেও, কেউ কাজ দিতে চায়না স্বল্পবয়সী লিটনকে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে বাবার এক বন্ধুর সাথে। তিনি তাকে ছোট একটি চায়ের দোকানে কাজ নিয়ে দেয়। যেখানে সারাদিন খাটনির পর পঞ্চাশ ষাট টাকা মতো জুটতো তার কপালে। কখনো কখনো তাও না! এভাবে মা এবং ছেলের যৌথ প্রচেষ্টায় খেয়ে না খেয়ে কেটে গেল ছয়টি বছর!
হঠাৎ একদিন লিটনের বড় বোনের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসলেন বাড়ির পাশের হালিম চাচা। কিন্তু যৌতুক ব্যতিত বরপক্ষ বিয়ের পিড়িতে বসতেই রাজি নন! শেষে নানা নাটকীয়তার পর ত্রিশ হাজার টাকা যৌতুকের বিনিময়ে ঠিক হল বিয়ে।
মা ছেলে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। অবশেষে ধারদেনা করে দশ হাজার টাকা জোগাড় করল। কিন্তু এরপরও বাকি থেকে গেল বিশ হাজার। নিরুপায় হয়ে পৈত্রিক শেষ সম্বল বাড়ির তলানিটুকুও বিক্রি করে দিল সম্বন্ধ নিয়ে আসা ঐ হালিম চাচার কাছে।
বড় বোনের বিয়ে তাদের জীবনে যেন বাড়িয়ে দিল অসহায়ত্ত্বের মাত্রা। একদিকে দেনা পরিশোধের উদ্বেগ, অন্যদিকে খরচের তালিকায় নতুনভাবে যুক্ত হল বাড়ি ভাড়া।এদিকে ছোট দুই বোন বিদ্যালয়ে পড়াশোনার বায়না ধরেছে। চায়ের দোকানের সেই পঞ্চাশ টাকা এবং মায়ের একশো টাকায় তাদের পরিবার আর চলেনা! খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল ষোলো বছরের তরুণ লিটন। ভাবতে ভাবতে শেষমেশ বাধ্য হয়ে চায়ের দোকানে চাকরির পাশাপাশি বেছে নিল চুরির পথ! অন্যথায় না খেয়ে মরতে হবে তাদের এবং শিক্ষা হতে বঞ্চিত হবে ছোট দুইবোন।
ডানপাশের বাড়িটি চেয়ারম্যান সাহেবের। তিনতলা বিশিষ্ট রাজকীয় ভবন, নিজস্ব গাড়ি; কোনোকিছুরই অভাব নেই। সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের বাড়িতে চুরি করার!
সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাত একটার দিকে ঢুকে পড়লেন সীমান্তের পাকা দেওয়াল পেরিয়ে। লক্ষ্য স্থির করলেন কিছু দামি জিনিসপত্র চুরির। সফলও হল! ভাত রান্নার পাচঁ ছয় শ টাকা মূল্যের বৈদ্যুতিক পাত্রটি নিয়ে পা পা করে ফেরার পথে দুর্ভাগ্যবশত ধরা পড়ল বাড়ির কর্তার কাছে। দারোয়ানকে ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই দারোয়ান এসে হাজির। এরপর দুহাত কুজো করে উঠোনের বড় নারকেল গাছটির সাথে পেচিয়ে বেধে রাখলেন সারারাত!
