নীলোৎপল বড়ুয়া 

আমরা মানুষ।
বিভিন্ন সভ্যতা পাড়ি দিয়ে
আজ আমরা এখানে।
আধুনিক সভ্যতার আধুনিক মানুষ।
ভোগ করছি আধুনিক সুবিধা।
খাচ্ছি-দাচ্ছি-ঘুরছি-ফিরছি
আর উপার্জন করছি।
কিন্তু যাপন করছি
এক প্রতিবন্ধী জীবন।
নিজ চারণ-ভূমির বাইরে
চিন্তা করার ক্ষমতা নেই।
দেনা-পাওনা আর লাভ-অলাভের খুঁটিতে বন্দি,
চাহিদা মেটানোর দৌঁড়ে হারিয়ে ফেলছি অভাব,
আরও পাওয়ার খাটুনিতে ভুলেগেছি উপভোগ,
আর নিজেকে সাজানোর ব্যস্ততায়
চিনতে পারিনা আপনারে।
শেভ-টেভ করে, স্যুট-বুট পরে,
সেজেগুজে, পরিপাটি হয়ে
নিজেকে উপস্থাপন করি।
কিন্তু কখনো নিজের দিকে তাকাই না।
আয়নাই সব!

আমাদের পূর্ব-পুরুষ শিকার করত প্রয়োজনে,
জীবন বাঁচাতে।
আমরা শিকার করি শখের বশে,
আনন্দ পেতে।
আমরা আনন্দ পাই
রিং এর ভিতর রক্তপাতে,
আমরা আনন্দ পাই
ভিক্ষুকদের ভিক্ষা দিতে।

আমরা মানুষ।
বিভিন্ন সভ্যতা পাড়ি দিয়ে
আজ আমরা এখানে।
আধুনিক সভ্যতার আধুনিক মানুষ।
ভোগ করছি আধুনিক সুবিধা।
খাচ্ছি-দাচ্ছি-ঘুরছি- ফিরছি
আর উপার্জন করছি।
কিন্তু যাপন করছি
এক প্রতিবন্ধী জীবন।
অধীত বিদ্যার বাইরে
কল্পনার শক্তি নেই আমাদের।
সংস্কৃতিহীন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত,
অর্থকরী বিদ্যায় বিদ্বজ্জন।
গড়েছি বিদ্বৎসমাজ আর
কল-কারখানা, অফিস-আদালতের
প্রয়োজনীয় সামগ্রী হয়ে
করছি প্রয়োজনের দাসত্ব।
সার্থকতা নয়,
কানে নিরন্তর সফলতার কুমন্ত্রণা।
প্রতিনিয়ত লিপ্ত অসুস্থ প্রতিযোগিতায়।
সফলতার মানমন্দিরে নির্ধারণ করি
জীবনের মূল্য;
মানুষ হিসেবে নয়।
সার্থকতা কেবল পুঁথিগত বিষয়।
বস্তুগত সঞ্চয়ে সকলে
হওয়ার চেষ্টায় মাতাল আর
কুড়ানোর ব্যস্ততায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
ব্যস্ততার এই অরণ্য মাঝে
আমাদের লোপ পেয়েছে
দেখার শক্তি, শোনার শক্তি, পড়ার শক্তি।
তাই কবিতাও আজ হয়ে উঠেছে অণুকাব্য।

সভ্যতার ক্রমধারায়
মানুষ এগিয়ে চলছে উন্নতির চরম শিখরে।
সীমা আকাশ!
এক অর্থে ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করেছে
মানুষের মাথা।
উলঙ্গ আধিপত্য চলছে তার
জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে।
ভুলে গেছে মানুষের দায় মহামানবের,
কোথাও তার সীমা নেই।

সভ্যতার অগ্রযাত্রায়
বিলুপ্ত হয়েছে দাসপ্রথা,
বিলুপ্ত হয়েছে উপনিবেশ,
বিলুপ্ত হয়েছে এক-কেন্দ্রিকতা।
জন্ম নিয়েছে জনপ্রিয় ধারা- গণতন্ত্র,
গড়ে উঠেছে বিত্তের বেসাতি।
অবাধ পুঁজির বিস্তারে আর
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীয় অজ্ঞতায়
(পৃথিবীর) মালিক বনে যায় ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠী।
প্রশস্ত হতে থাকে
রাজার হস্তে কাঙ্গালের ধন চুরির পথ,
স্পষ্ট হতে থাকে
হাড্ডি-চর্মসার নগ্ন বুক।
বাড়ে নিজভূমে পরবাসী,
বাড়ে শরণার্থী।
জন্ম নেয় নতুন ধারণা- বিশ্বায়ন,
কিন্তু হারিয়ে যায় সকলে মিলার শুভবুদ্ধি।
আধিপত্যের নতুন নাম নয় এইড,
উন্নয়ন সহযোগিতার নামে চলে দাদন ব্যবসা,
সৃষ্টি হয় নতুন নতুন সামাজিক শ্রেণী।
গ্লোবাল সিটিজেন- এর পরিবর্তে
আমরা পরিণত হই ভার্চুয়াল নেটিজেন- এ।
শুরু হয় উপনিবেশের নতুন ধারা।
বাড়তে থাকে শিল্পায়ন, নগরায়ন,
বাড়তে থাকে চাকচিক্য আর জৌলুশ।
আর আমরা চোখে চাহিদার ঠুলি পরে
ছুটতে থাকি অর্থনীতির রেসের ঘোড়া হয়ে।

মানব সভ্যতা মানে কি মানুষ সভ্য হওয়া?
গ্রিক সভ্যতায় সক্রেটিস পান করলেন হেমলক,
রোমান সভ্যতায় ক্রুশবিদ্ধ হলেন যিশু,
আর রেনেসাঁ যুগে পুড়িয়ে মারা হলো ব্রুনোকে।
কারণ আমরা তো শুধু মানুষ নই,
প্রাণীও বটে!
মানুষের সভ্যতা মানে সত্য উচ্চারণ,
মানুষের সভ্যতা মানে সত্য দর্শন,
মানুষের সভ্যতা মানে সুষম বণ্টন,
মানুষের সভ্যতা মানে অবাধ বিচরণ,
মানুষের সভ্যতা মানে সদাচারণ।