করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানো এবং সামাজিক দুরুত্ব নিশ্চিত করতে গত মার্চ মাসের ১৬ তারিখ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হচ্ছে সেটা কাটিয়ে উঠতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। এতে প্রাইমারি শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে সংসদ টেলিভিশনের ক্লাস। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে জেলা প্রশাসন কর্তৃক ধারণকৃত ভিডিও রেকর্ড ক্লাস।আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ইউজিসি কর্তৃক অনলাইন ক্লাসের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে,এই সিদ্ধান্তটা কতটা যৌক্তিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস নিয়ে কি ভাবছেন সেটা নিয়ে আমাদের আজকের প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন কক্সবাজার নিউজের (সিবিএন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মো. শাহ্ নেওয়াজ।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইউজিসি কর্তৃক অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসুত উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. উবায়েদ বলেন,”বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর কারনে অর্থনৈতিক মন্দার বিপরীতে শিক্ষার মেরুদণ্ডে ক্ষত ধরতে শুরু করছে।আর সেই ক্ষতকে নিরাময় করার তাগিদে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন(UGC) গত ২৪ মার্চ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অনলাইন ক্লাসের আহ্বান জানিয়েছে,যা অবিবেচনাপ্রসূত ও ছাত্রদের জন্যে হয়রানিমূলক সিদ্ধান্ত।করোনা মহামারীতে যেখানে বিশ্ব আজ থমকে দাঁড়িয়েছে সেখানে অনলাইন ক্লাস যুক্তির মধ্যে পড়ে না।বড় কথা হলো,পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই অঁজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসে।আর সেই অঁজপাড়া গাঁয়ে না থাকে ইন্টারনেট এক্সেস সুবিধা,না থাকে তাদের ইন্টারনেট কেনার সামর্থ্য।তাছাড়া গতিময় এ পৃথিবীতে বিশ্ব যেখানে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছে,বাংলাদেশ সেখানে পাচ্ছে কচ্ছপ গতি ইন্টারনেট,যা দিয়ে অনলাইন ক্লাসের কথা চিন্তা করা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়।যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশন জট প্রতিরোধে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে,তারপরও কতিপয় সীমাবদ্ধতার কারণে অনলাইন ক্লাস নেওয়াটা অবিবেচনাপ্রসূত।”

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন ক্লাসের অসুবিধা উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুরশিদা আক্তার বলেন, “অনেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রামে অবস্থান করছে,এরূপ সময়ে প্রত্যেকে বহুমুখী সমস্যার কারণে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করার সূযোগ নাও পেতে পারে, সেক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত হবে। আবার সবকিছু ভালো হলে দীর্ঘদিনের এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াও অনেক দূরূহ হয়ে পড়বে,তাই ক্ষতির পরিমান কমিয়ে আনার জন্য শিক্ষক কর্তৃক ক্লাসের পাঠদানগুলো ভিডিও রেকর্ড করে ইউটিউব চ্যানেলে দিয়ে দিলেই বরং শিক্ষার্থীদের উপকার হবে বলে আমি মনে করি। এতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামত সময়ে সেটা দেখে নিতে পারবে।”

অনলাইন ক্লাসের অসুবিধা উল্লেখ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহমেদ ইউসুপ বলেন, “অনলাইন ক্লাসের জন্য ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোন সবার জন্য বাধ্যতামূলক,কিন্তু সেটি সবার কাছে নেই। আর ডিভাইসটি থাকলেও বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করা সবার পক্ষে সম্ভব না। তাই অনলাইন ক্লাস করতে চাইলে সবার প্রথমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ এবং ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এর বাইরে গিয়ে অনলাইন ক্লাসের বাস্তবতা কল্পনা করা মুশকিল।”

ইউজিসি কর্তৃক অনলাইন ক্লাসেত সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী উল্লেখ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, “বর্তমানে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের কারণে সারাবিশ্ব হারিয়ে ফেলছে তাদের নিজেস্ব গতি। ধমকে যাচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা। বন্ধ হয়ে গিছে উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলোর অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশেও শিক্ষাব্যবস্থা গত ১৭মার্চ থেকে অচল হয়ে আছে। কবে এই অবস্থার সচলতা আসবে তাও আমরা জানি না।

আমরা ছোট বেলা থেকেই জেনে আসছি,শিক্ষাব্যবস্থাই হলো একটা দেশের মেরুদণ্ড। আর আমরা এটাও জানি মেরুদণ্ড বিহীন আমরা সোজা হয়ে দাড়াতে পারি না। তাই সেই মেরুদণ্ড কে সোজা করতে গেলে আমাদের বন্ধ হওয়া শিক্ষাব্যবস্থাকে সল্পপরিসরে সচল করা দরকার। এরই প্রেক্ষিতে ইউজিসি কর্তৃক বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অনলাইনের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। এই উদ্যোগে সাথে কিছুটা হলেও আমি একমত। তার কারণ হলোঃ-
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পডুয়া শিক্ষার্থীরা ফেসবুক, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ,ওয়াইফাই, গুগল এই শব্দগুলোর সম্পর্কে অবগত আছে। এবং মাত্র খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী আছে যারা এই গুলো ব্যবহার করে না। তার মানে সবার কিন্তু স্মার্টফোন, ল্যাপটপ আছে ব্যাপারটা এমন না। তা সত্ত্বেও আমরা চাইলে কিছুটা হলে পড়াশোনা সচল রাখতে পারি। স্যারেরা যদি তাদের লেকচার গুলো অডিও ক্লিপ হিসাবে দিলে যাদের স্মার্টফোন আছে তারা ডাউনলোড দিয়ে তাদের পড়াশোনা কিছুটা হলেও সচল রাখতে পারবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের সময়মত করে সেগুলো কভার করে রাখতে পারবে। অথবা স্যারেরা তাদের লেকচার গুলো সরবরাহ করে রাখলে দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলে শিক্ষার্থীরা তারপর পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিলো। কারণ সিলেবাস শেষ করাতেও সময় লাগে। সেক্ষেত্রে ক্যাম্পাস খুললে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে পারবে আর শিক্ষকেরা একাডেমিক, প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজ গুলো করে সেশনজট কমাতে পারবে। কেননা শুধুমাত্র লেকচার দেওয়ায় একজন শিক্ষকের কাজ না। আরও অনেক কাজ থাকে। এই প্রেক্ষিতে সল্পপরিসরে হলেও অনলাইন ক্লাস চালু রাখা দরকার।

এখন অনেকেরই মনে অনেক গুলো প্রশ্ন ও সমস্যা চলে আসবে।যেমনঃ সবার স্মার্টফোন, ল্যাপটপ নেই। গ্রাম এলাকায় নেট স্পিড ভালো না। তারপর অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের পারিবারিক অবস্থা নিম্নমানের ইত্যাদি ইত্যাদি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কিন্তু পাকিস্তানদের মত আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য ছিলো না, অর্থও ছিলো না ওদের মতো যা দিয়ে যুদ্ধের সারঞ্জাম কেনা যেতো। তবে আমাদের ছিলো দৃঢ় মনোবল ও আত্নবিশ্বাস। যার কারণে সবরকম প্রতিকূল ব্যবস্থা থাকার সত্ত্বেও আমরা হয়েছি জয়ী।
ঠিক তেমনি পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক, ল্যাপটপ – স্মার্টফোন ব্যাবস্থা না থাকলেও যদি ইচ্ছা শক্তি থাকে তাহলে আমরা সল্প পরিসরে হলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দাঁড় করাতে পারবো।”