সকাল এগারোটার দিকে চেয়ারম্যান সাহেবের ঘুম ভাঙলে দড়ি খুলে নিয়ে যাওয়া হয় তার কাছে। সারারাত দড়ির চাপে ফুলে গিয়ে লিটনের দুহাত যেন কলাগাছের রূপ ধারণ করেছে! সারারাত একচেটিয়াভাবে বেধে রাখায় শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ব্যাথায় লাল রং ধারণ করেছে। সোজাসাপ্টা ভাবে দাড়ানোর সক্ষমতাটাও যেন নেই।
অনেকটা কুজো হয়ে উপস্থিত হল চেয়ারম্যান সাহেবের সামনে। প্রথম দেখায় চেয়ারম্যান রক্তচক্ষুর ক্রোধ প্রকাশ করলেন লাথির আঘাতে। এরপর কুজো হয়ে দাড়ানোর ক্ষমতাটাও হারিয়ে ফেলল লিটন। লিটনের মা খবর পেয়ে ছুটে যান সেখানে।
পায়ে পড়ে কেদে কেদে মাপ চাইলেও, মানবিকতা জাগলোনা প্রতিবেশি চেয়ারম্যানের। চৌকিদারকে আদেশ দিলেন মায়ের সামনেই লাঠিপেটা করার। চৌকিদারের আঘাতে মাটিতে গড়াগড়ি করতে লাগল লিটন। উচু চেয়ারে বসে লিটনের আহাজারি দর্শনে প্রকোপ মেটাচ্ছেন চেয়ারম্যান। হঠাৎ বুক টান করে লিটন দাঁড়িয়ে যায় তারুণ্যের চোটে। খুলে যায় তার মুখ। আর বলতে লাগল,
-“যখন আপনি আমাদের মতো গরীবদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি লক্ষ কোটি টাকা একটি মিথ্যে কলমের খোচায় চুরি করেন, সেটা কি চুরি নয় জনাব?
কোন চুরির শাস্তি আমাকে দিচ্ছেন?
আমরা পেটের তাড়নায় অভদ্রভাবে কয়েকশো টাকা চুরি করলে সেটা অন্যায়;
আর আপনারা বিলাশীতার জন্য ভদ্রভাবে লক্ষ কোটি টাকা চুরি করলে সেটা ন্যায়?
কোন অন্যায়ের শাস্তি আমাকে দিচ্ছেন?
সাধারণ জনগণের ভেট হতে জোটানো সরকার হতে আমাদের মতো গরীবদের জন্য বরাদ্দকৃত সাহায্য আমরা পাইনি বলেই আজ চুরির পথে। চুরির জন্য একমাত্র দায়ী আপনি এবং সমাজের বিত্তবান মানুষগুলো। যারা আমাদের টাকা এবং শ্রমে বিত্তশালী, অথচ আমাদের ক্ষুধা তাদের অগোচরের বস্তু। চুরির শাস্তি যদি দিতে হয়, আগে নিজেকেই দিন।”
লিটনের বাস্তব কথাগুলো আপন ব্যাক্তিত্বের সাথে মিলে যাওয়ায় খুবই তেতু লাগল চেয়ারম্যান সাহেবের।
জ্বলে উঠেন তেলে বেগুনে।
একপর্যায়ে তীব্র বেত্রাঘাতে হুশ হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায় লিটন। হুশ ফিরলে ধারালো অস্ত্রে উপড়ে নেয় তার দুহাতের নখ! রক্তঝরা শরীরে জোতার মালা গলায় হাটালেন পুরো গায়ে। লিটনের আহাজারি কে বা শুনতে পায়। শুনতে পেলেও চেয়ারম্যানের ভয়ে বধির সবাই!
অবশেষে অপরাধী সমাজের বিবেকহীন চেয়ারম্যানের হাত থেকে রেহাই পেয়ে দুই একজন প্রতিবেশির সহায়তায় বাড়ি ফিরে যায় অর্ধমৃত লিটন।
আমরা বাহ্যিক দৃষ্টিতে লিটনের মতো ক্ষুধার্ত কতিপয় চুরকে শনাক্ত করতে পারলেও, দৃষ্টিগোছরেই থেকে যাচ্ছে প্রবন্ধের চেয়ারম্যানের ন্যায় সমাজের বড় বড় চুরগুলো। তাদের দায়িত্বহীনতা এবং বিবেকহীনতার কারণেই মূলত সমাজে লিটনের মতো ছোট ছোট চুরের সৃষ্টি।
যদি তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন এবং সমাজের বিত্তবান মানুষগুলো লিটনের মতো অসহায়দের পাশে এসে দাড়ায়, তাহলে লিটনদের মতো অনেকেরই জীবিকা নির্বাহের জন্য চুরির পথে আসতে হবেনা, বেচে যাবে অনেক প্রাণ, ক্ষুধা হবেনা কারো মৃত্যু বা যন্ত্রণার কারণ।
সম্মিলিতভাবে বেঁচে থাকবে প্রতিটি মানুষ। সমাজে ফিরে আসবে অনাবিল সুখ।
লেখক: এইচএসসি পরীক্ষার্থী, মহেশখালী।