জমির হোসেন


বঙ্গবন্ধুর নুর আহমদ এই নামটি শহর থেকে শুরু করে কক্সবাজারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুবই পরিচিত।
সত্তরের নির্বাচন। দুইটি ধারা চলমান৷ মুসলিম লীগ ক্ষমতায় অপরদিকে বঙ্গবন্ধু’র আওয়ামী লীগ নৌকার প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী প্রস্ততি গ্রহণ করছেন। কক্সবাজারে তখনও আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্ধারণ হয়নি। নুর আহমদ একদিন বঙ্গবন্ধু’র কাছে গিয়ে বলেছিলেন, লিডার কক্সবাজার আওয়ামী লীগের পতাকা তলে কে নির্বাচন করবে? বঙ্গবন্ধু এক মিনিট নিরবতা পালন করে বললেন আমার নুর আহমদ আওয়ামী লীগের পতাকা তলে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। কথাটি শুনে নুর আহমদ একটু বিব্রত হলেন। আবার বঙ্গবন্ধু’র সহজ সরল প্রশ্ন, কি পারবেনা? নুর আহমদ একটা বিজয়ের নির্ভরতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু’র প্রেরণায় বললেন হ্যাঁ লিডার পারবো।

ততকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় দুইজন কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন একজন হলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী অন্যজন ছিলেন ততকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম-মন্ত্রী মৌলভী ফরিদ আহমেদ। । নুর আহমেদ বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও তিনি একমিনিটও চিন্তা না করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ার জন্যে মনন ঠিক করেছিলেন। কারন তাঁর সাহস আর অনুপ্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বারবার বলতেন আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসটা মিথ্যে হয়নি। কক্সবাজারে নুর আহমেদ এর উপর বঙ্গবন্ধু যে বিশ্বাস নিয়ে নৌকা প্রতীকটিটি গচ্ছিত রেখেছিল তার শতভাগ বিশ্বাসের মূল্য নুর আহমেদ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু’র নৌকাকে সমগ্র মানুষের দ্বারেদ্বারে গিয়ে গণ-মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র প্রতীক হিসেবে প্রচার করেছিলেন। তখনকার দিনে আওয়ামী লীগ ও নৌকাকে হিন্দুয়ানী বলে প্রচার করেছিল। নুর আহমদরা অসাম্প্রদায়িক একটি জাতি গঠনে সফলতার চাবিকাঠি হিসেবে নৌকার প্রতীককে পরিচিতি করেছিলেন। আওয়ামী লীগকে গণ মানুষের দলে রূপায়িত করেছিলেন। নৌকা প্রতীককে করেছিলেন শোষনহীন ও অসম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনার ধারক বাহক। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত তদানীন্তন জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নুর আহমেদ মুসলীগের প্রার্থী শ্রম-মন্ত্রী মৌলভী ফরিদ আহমদকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছিলেন।

মরহুম নুর আহমদ ১৯৫৪ সালে পেকুয়া জি.এম.সি ইনস্টিটিউট থেকে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১ম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বি.এ(অনার্স) এবং ১৯৬১ সালে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন।
পরবর্তীতে এল.এল.বি ডিগ্রী অর্জনের পর কক্সবাজার বারে যোগদান করেন৷

অধ্যাপনার পাঠ চুকিয়ে নুর আহমদ পেশাগত জীবন শুরু থেকেই রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু’র হাত ধরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির মুলমন্ত্র বুকে লালন করে রাজপথে জয় বাংলার শ্লোগান শপৎ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু’র নির্দেশে নুর আহমদ কক্সবাজার কোর্টবারে পেশাজীবন শুরু করেন। পেশাজীবনে তিনবার আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৮৯ সালে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন পাশাপাশি কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে তিনি ১৯৬৩-৭৩ সাল পর্যন্ত কক্সবাজারে প্রতিটি থানা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন।
১৯৬৪ সালে সম্মিলিত বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে জেলার আনাচে কানাচে তথাকথিত বেসিক ডেমোক্রেসির বিপক্ষে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করেন। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ রচিয়তা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণার পক্ষে জনমত গঠনেও তিনি জোরালো ভূমিকা পালন করেন। নূর আহমেদ তাঁর বিচক্ষণতা দিয়ে কক্সবাজারে আওয়ামী লীগকে শক্তঘাঁটিতে রূপায়িত করেছিলেন। তরুণ প্রজন্মে মাঝে বঙ্গবন্ধুকে পরিচিতি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু’র চেতনার সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের মাঝে প্রচার করেছিলেন।

স্বাধীনতা ও স্বাধীকার আন্দোলনে নুর আহমদ-র ভূমিকা ছিলো চমৎকার। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে কক্সবাজার জেলার প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং প্রতিটি থানায় সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলেন। কালুরঘাট অবস্থানরত মুক্তি বাহিনির সাহায্যর্থে খাদ্য সামগ্রী ও মুক্তিযোদ্ধার প্রেরণ করেন। বঙ্গবন্ধু’র ঐতিহাসিক সেই ৭ই মার্চ ভাষণের সেই মঞ্চে উপস্থিত থেকে সমগ্র কক্সবাজারবাসীকে গর্বিতস্থানে রেখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর নূর আহমেদ নেই আজ নয় বছর।
নুর আহমদ ১৯৩৮ সালে ১৪ জুন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের কচুবনিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ২০১১ সালের ১৫ মে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছিলেন(ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)
এই নয় বছরে কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করা মানুষটির কথা কেউ মনে রাখেনি। তাঁর স্মরণে সংগঠন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জানায়নি। দল ক্ষমতায়। যাদের জন্যে আজকের আওয়ামী লীগ তাঁদের কীর্তি তরুণ প্রজন্ম জানেনা। তাঁদের আত্মত্যাগে আজকের বাংলাদেশ এই ইতিহাস থেকে এই প্রজন্ম অনেক দূরে। নূর আহমেদদের কীর্তি সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে হবে। দলের জন্যে তাঁদের আত্মত্যাগ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের কাছে ধারনা দিতে হবে।

দীর্ঘদিন পর তাঁর সুযোগ্য সন্তান সোহেল আহমেদ বাহাদুর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে এসেছেন। জেলা যুববলীগ নুর আহমেদ স্মরণে দিনব্যাপী প্রোগ্রামে আয়োজন করেছেন। অন্তত জেলা যুবলীগ এর প্রোগ্রামের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু’র নুর আহমেদকে নতুন করে চিনবেন। তাঁর আদর্শ ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে অবগত হবেন। এই থেকে শিক্ষা নিয়ে আওয়ামী লীগে অবদান রাখা নেতা কর্মীদের দল মূল্যায়ন করবেন।

কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। নুর আহমেদ কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের জন্যে কীর্তিমান। নয় বছর আগে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। অথচ তাঁর কর্ম তাঁকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছেন। রেখেছেন বঙ্গবন্ধু’র প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন ও দলের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করার প্রমাণ। এমন ব্যক্তি যুগে যুগে আসবেনা। আবার তাঁরা বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে যতদিন এই বাংলার বুকে জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান রচিত হবে।

বঙ্গবন্ধু’র ঘনিষ্ঠ সহচর কক্সবাজার প্রতিষ্ঠাতা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জনাব এডভোকেট নুর আহমদ-র নবম মৃত্যু বার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা সেই সাথে কামনা করছি আল্লাহ্ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমীন।


লেখকঃ জমির হোসেন ,প্রভাষক ,কক্সবাজার সিটি কলেজ,কক্সবাজার।