আবুল ইরফান আজিজুল হক 

পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস মাহে রামাদান। এ মাস তাক্ওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণের মাস। কুরআনের আলোময় পথ নির্দেশনায় আলোকিত এ মাস আসে নৈতিক প্রশিক্ষণ ও সংযম শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি মানসে তাক্ওয়া সৃষ্টি করে আদর্শ সমাজ গঠনের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। রামাদান – মানে জ্বালিয়ে দেওয়া, পুড়িয়ে ফেলা। প্রকৃতপক্ষে এক মাসের সিয়াম সাধনা মানুষের সারা বছরের নানাবিধ পার্থিব ঝুট ঝামেলা ও প্রবৃত্তির নানা লোভ-লালসার মোহে আচ্ছন্ন যাবতীয় কুচিন্তা, শয়তানী ওয়াস্ওয়াসা, পাপাচারমূলক কাজ কর্ম ও এর অনুভূতিকে পুড়িয়ে ফেলার এক কার্যকর অনুশীলন। আন্তরিকতার সাথে মাস ব্যাপী এ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে তাক্ওয়ার এমন ভাবধারা তৈরী হয়, যা তার পাশবিক প্রবৃত্তিকে সংযত ও অবদমিত করে এবং আত্মিক শক্তিকে জাগ্রত ও বিকশিত করে।

‘তাক্ওয়া’ একটি কুরআনী পরিভাষা। এর আভিধানিক অর্থ পরহেজ করা, বিরত থাকা, ভয় করা, সীমা অতিক্রম না করা। আর পারিভাষিক অর্থ হল মহান আল্লাহ’র সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ও তাঁর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তাঁর সকল আদেশ যথাযথ ভাবে পালন করা এবং নিষিদ্ধ কাজসমুহ থেকে দূরে সরে থাকা। হযরত উবাই বিন কা’ব রা. এর এক বর্ণনায় তাকওয়ার স্বরূপ চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। হযরত উমার বিন খাত্তাব রা. একবার তাঁেক জিজ্ঞাসা করেন, ما التقوى তাক্ওয়া টা কী? জবাবে তিনি বললেন, আমীরুল মু’মিনীন! এমন রাস্তা অতিক্রম করার সুযোগ কি কখনো আপনার হয়েছে, যা অত্যন্ত সরু এবং দুদিক দিয়ে কাঁটাওয়ালা ঝোপঝাড়ে ঘেরা? হযরত উমার রা. বললেন, ‘বেশ ক’বার হয়েছে।’ তখন হযরত উবাই জিজ্ঞেস করলেন, এমন ক্ষেত্রে আপনি কী করেন? হযরত উমার বললেন, ‘আমি আমার কাপড় চোপড় জড়ো করে ধরে সংযত হয়ে চলি, যাতে কাঁটায় জামা আটকে না যায়।’ তখন হযরত উবাই বললেন, এটাই তাক্ওয়া।

আমাদের জীবন চলার পথ চতুর্দিক থেকে লোভ-লালসা, প্রবৃত্তির তাড়না, স্বার্থপরতা, স্বজনপ্রীতি, অন্যায়-অনাচার, গোমরাহী-নাফরমানীর শতসহস্র কাঁটাযুক্ত ঝোপ-জঙ্গলে আচ্ছন্ন। আজ দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা করেও চাটুকারিতা, ঘুষ, দুর্নীতি, শঠতা-প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আমার সামনে স্বল্প সময়ে বড় পদবী অর্জনের হাতছানি, পণ্যে ভেজাল দিয়ে বা খাঁটি লেবেল লাগিয়ে নি¤œমানের মাল চালিয়ে দিয়ে হঠাৎ বড় লোক হওয়ার অপার সম্ভাবনা; খুব সহজেই অশ্লীলতা-বেহায়াপনার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে পাশবিকতা চরিতার্থ করার সুবর্ণ সুযোগ। এসবে না জড়িয়ে তা থেকে নিজেকে পবিত্র রেখে সামনে চলা আজ বড়ই কঠিণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় চোখ-কান খোলা রেখে পথের এসব কাঁটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে অত্যন্ত সতর্ক পদক্ষেপে পা ফেলে সম্মুখ পানে অগ্রসর হওয়ার নামই তাক্ওয়া। আর এ তাক্ওয়াতে অভ্যস্থ হবার প্রশিক্ষণ হিসেবেই রোজা ফরয করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, يا ايها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون হে ইমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাক্ওয়া অর্জন করতে পার।

বস্তুতপক্ষে রামাদানের সিয়াম সাধনা মানুষের মন, মনন ও সার্বিক চেতনায় বান্দাহর সামনে মহান আল্লাহ’র সার্বত্রিক ও সার্বক্ষণিক উপস্থিতির অনুভূতি জোরদার করে। ফলে সে অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও কিংবা নির্জনেও পানাহার বা ইন্দ্রিয় তৃপ্তির মত সিয়ামের পরিপন্থী আচরণের সাহস করেনা। কেননা তার বিশ্বাস, সে সর্বত্র-সর্বদা আল্লাহ’র দৃষ্টিসীমার মধ্যেই রয়েছে; তাঁর আদেশ লংঘনে তিনি শাস্তি দিতে পারেন। এর নামই তাক্ওয়া। আল-কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী এটাই রামাদানের আসল উদ্দেশ্য।

