ইঞ্জিনিয়ার আরিফ সিকদার বাপ্পী 

 

পরিবারের স্বচ্ছতা আনতে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে ও সোনালি স্বপ্নের হাতছানিতে পরিবারের সকল পেলে একাকিত্ব জীবনযুদ্ধে, জীবিকা ও জীবনের তাগিদে বুকভরা কষ্ট নিয়ে প্রবাসী হয়।

একজন প্রবাসীর দেহ থাকে প্রবাসে, কিন্তু মন থাকে স্বদেশের উঠোনে। প্রিয়জনের মুখ তার চোখে ভাসে। স্বদেশের মেঘ-বৃষ্টি- রোদ, আলো-বাতাস, সবুজ ঘাসে শিশির ভেজা কুয়াসা গ্রামের মেটু পথ তাকে কাছে ডাকে, ক্ষণে ক্ষণেই ঝাপসা হয় তার দুটি চোখ। প্রবাসীরা দিনান্ত পরিশ্রম করে, কিন্তু কয়জনই বা ধরতে পারে সোনার হরিণ?

সে সোনার হরিণের পেছনে দৌড়াতেই থাকে, সময় যায়, ভবিষ্যত মেঘে ঢাকাই থেকে যায়। প্রবাসীদের কেউ হয়তো সোনার হরিণের নাগাল পায়, কিন্তু সিংহভাগই যেই লাউ সেই কদু হয়ে থেকে যায়। প্রবাসীদের কষ্টে জীবন চলে গেলেও কখনো পরিবার কিংবা আপনজনদের কষ্টের বুঝা বুঝতে দেয় না। নিজে না খেয়ে কাজের জন্য কর্মস্থলে চলে যায় দু’টাকা পাওয়ার প্রত্যাশায়। এই প্রত্যাশাকে বুকে ধরেই প্রতিনিয়ত কষ্ট করে দেশ তথা পরিবারকে পরিচালিত করে।

বর্তমান বৈশ্বিক মহামারী করোনায় বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে, একদিকে করোনা আতঙ্কে আতঙ্কিত অন্যদিকে বিশ্বের ২২০ টি দেশের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য সহ ইউরোপ ও আমেরিকায় লাগাতার লকডাউন।
পৃথিবীর ১৬৯টি দেশে বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ কাজ করেন। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশের কর্মসংস্থান মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলোতে।

হাজার হাজার প্রবাসীদের স্বপ্ন তো দূরের কথা একমুঠো খাবার যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে, প্রবাসের মাটিতে। নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে পরিবারের আপনজনদের জীবনের কথা চিন্তা করে হর হামেশাই হতাশাগ্রস্হ। কিভাবে চলবে পরিবার? কি খাবে? কি ভাবে প্রবাস থেকে তাদের জন্য টাকা পাঠাবেন? কোথায় পাই তাদের দেওয়ার জন্য? কাজ নাই, চাকুরী নাই। নাই কোন হাতে জমানো টাকা?
অন্যদিকে চাকুরী নিয়েও আছে দুশ্চিন্তা। পুরো বিশ্ব এখন আতঙ্কি। মধ্যপ্রাচ্যে ৩০ শতাংশের বেশি প্রবাসী বিভিন্ন প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সব প্রাইভেট সেক্টরের কোন নিশ্চয়তা নাই।
৪০ শতাংশ প্রবাসী দৈনিক শ্রমিক ও বিভিন্ন মেরামতের কাজ করে, তারা দিনে আনে দিনে খায়, সারাদিন কাজ করে যা পাই তা মাস শেষে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দেশে পাঠিয়ে দেন। আর ৫ শতাংশ প্রবাসী সরকারি আধা-সরকারী প্রতিষ্টানে কর্মরত, তাদের কথা না হয় বলতে চাই না। কিন্তু ৭০ শতাংশ প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যে নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্হ। তারা পারছেন কারো কাছে হাত পাতত্তে। আবার তাদের কষ্টের কথা কারো না কারো কাছে শেয়ার করতে। নিরবে জীবনের গ্লানি সয়ে যাচ্ছে।

