আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ভারতে গত দুই দিনে কয়েক হাজার কোটি টাকার মদ বিক্রি হয়েছে। রাজস্ব খাতে বিপুল অর্থ ঢুকেছে সরকারের কোষাগারে। মদের ওপর শুল্ক বসিয়ে আরও রোজগারের আশা করছে সরকার।

সমাজে মাতালদের নিয়ে কম রসিকতা প্রচলিত নেই। মদ্যপান নিয়েও সমাজে নানা ছুতমার্গ আছে। কিন্তু সেই মদই এখন কার্যত ভারতের দুঃসময়ের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা-লকডাউনে যখন অর্থনীতি ধুঁকছে, তখন দুই দিনে রাজ্যগুলোর হাতে বড় অঙ্কের রাজস্ব তুলে দিয়েছে মদ।

পরিসংখ্যানের বেরসিক হিসেব নিকেশে ঢোকার আগে একটু পরিস্থিতির দিকে তাকানো যাক। গত ২৪ মার্চ থেকে দেশের সর্বত্র বন্ধ ছিল মদের দোকান। কিন্তু তাই বলে কি বন্ধ ছিল মদ্যপান? মোটেই না। রাজধানী দিল্লিতে চার থেকে পাঁচ গুণ দামে ব্ল্যাকে বিক্রি হয়েছে মদ।

কীভাবে বিক্রি হয়েছে? মধ্য দিল্লিতে জমি-বাড়ির ব্যবসায় ছোটখাটো কাজ করতেন রবি। মাস গেলে খাওয়া-পড়ার টাকা উঠে যেতো। লকডাউন শুরু হওয়ায় কাজ বন্ধ হয়েছে। অগত্যা স্বামী-স্ত্রী মিলে তরি-তরকারি বিক্রি করতে শুরু করেন। কিন্তু তার মতো আরও অনেকেই কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে একই ব্যবসায় নেমে পড়েন। ফলে সেখান থেকেও লাভ হচ্ছিল না বিশেষ। তখনই ব্ল্যাকে মদ ডেলিভারির কাজ শুরু করেন রবি।

হরিয়ানা বর্ডারে মদের গুদাম থেকে চার গুণ দামে বোতল কিনে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে শুরু করেন। প্রতি বোতলে দু’শো থেকে তিনশো টাকা বকশিশ। পুলিশের ভয় থাকলেও ব্যবসা মন্দ চলছিল না। সোমবার থেকে মদের দোকান খুলে যাওয়ায় সেই রবিই এখন লাইন দিচ্ছেন সরকারি মদের দোকানের বাইরে। ওই একই বকশিশে মদ পৌঁছে দিচ্ছেন মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে। ফলে করোনা লকডাউনের ভয়াবহ সময়ে হাতে কিছু টাকা আসছে।

শুধু রবি নন, সরকারও বুঝতে পেরেছে, অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থার মধ্যে মদ থেকে রাজ্য সরকারগুলো ভালোই আয় করতে পারে। সম্ভবত সে কারণেই মদের দোকানের বাইরে বিপুল লাইন হওয়া সত্ত্বেও রাজ্যগুলো দোকান বন্ধের নির্দেশ দিচ্ছে না। একটা জনপ্রিয় ডিটারজেন্টের বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন হলো- দাগ ভালো। রাজ্য সরকারগুলো মুখে বলছে না বটে, তবে ওই ট্যাগলাইন একটু বদলে দিলেই তাদের মনোভাব ধরা পড়বে- মদ ভালো। যত বেশি মদ, তত সরকারের ঘরে টাকা। কারণ মদ বিক্রির রাজস্ব ঢুকছে রাজ্য সরকারি কোষাগারে। কত সেই পরিমাণ?

ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারতের ২৯টি রাজ্য এবং দিল্লি ও পুঁদুচেরীর মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল একত্রে মদ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করেছিল এক লাখ ৭৫ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় যা ১৬ শতাংশ বেশি।

২০২০-২১ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোর পরিকল্পনা ছিল শুধুমাত্র মদ থেকে বছরে ১৫ হাজার কোটি রাজস্ব আদায় করা। যা রাজ্যের মোট রাজস্ব আদায়ের ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। বিভিন্ন রাজ্যের অর্থ দফতরের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে উত্তরপ্রদেশ মদ বিক্রি থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করেছে ৩১ হাজার কোটি টাকা। কর্ণাটক প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। মহারাষ্ট্র প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

এ বছর যা আরও বাড়বে বলেই রাজ্যগুলো আশা করেছিল। কিন্তু করোনা এবং তার জেরে লকডাউনের কারণে প্রথম এক মাসে সেই অর্থ আয় করতে পারেনি রাজ্যগুলো। একত্রে রাজ্যগুলোর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অন্য খাতেও রাজস্ব আদায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কারণ, লকডাউনের জন্য উৎপাদন ক্ষেত্র কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পেট্রল, ডিজেলের বিক্রি কমেছে। সাধারণত, পেট্রোলিয়াম থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আয় করে রাজ্যগুলো। মদ দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে। ফলে সার্বিকভাবেই অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে।

মদের রাজস্ব মেলেনি। কিন্তু তাই বলে ব্ল্যাকে মদ বিক্রি বন্ধ হয়নি। এটা বুঝতে পেরেই বিভিন্ন রাজ্য কেন্দ্রের কাছে মদের দোকান খোলার জন্য আবেদন জানায়। গত সোমবার থেকে কেন্দ্রও সেই অনুমতি দিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, এর ফলে মাত্র দুই দিনেই বিপুল লাভ দেখতে শুরু করেছে রাজ্যগুলো।

শুধু সোমবারেই উত্তরপ্রদেশে ১০০ কোটি টাকার মদ বিক্রি হয়েছে। আসামের মতো ছোট রাজ্যে অঙ্কটা ৮০ কোটি টাকা।। কর্ণাটকে সোমবার বিক্রি হয়েছিল ৪৫ কোটি টাকার মদ। মঙ্গলবার তা রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে ১৯৭ কোটি টাকা। অন্ধ্রে ৬৮ কোটি টাকা। প্রথম দিন মদের চাহিদা দেখেই রাজ্যগুলো স্থির করে ফেলে এখান থেকেই অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর প্রাথমিক রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে।

মঙ্গলবার থেকে দিল্লি মদের ওপর ৭০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করেছে। পশ্চিমবঙ্গ ৩০ শতাংশ, অন্ধ্র ৭৫ শতাংশ, রাজস্থান ১০ শতাংশ। প্রায় প্রতিটি রাজ্যই নিজেদের মতো করে অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়েছে। বলা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় এই শুল্ক বসানো হয়েছে। ফলে বুধবার থেকে প্রতিদিন আরও বেশি রাজস্ব ঢুকবে সরকারের কোষাগারে। করোনা মোকাবিলায় যে অর্থ ব্যবহার করা হবে। সাহায্য পাবেন গরিব মানুষ। তাই রাজ্য সরকারের কাছে, মদ ভালো।