তাকওয়ার গুণাবলী অর্জনের ক্ষেত্রে সিয়াম সাধনা যে কতখানি প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করে, তা রোজার বিধি-বিধানের দিকে তাকালে সহজেই অনুধাবন করা যায়। একজন রোযাদার ভাল ভাবেই জানে যে,

রোজা মানে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হালাল পানাহার এবং ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা।
এর অন্যথা হলে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে।
তা সে প্রকাশ্যে না করে গোপনে করলে সমাজে সে রোজাদার হিসাবে গণ্য হলেও আল্লাহ’র কাছে সে রোজাদারের কোন মর্যাদা পাবেনা। অর্থাৎ রোজা তখনই সঠিক ও পূর্ণতা পাবে, যখন তা কেবল আল্লাহরই জন্য হবে।
সে আরো জানে যে, রোজা রাখলে তার পুরস্কার এ জগতে পাবেনা এবং না রাখলে তার শাস্তিও এ জগতে পেতে হবেনা।
৫. সে এ ও জানে যে, সে সঠিক ভাবে রোজা রাখছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণের জন্য তার পেছনে কোন চৌকিদার-পাহারাদার বা পুলিশ-গোয়েন্দাও নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে সাওম পালন করে থাকে, তার যে আত্মিক প্রশিক্ষণ হয়ে যায়, তা প্রকৃতপক্ষে তাক্ওয়ার প্রশিক্ষণ। কেননা সে বিশ্বাস করে যে,

আল্লাহ সর্বক্ষণ সর্বত্র বিরাজমান। তিনি গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ ভাবে অবগত।
পুরস্কার ও শাস্তির জন্য এ পার্থিব জগতই শেষ জীবন নয়, বরং এর জন্য রয়েছে আখিরাত। সেখানে তাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে।
এ বিশ্বাসের ফলশ্রুতিতে তার মধ্যে স্বত:স্ফূর্ত ভাবে এমন দায়িত্বানুভূতি সৃষ্টি হয় যে, বান্দাহর জৈবিক চাহিদা, লালসা সব কিছুই আল্লাহর নির্দেশের সামনে জলাঞ্জলি দিতে তৈরী থাকে।

মাস ব্যাপী রোজার এ প্রশিক্ষণ তার রূহানী শক্তিকে এতটাই দৃঢ় ও তেজস্বী করে তোলে যে, সে পার্থিব সকল লাভ ও লোভ-লালসাকে আখিরাতের সাফল্যের আকাঙ্খায় অতি তুচ্ছ ও সামান্য জ্ঞান করে। অন্যথায় তার পক্ষে কঠোর বিধি-বিধানের এ রোজা পালন করা কখনো সম্ভব হতনা। এ ভাবেই রামাদানের যথাযথ প্রশিক্ষণকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে বান্দাহ সারা বছর সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও উন্নত জীবন যাপন করে পরকালীন জীবনের সফলতা অর্জন করতে পারে। পবিত্র কুরআনে لعلكم تتقون বলে মহান আল্লাহ এটাই বুঝিয়েছেন।

মানুষের মন, মনন ও সার্বিক চেতনায় বান্দাহ্র সামনে মহান আল্লাহর সার্বত্রিক ও সার্বক্ষণিক উপস্থিতির অনুভূতি এবং বান্দাহর জৈবিক চাহিদা, লালসা সব কিছুই আল্লাহর নির্দেশের সামনে জলাঞ্জলি দেওয়ার মানসিকতা ব্যতিরেকে তথা তাক্ওয়ার প্রশিক্ষণ না হলে রোজা রাখার কোন সার্থকতা নেই। তবে রোজা এ জাতীয় হলেও তার ফরয আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু এমনটি রোজা আল্লাহ ফরয করেননি। বুখারী শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে মহানবী সা. বলেন, من لم يدع قول الزور و العمل به فليس لله حاجة فى ان يدع طعامه و شرابه যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা বলা ও অযাচিত কাজ পরিহার করলনা, তার পানাহার পরিত্যাগের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। হাদীসে রোজার যে মহৎ প্রতিদান আল্লাহ স্বহস্তে দেবেন বলে প্রতিশৃ্রুতি দিয়েছেন, তা লাভ করতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে হালাল পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তির মত জৈবিক চাহিদা পরিহারের পাশাপাশি কথায় ও কাজে রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী কর্মকা-ও পরিহার করতে হবে। তা না হলে আমাদের রোজা হবে নি®প্রাণ, নিষ্ফলও নিছক উপবাস যাপন। বুখারী শরীফেরই আরেক হাদীসে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, كم من صائم ليس له من صيامه الا الجوع و كم من قائم ليس له من قيامه الا السهر অনেক রোযাদার এমন আছেন, যাদের রোজার প্রাপ্তি শুধু উপবাস, আর অনেক রাত জেগে ইবাদতকারী এমন আছেন, যাদের বিনিদ্র রাত কাটানোই শুধু সার। রোজা ও ইবাদতের আসল প্রতিদান তাদের ভাগ্যে নেই।

আসুন, পবিত্র রামাদানের সুবর্ণ সুযোগে নিজেদের মধ্যে তাক্ওয়ার চরিত্র সৃষ্টি করে আমাদের রোজাকে আমরা সফল ও সার্থক রোজায় পরিণত করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।

 

অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত), ককসবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদরাসা।