মোহাম্মদ ম্যাক্স


 

পৃথিবীর সকল চলচ্চিত্র প্রেমীদের জন্য আইএমডিবি শ্রেষ্ঠ সার্চ ইঞ্জিন।

একটি চলচ্চিত্রের বা টিভি সিরিজের বা একজন অভিনেতার সমস্ত তথ্য আপনি এখানে পাবেন। তাছাড়া আপনি আইএমডিবিতে কোনো চলচ্চিত্রের ট্রিভিয়া, বাজেট ইতিহাস এবং কি কি ভুল একটি চলচ্চিত্র করেছে সব পাবেন।

গোঁফ নামে যে সেকশনটি আছে সেখানে চলচ্চিত্রগুলো কী কী ভুল করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা থাকে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, টাইটানিক চলচ্চিত্রটি, সেখানে জেকের সিগারেট ফেলে দেওয়ার দৃশ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা কিভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল ক্যামেরার সাথে মিল না রেখে ইত্যাদি।

সাম্প্রতিক নেটফ্লিক্স এর সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র এক্সট্রাকশন এর ব্যাপারে এই সেকশন লিখেছে,

সাজুর নাকে প্রচন্ড আঘাত,আর এই আঘাত কেটে উঠতে কয়েকদিন সময় লাগার কথা কিন্তু মোবাইল ফোনে যখন সে তার পরিবারের সাথে কথা বলছে তখন যেন এই ব্যথাটা উদাও হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু আজকে আমার এই আর্টিকেলে আমি এসব নিয়ে বলছি না, আমার বিষয়বস্ত হল কিভাবে আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে খুবই নেতিবাচক ভাবে এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে তার ওপরে।

এই চলচ্চিত্রের উপরে আমার লেখা প্রথম আর্টিকেলে আমি বলেছিলাম বা আমি মূলত নেটফ্লিক্স কে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম, তাছাড়া আমি খুশি হয়েছিলাম এইজন্য যে ক্রিকেটের পরে সাড়া জাগানো এই মুভির মাধ্যমে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো পরিচিতি লাভ করবে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশকে এই চলচ্চিত্রে খুব বাজে ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের কোন দৃশ্য চিত্রায়িত করা যেত পারত গল্পের প্রয়োজনে, কিন্তু তা না করে বরঞ্চ পচা,অলি গলি, গিঞ্জি আর নর্দমার দৃশ্য এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে।

এই মুভির জন্য চিত্রায়িত সেটগুলো এবং স্থান পছন্দ খুবই জঘন্য ছিল যদিও বাংলাদেশ বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর একটি দেশ কিন্তু এই চলচ্চিত্রটি তা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়।

এই চলচ্চিত্রে আরেকটি ব্যাপার দেখা গেল যে বিদেশীরা আমাদের দেশে বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় মাফিয়া বস কে ভয় পান, কিন্তু আদলে ঘটনা তার উল্টো, সমস্ত বিদেশীরা আমাদের এই দেশে থাকতে নিরাপদ বোধ করেন, এটি এমন নয় যে, যেখানে ‘মিডনাইট এক্সপ্রেস’ নামে একটি চলচ্চিত্রে একজন আমেরিকান কে তুরস্কের জেলখানায় আটক দেখানো হয় এবং পরে সেখান থেকে ঐ আমেরিকান পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় যেটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল।

পৃথিবীর অনেক দেশে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে, অনেক দেশ মানবাধিকার নীতি গুলো ঠিকমতো মেনে চলতে পারে না, কোন কোন চলচ্চিত্র অনেক সময় তা ফুটিয়ে তুলে।

যেমন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের নির্মম হত্যাকান্ড আমরা দেখতে পাই সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ‘দি স্পাই গন নর্থ’ নামক মুভিতে।

