আহমদ গিয়াস ##
এখন বিশ্বব্যাপী মহা আতংকের নাম করোনা; একটি আণুবীক্ষণিক আকারের মারাত্মক জীবাণঘাতি ভাইরাস। যেটি খালি চোখে দেখা যায় না। ইতোমধ্যে ভাইরাসটির ভয়ে বিশ্বের ভীত সন্ত্রস্ত মানুষগুলো ঘরে বন্দী রয়েছে। আমরাও প্রায় দেড় মাস ধরে ঘরে বন্দী। এই বন্দীত্বের মেয়াদ দিন দিন বাড়ানো হচ্ছে; কারণ ভাইরাসটি প্রতিরোধে আমরা কোন উপায় বের করতে পারিনি। তার উপর পঙ্গপালের আগমনের খবরে আতংকের পারদ আরো চড়ে যায়; যদিও টেকনাফে আসা পোকার দলটি পঙ্গপাল নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

মানব জাতির ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যঘটিত নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বর্তমান সভ্যতা আজকের পর্যায়ে এসেছে। কিন্তু করোনার মত বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কোন উপায় না পেয়ে আমরা এখন অসহায় অবস্থায় ঘরে বন্দী রয়েছি। অথচ প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জৈব প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত প্রকৃতিই আমাদের মাঝে রেখে দিয়েছে।
যেমন ধরুন, আপনার ঘরে ইঁদুরের উৎপাত। আপনি বিষ মেশানো খাবার অথবা যন্ত্র দিয়ে ইঁদুর দমনের চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভুলক্রমে বা অসাবধানবশত: সেই বিষ আপনি নিজেও খেয়ে ফেলতে পারেন বা সেই যন্ত্রে আপনি নিজেই আহত হতে পারেন।

আপনার ক্ষেতে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধে আপনি কীটনাশক ছিটালেন। সেই বিষ কেবল শত্রু পোকা মারল না, উপকারী পোকাও মারল। মারা পড়ল মৌমাছিও; যেটি আপনার ফসলের ফুলের পরাগায়ণে ভ‚মিকা রাখে। আবার সেই বিষ পানির সাথে মিশে আপনার জলাভ‚মির মাছ, হাঁস-মুরগী ও গবাদিপশুসহ উপকারী প্রাণীগুলো মেরে ফেলল। হিসাব করুন- লাভলস।

এখন ধরুন, ইঁদুর প্রতিরোধে আপনার ঘরে যদি একটি বিড়াল রেখে দেন তাহলে সমস্যা সারা। তবে বসতগৃহের ইঁদুর দমনে বিড়াল সবচেয়ে উপযুক্ত হলেও ক্ষেতের ফসলকে রক্ষার জন্য তা যথেষ্ট নয়। ইঁদুরের কবল থেকে ফসল রক্ষার জন্য হয়ত: সাপই সবচেয়ে উপযুক্ত। শিয়ালও ইঁদুর খায়। তবে পেঁচা সাপ-ইঁদুর দুটোই খায়। মানে ইঁদুর ও সাপ নিয়ন্ত্রণে পেঁচাকে ব্যবহার করা যায়।

এবার মশার প্রসঙ্গে আসি। আমরা কি কয়েল, এরোসলসহ এত কিছু আবিষ্কার করেও পেরেছি নিরাপদভাবে মশা দমন করতে? বরং দেখা গেছে, আমরা যত শক্তিশালী ওষুধ আবিষ্কার বা প্রয়োগ করি; মশাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও তত বেড়ে যায়। মশাদের প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক মানুষের কাছেই ক্ষতিকর হয়ে ফিরে আসে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও। দেখুন, মানব শরীরেও একই ওষুধে বার বার কাজ করে না। মানে জীবাণুর দলও ‘রেজিস্টেন্স পাওয়ার’ বা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আবার ক্ষতিকর জীবাণুর আক্রমণেও মানব শরীর নিজের মধ্যে এন্টিবডি তৈরি করে। যেভাবে তৈরি হচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে। অর্থাৎ প্রকৃতিই আপন পথে প্রতিরোধ শক্তি তৈরি করে, ভারসাম্য তৈরি করে। আর এই প্রতিরোধ শক্তি অর্জনের তাকে একটু সহায়তা করা দরকার। সেই দায়িত্ব মানুষের।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের Morphology বা অঙ্গসংস্থান বিদ্যা অনুযায়ী আমরা বন্যা, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, নদী ও সাগর তীর ভাঙন, ভূমিকম্প, খরা, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, আগুণ এবং সুনামির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। আর এসব দূর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। উপকুলে বেড়ীবাঁধ, ব্লকস্থাপনসহ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করছেন। কিন্তু এসব প্রযুক্তি কতটুকু টেকসই, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

