সিবিএন ডেস্ক:
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী কম শনাক্ত ও মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে– ভাইরাসটির জেনারেশন বদলে যাওয়া, দেশের মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া নিয়ে। তবে দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে বলার মতো সময় এখনও আসেনি। নতুন এই ভাইরাসের বিষয়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে।কিন্তু এই ভাইরাসের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য একই রয়েছে। আর এটা নতুন হওয়াতে মানব শরীর তাকে প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। অন্যান্য ভাইরাসের জেনারেশন যেমন বদল হয়, তেমন কিছু হয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নে তারা বলছেন, কোভিড-১৯-এর ভাইরাস সার্স-সিওভি-২ ধরন বদল করেছে এমন কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।

চীনের উহানে গত বছরের ডিসেম্বরে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। বাংলাদেশে প্রথম কোভিড আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ।শুরুতে দেশে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে করা হলেও এখন দেশের ৩১টি প্রতিষ্ঠানে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। দেশে এখন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আট হাজার ৭৯০ জন। ইতোমধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৭৫ জন।

বর্তমান অবস্থায় যেসব দেশ ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার যুক্তি দিয়ে লকডাউন তুলছে তাদের সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আবার হার্ড ইমিউনিটি তখনই যখন একটি দেশের ৭০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। আবার কেবল আক্রান্ত হলেই হবে না, তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি গ্রো করতে হবে। আবার কেবল অ্যান্টিবডি গ্রো করলেই হবে না, সেই অ্যান্টিবডিকে প্রটেকশন দিতে হবে যাতে আবার সে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত না হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাইরে থেকে কোনও জীবাণু শরীরে ঢুকলে মানুষের শরীরে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে এমন হওয়ার ভিত্তি এখনও পাওয়া যায়নি। কোনও গবেষণাতে এর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ( আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নতুন এ ভাইরাস সম্পর্কে এখনও সেভাবে কিছু জানা যাচ্ছে না, সেজন্য নিশ্চিত করে কিছু বলাও যাচ্ছে না। এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি হয়েছে এটাই প্রমাণিত না, হার্ড ইমিউনিটি তো পরের কথা।’

তিনি বলেন, ‘অ্যান্টিবডি গড়ে ওঠা মানুষ নিজে সংক্রমিত হন না কিন্তু তার মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরাসরি বলেছে এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাজেই কেউ যেন আত্মতুষ্টিতে না ভোগেন যে, শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। সুস্থ হওয়া একজন মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি কতদিন কার্যকর থাকবে সেটা বলার সময়ও এখনও আসেনি।’

মানুষের শরীরে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা খুবই আনস্টেবল অবস্থাতে রয়েছে। কাজেই একবার করোনা হয়ে গেলে তার আবার হবে না এটা একেবারেই মনে করা যাবে না। ভাইরাসটি নতুন করে ‘রিচার্জেজ’ হতে পারে শরীরে আবার ‘রিইনফেকশন’ও হতে পারে। তাই হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে শতকরা ৭০ শতাংশ মানুষের যদি ইমিউনিটি গড়ে ওঠে তখন বাকিদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ইমিউনিটি হয়ে যায়।’

‘কেউ যদি ইমিউন বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায় তাহলে তিনি নিজে আর আক্রান্ত হবেন না, এটা করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে বলা যাচ্ছে না। আর ভাইরাসের লক্ষণ না থাকলেও একটি নির্দিষ্ট সময় সে ছড়াতে পারে, কিন্তু ইমিউন হওয়াটা নিশ্চিত হয় না। আবার যদি এর ভ্যাকসিন বের হয় তখন এটা হবে। যেমন– হাম, মাম্মসসহ অন্য ভাইরাসের ক্ষেত্রে হয়েছে। আবার অনেক ভাইরাস একই মানুষের শরীরে বারবার অসুস্থতা তৈরি করে।’ বলেন মুশতাক হোসেন।

তিনি বলেন, ‘এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে যদি দীর্ঘমেয়াদি ইমিউনিটি সিস্টেম গড়ে না ওঠে তাহলে টিকা আবিষ্কারের কাজটিও কঠিন হয়ে যাবে।’

সার্স-সিওভি-২-এর বিধ্বংসী রূপ বদল হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লোকে বলে বদল হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের কোনও বৈজ্ঞানিক তথ্য এখনও কোথাও পাওয়া যায়নি।’ তবে এর আগে অনেক ভাইরাসের বেলাতেই এটা হয়েছে।

আবার বাংলাদেশে রোগীর সংখ্যা অন্যান্য দেশের মতো না হওয়ার পেছনের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দেশে পরীক্ষা কম হচ্ছে বলে রোগী শনাক্ত কম হচ্ছে। এটা যেমন সত্যি, তেমনি ইনফেকশন কম। এটার স্থান ভেদে পার্থক্য রয়েছে। যদি এর ভয়াবহতা কমে যেত তাহলে ঢাকা শহরে এত রোগী হতো না।’ ব্যাখ্যা দেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈর হচ্ছে কিনা? প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের পরীক্ষা করলেই কেবল এটা বোঝা যাবে।’ আবার যাদের লক্ষণ প্রকাশ হচ্ছে না তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তারা ভাইরাসটি বহন করছেন, তাই তাদের থেকেও অন্যরা সংক্রমিত হবেন। আর এটাই আমাদের জন্য শঙ্কার বিষয়।’

যদি কোনও দেশের জনসংখ্যার ন্যূনতম দুই তৃতীয়াংশ মানুষ ইমিউন হয়। তখন সেখানে হার্ড ইমিউনিটি চলে আসে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তখন আর সেটি ছড়াবে না।’

যদি কোনও সমাজে শতকরা ৭০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ কোনও ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি ডেভলপ করে, তখন বাকি ১০ ভাগ মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই আর সংক্রমিত হবে না মন্তব্য করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কোনও ভাইরাস যত দ্রুত মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে সে ভাইরাস তত দ্রুত মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। একই সঙ্গে এই অ্যান্টিবডি আদৌ তাকে প্রটেকশন দেবে কিনা সে বিষয়েও এখন নিশ্চিত নয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কারণ, সুস্থ হয়ে যাওয়া মানুষ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন এমন উদাহরণ রয়েছে।’