যেমন মেক্সিকোর সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি, সুন্দরী সালমা হায়েক অভিনীত ‘ ডেস্পেরাডু’, আর ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মেক্সিকো’ সেখানে আমরা দেখতে পাই যে কিভাবে মাদক সম্রাটরা মানুষ খুন করছে যা কিনা গল্পের সাথে বাস্তবতার মিল পাওয়া যায়।

কিন্তু এক্সট্রাকশন চলচিত্রে বাংলাদেশের শিশু শ্রম আর শিশু সন্ত্রাস দেখানো হয়েছে, এইসব সত্য থেকে বাংলাদেশে অনেক দূরে।

যেমন ধরুন ক্রাইম থ্রিলার চলচ্চিত্র, ‘সিটি অফ গড’ এর কথা বলি সেখানে শিশু সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ আছে এমনকি ১০ বছরের চেয়েও ছোট শিশুরা অস্ত্র হাতে মানুষ খুন করতে দেখা যায় যা সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে, এসবের তুলনায় বাংলাদেশ যোজন যোজন মাইল দূরে।

যেমন আরেকটি চলচ্চিত্রের কথা বলা যায়, বেন অ্যাফ্লেক কর্তৃক অভিনীত ‘ দি টাউন’ চলচ্চিত্রে দেখা যায় যে, দিন দুপুরে ডাকাতি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স , আর এটি বাস্তব জীবনে নিয়মিত হয়ে থাকে।

তাছাড়া এক্সট্রেকশন চলচ্চিত্রের ডায়লগ গুলো খুবই বাজে বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে, অন্যান্য মাফিয়া চলচ্চিত্রের মতো ভালো ডায়লগ এখানে শুনা যায়নি বললেই চলে, যেমন ‘ গুডফেলাস বা ‘ গডফাদারের ‘ কথা , সবার তো নিশ্চয়ই মনে আছে গডফাদারের সেই ডায়লগ গুচ্ছ, ‘ আমি তাকে এমন অফার দিলাম সে প্রত্যাখান করতে পারেনি’ অথবা আলপ্যাচিনোর বলা সেই কথা, ‘বলো তোমাকে কে প্রলুব্ধ করেছে, মিথ্যা বলো না, তাহলে আমার বুদ্ধিমত্তা কে অপমান করা হবে’ ।

 

একেবারে সস্তা আর বস্তা পচা ডায়লগ এই এক্সট্রাকশান চলচিত্রে শোনা যায়।

আর একটি দুঃখজনক ব্যাপার যে এই চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ থেকে কোন অভিনেতা নেওয়া হয়নি যাতে কিছুটা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থেকে যায়৷

আর এক্সট্রাকশন চলচ্চিত্রের ঘটনা সহজেই অনুমানযোগ্য যেমন, অপহৃত ছেলে উদ্ধার হবে, প্রচণ্ড লড়াই হবে তা আগে থেকে বুঝা যায়।

দর্শকরা ঐ সমস্ত ই মুভি বোঝা পছন্দ করেন যেখানে শেষ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় শুধু একটি টুইস্ট বা একটি রহস্য সমাধান করতে।

একটি চলচ্চিত্রের গভীরতা যত বেশি থাকবে ততবেশি সেটি দর্শকনন্দিত হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ১৯৫৭ সালের চলচ্চিত্র ‘দি উইটনেস অফ প্রসেকিউশন’, চোখ দিয়ে আঠার মত লেগে থেকে শেষ মিনিট পর্যন্ত আটকে না থাকলে, কেউ বলতে পারবেনা এটি কিভাবে শেষ হচ্ছে।

আরেকটি উদাহরণ, আইএমডিবির দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হল ‘শশাংক রিডেম্পশন ‘, এই চলচ্চিত্রটি শেষ পর্যন্ত না দেখলে কোথায় এটি গড়াবে কেউ বলতে পারবেনা, অসাধারণ একটি ক্লাসিকাল চলচ্চিত্র বলা যায়।

যেমন ধরুন আরেকটি চলচ্চিত্র কাইরা নাইটলি অভিনীত ‘দি এটনম্যান্ট’, চলচ্চিত্রটিতে দেখা যায় খুবই হতাশাজনক এন্ডিং, এতক্ষণ পর্যন্ত দর্শকরা মুভিটা দেখে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করলো কিন্তু আপনি যদি লেখিকার শেষ ইন্টারভিউ না শুনেন তাহলে চলচ্চিত্র টা দেখে আপনি আর মজা পেলেন না, কি অসাধারণ সমাপ্তি এই চলচ্চিত্রের!