সাগরলতা সৈকতে বালিয়াড়ি তৈরি করে; যে বালিয়াড়িকে বলা হয় সমুদ্র সৈকতের রক্ষাকবচ। সাগরলতা আল্লাহর প্রকৌশলী। তাকে আমাদের কোন বেতন-ভাতা বা খাদ্য দিতে হয় না, সে আল্লাহর নির্দেশে এমনিতেই আমাদের জন্য কাজ করে; যদি আমরা আল্লাহর কাছে চাই বা তাকে ঠিকমত বেড়ে ওঠতে দিই। আর করোনা লকডাউনের সুযোগে এ অবহেলিত দ্রাক্ষালতাটি সেকথাই এখন সুস্পষ্ঠভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে। এ উদ্ভিদটির ওষুধীসহ আরো বেশকিছু পরিবেশগত অর্থনৈতিক গুণাগুণ রয়েছে, যার পুরোটা আমরা এখনও উম্মোচন করতে পারিনি।

সাগরলতা ছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় ৭ হাজার প্রজাতির লতা-গুল্ম-বৃক্ষ আছে (সারাবিশ্বে প্রায় ৫ লক্ষ প্রজাতির)। আরো আছে প্রায় ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ ও ১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির আবাসিক ও ২৪০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এবং ১১০ প্রজাতির আন্তর্দেশীয় ও ৩ প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। আছে আরো জানা অজানা হাজার হাজার অনুজীব। যেগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। মানে ফুডচেইন বা খাদ্যচক্র। এই চেইনটি ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর, বাতাস, পানি, জলবায়ূসহ নবায়ণগুলো জ্বালানীও নিয়ন্ত্রণ করে। বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করে। এই চক্রই হল ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুসংস্থান তন্ত্র।
প্রকৃতিতে এর সদস্যদের কাজ আলাদা আলাদা। এই তন্ত্রে কোন অপচয় নেই, কোন কিছু অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে না। প্রকৃতির এই শক্তিগুলোর একটির উপর আরেকটির নির্ভরশীলতা বা ভারসাম্য তৈরির মাধ্যমে স্রষ্টা এ সিস্টেমটি চালাচ্ছেন।

আর একথা উল্লেখ করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে (লা জিন লা কাজাদিখ লাক)। অর্থাৎ সাগর-নদী তীরের ভাঙনরোধ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস রোধ, এমনকি পঙ্গপাল রোধেও এই বায়ো প্রটেকশন সিস্টেম ব্যবহার করতে পারি। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে যে; কোন কোন উদ্ভিদ সাগর ও নদীর ভাঙন ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ঠেকায়, কোন কোন পাখী পঙ্গপাল খেয়ে সাবাড় করে, আর কোন উদ্ভিদ বা প্রাণীটি মশার উৎপাত ঠেকায়।

এখন আগ্রাসী পোকা মাকড় বা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আক্রমণের কারণ হল, নিশ্চয় আমাদের কিছু উপকারী প্রাণী-গাছপালা পরিবেশ থেকে হারিয়ে গেছে। এখন আমাদের জৈবিক নিরাপত্তার জন্য সেই হারিয়ে যাওয়া সদস্যদের ফিরিয়ে আনতে হবে, তাদের বহুমুখী ভ‚মিকা বা ব্যবহার নির্ধারণ করতে হবে এবং তা জনকল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। তাহলে দূর্যোগ মোকাবেলার জন্য আর আমাদের টেনশনে থাকতে হবে না। আর একথার নিশ্চয়তা দিয়েছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। তিনি বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদেরকে স্বচ্ছপানির খালবিল ও নদী-জলাভ‚মিসহ নিরাপদ বাস্তুসংস্থান তৈরি করে দেব। যেখানে তোমাদের এবং তোমাদের গবাদি পশুর জন্য রয়েছে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় কল্যাণকর উপকরণের ব্যবস্থা।

-আহমদ গিয়াস
সাংবাদিক, কক্সবাজার।