করোনা পরিস্হিতি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশঃ-
১। সৌদি আরব; আক্রান্ত ৫০ হাজারের ও বেশি মৃত্যু সংখ্যা ৪শত ছাড়িয়েছে, এরি মধ্যে বাংলাদেশের ৮৮ জন প্রবাসী ভাইও মৃত্যু বরণ করেছে। আক্রান্ত ৭ হাজারের ও বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী।
২। সংযুক্ত আরব আমিরাত; ২২ হাজারেরও বেশি আক্রান্ত, মৃত্যু সংখ্যা ২২২ জনের মধ্যে বাংলাদেশি প্রবাসী ৪৫ জন মৃত্যু বরণ করেছে।
৩। কুয়েত; ১৩ হাজারের ও বেশি আক্রান্ত, মৃত্যু সংখ্যা ১৫০ শত জনের মধ্যে বাংলাদশি প্রবাসী ১৭ জন মৃত্যু বরণ করেছে।
৪। কাতার; ২৫ হাজারের ও বেশি আক্রান্ত, মৃত্যু সংখ্যা ২৫০ শত জনের মধ্যে বাংলাদেশি প্রবাসী ৪ জন মৃত্যু বরণ করেছে।
৫। ওমান; ১০ হাজারেরও বেশি আক্রান্ত, মৃত্যু সংখ্যা ৫০ জন পেরিয়েছে।
৬। বাহরাইন; ২৫ হাজারের ও বেশি আক্রান্ত, মৃত্যু সংখ্যা ১৫০ জন পেরিয়েছে।

এছাড়াও বিশ্বের ১৭টি দেশের মধ্যে ৬৫৬ জন বাংলাদেশি প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ গুলোতে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি প্রবাসীরা রয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে বেশি কড়াকড়ি চলছে তাতে বাংলাদেশের ৭৫ লক্ষাদিক প্রবাসী নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছে। বিভিন্ন প্রবাসী ব্যবসায়িরাও এই ক্ষেএে প্রচুর ক্ষতির সম্মূকিন হয়েছে।
এদিকে এমন পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে থাকা প্রবাসীদের পরিবার গুলোতে চরমভাবে আর্থিক সংকট দেখা দিচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রবাসী পরিবারগুলো তাদের কষ্টের কথা করো সাথে শেয়ার করতে পারছেনা, কিংবা সরকারের কাছে অনুদানের প্রত্যাশাও করতে লজ্জাহিনতার বিষয় মনে করছে।

গত দু’মাস আগেও যাদের পাঠানো টাকার রেমিটেন্সে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল, অথচ তাদের কষ্টের পাশে এখন কাউকে দেখা যায় না।দেশের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীরা বিভিন্ন অনুদান নিয়ে ছবি হাকিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপডেট দিতে দেখা যায়, অথচ এই প্রবাসী পরিবার গুলোর প্রতি কি দ্বায়িত্ব নেই আপনাদের? যাদের কষ্টে অর্জিত অর্থের অংশীদার সরকার থেকে প্রশাসন পর্যন্ত। একবার ও দৃষ্টিতে দিয়েছেন প্রবাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন পরিবারের প্রতি? আজ যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তারা কি প্রবাসীদের রেমিটেন্সের অংশীদার ছিল না? দেশে প্রবাসীদের ধনীর দোলাল মনে করেন যে, আসলে বাস্তবতা ভিন্ন। হাজারে একজনের ভাগ্যে সোনার হরিণ আছে বাকী ৯৯৯ জনের বুক ভরা হাহাকার নিয়ে প্রবাসে ধুকে ধুকে মরছে। দু’একজনের সুখের কাহিনী নাই-বা শুনলেন, আমাদের কথ শুনুন এবং জেনে রাখুন যারা প্রতিদিন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার লড়াই করে, যারা সুখের তরে সুখ হারায় ওদের কথা জেনে রাখা খুবই জরুরি। কারণ ওদের ত্যাগ তিতিক্ষার ফসল হলো দেশবাসী আপনজনের মুখের নির্মল হাসি।

সত্যি কথা বলতে কি, প্রবাসীর কষ্ট প্রবাসী ছাড়া আর কেউ বোঝে না। অনুমান করে সব কষ্ট বোঝা যায় না। অনুমান করে যদি প্রবাসীদের কষ্ট বোঝা যেত তাহলে এই লেখার প্রয়োজন হত না। আমি এসব কেন লিখছি? কেন প্রবাসীদের প্রতি আমার এই দুর্বলতা? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো আমি তাদের একজন।

প্রবাসীরা ভালো থাকুক। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সেই আমাদের অর্থনীতির চাকা হয় বেগবান। আমরা সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছি। সম্মান করা উচিত সব প্রবাসী ভাইদের। আর কোনো প্রবাসী ভাই যেন দুঃশ্চিন্তা করে বিদেশের মাটিতে প্রাণ না হারায় সেই কামনা। ভালো থাকুক প্রবাসীরা।

লেখক;  সহকারী প্রকৌশলী, দুবাই সিটি কর্পোরেশনের দুবাই – সংযুক্ত আরব আমিরাত , সম্পাদক ও প্রকাশক “উখিয়া নিউজ টুডে”