যদিও খুবই দুঃখজনক সমাপ্তি ছিল।

পৃথিবীতে যতগুলো মাফিয়ার উপরে বা আন্ডারওয়ার্ল্ডের উপরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে মুভির প্লট এর কারণে এক্সট্রেকশন চলচ্চিত্রটি একেবারে নিচের দিকেই থাকবে।

যেমন ধরুন গডফাদারের কথাই বলছি, কি নেই এই মুভিটাতে, অভিনয়, থ্রিল, উত্তেজনা, সাসপেন্স ডাইলগ।

এই গডফাদার চলচ্চিত্রটি কেউ বলতে পারছে না কখন কি হয় কখন মাইকেল কি করতে যাচ্ছে? এমনকি শেষের দিকে যে তার নিজের বোনের জামাতাকে মাইকেল মেরে ফেলবে তাও কারো ধারণা ছিল না।

যদি হিন্দি চলচ্চিত্রের মতো একটি মুভির শুরু দেখেই সবাই বুঝে ফেলতে পারে কি হবে তাহলে এই চলচ্চিত্রটি তার জৌলুস হারিয়ে ফেলে।

এক্সট্রাকশন এর মতো চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিচিতি আরো বাড়তে পারতো, বাংলাদেশের ইতিবাচক দিকগুলো আরো বৃদ্ধি পেতে পারতো কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য উল্টো হয়েছে।

ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র গুলোর মাধ্যমে কোন দেশ বা কোন ব্যক্তির পৃথিবীব্যাপী সুখ্যাতি লাভ করার সুযোগ থাকে।

চার্লিজ থেরনের অস্কার পুরস্কার পাওয়া তার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকাকে অনেক খ্যাতি এনে দেয়।

অস্ট্রিয়ার অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার পৃথিবীর অন্যতম ধনী অভিনেতা তে পরিণত হন।

আয়ারল্যান্ডের অভিনেতা ড্যানিয়েল ডে লুইস তিনবার অস্কার পেয়ে কোন নন আমেরিকান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র ‘প্যারাসাইট’ এবছর শ্রেষ্ঠ ছবির চলচ্চিত্র ক্যাটাগরীতে অস্কার পেয়ে সারা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দেয়।

ইতালির বিখ্যাত অভিনেতা রবার্তো বেনিগনি অস্কার পাওয়ার পরে তার দেশ খুবই গর্বিত হয় এবং এই অস্কার পুরস্কার হাতে নেওয়ার জন্য চেয়ারের উপর দিয়ে হেটে যাওয়া অস্কার ইতিহাসে অন্যতম একটি মজার ঘটনা।

‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ চলচ্চিত্রে তিনি অস্কার পুরস্কার পান।

তার আরেকটি চলচ্চিত্র রয়েছে যেটির নাম হচ্ছে ‘দি টাইগার এন্ড স্নো’ সেখানেই ইরাকে যুদ্ধে তিনি সৈনিকদের সামনে বলতেই থাকেন, আমি ইতালিয়ান, ইতালিয়ান, ইতালিয়ান!

আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ এসেছিল সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিতে ব্লকবাস্টার এক্সট্রাকশন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যদি সঠিক লোকেশনে শুটিং হত।

যেকোনো চলচ্চিত্র পর্যটনের ক্ষেত্রেও বিশাল অবদান রাখে যেমন ধরুন ‘ দি এস্কেপ ফ্রম আলকেট্রাজ ‘ মুভি, সেটি সত্তিকারের জেলখানায় হয়েছিল আর এই জেলখানা এখন বন্ধ তবে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, যে সমস্ত পর্যটকরা সানফ্রান্সিসকোর উপসাগরে এই জেলখানা দেখতে যান, তারা সবাই একটা কমন প্রশ্ন করে থাকেন, সেটি হল ‘ ভাই বলুন প্লিজ, ক্লিন্ট ইস্টওয়েডের সেলটা কোথায়?

অসাধারণ কথাশিল্পী সিডনি শেলডন তার উপন্যাস ‘দি স্যান্ডস অফ টাইম’ এ বাংলাদেশের ব্যাপারে মানবিক লিখেছিলেন।

এমনকি আরেক বিখ্যাত লেখক জ্যাক হিগিংস তার উপন্যাস ‘ দি কুফরা রান ‘ এ যুদ্ধ পরবর্তীতে ঢাকায় চিকিৎসা সেবার ব্যাপারে বলেছিলেন, এমনকি এই উপন্যাসের মূল নায়িকা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি হাসপাতালে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

আলপ্যাচিনো তার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘ দি সেইন্ট অফ এ ওমেন ‘ এ বাংলাদেশের বেঙ্গল ল্যান্সারের কথা বলেছিলেন।

এক্সট্রাকশন চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশকে একটি মানবিক দেশ হিসেবেও পরিচিতি করতে ব্যর্থ হয়েছে, পৃথিবীতে যে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত আছে তার একটা দেখানোর সুযোগ এসেছিল, এমনকি বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষ যে কঠিন জীবন যাপন করছে আর অধ্যবসায়ী তাও দেখাতে পারত একটা ভিন্ন উপায়ে। আর শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে যে মুম্বাই এর মাফিয়া বা নিউইয়র্ক আর সিসিলির ক্রাইম, এগুলো কল্পনাতীত।

মাফিয়ার গ্যাংস্টারদের অনেক মুভি আছে যেমন ধরুন ‘ রোমাঞ্জো ক্রিমিনালে’ অথবা ‘ সাবুরা ‘ তাদের যে কাহিনী সেগুলোর সাথে বাস্তবের মিল পাওয়া যায় আর বাংলাদেশের একজন শীর্ষ মাফিয়া আরেকজন মাফিয়া বসের বাচ্চাকে অপহরণ করে নিয়ে আসবে সেটি সত্যি হাস্যকর।

টম হ্যাঙ্কসের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ টার্মিনাল’ এর কথা মনে আছে, সেখানে একটি কাল্পনিক দেশ ছিল নাম ছিল, ‘ কারকুজিয়া’ দর্শক এই দেশটিকে এমন ভালবেসে ছিল যে সবাই চাই তো এই দেশে যুদ্ধ বন্ধ হোক যাতে এই ছবির অভিনেতা নিউইয়র্ক যাওয়ার জন্য ভিসা পেতে পারে।

আমরা বলা যাই, নেটফ্লিক্সের খুবই ভক্ত, শুধু আমরা নই সারা পৃথিবীর অনেক সেলিব্রিটি আছেন যারা নেটফ্লিক্সের অন্ধ ভক্ত।

এমনকি তার অনুরোধের কারণে পৃথিবী বিখ্যাত স্পেনের টিভি সিরিজ ‘দি মানি হাইস্ট ‘ এর একটি পর্বে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার নেইমারকে দেখা যায় অভিনয় করতে।

তাই ভবিষ্যতে যদি আমাদের প্রিয় নেটফ্লিক্স আবার বাংলাদেশকে নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র করতে আসে তাহলে আমার সমালোচনাগুলো বিবেচনা করলে মনে হয় আমরা সন্তুষ্ট হবো।

লেখক কক্সবাজার নিউজ এর একজন ইংরেজি প্রতিবেদক