মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে প্রকারান্তরে আপনি নিজেকেই ফাঁকি দিচ্ছেন। বিপদ আপনার দরজায় হাজির হয়েছে। তুচ্ছ কারণে ঘরের দরজার বাইরে যাওয়া বন্ধ করুন। লকডাউন (Lockdown) কার্যকর করতে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। এই দুর্যোগের সময় আপনি কঠোর আইনের মারপ্যাঁচে পড়ুন, এটা আমরা চাই না।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম (বার) কক্সবাজারবাসীকে নিজ নিজ ঘরে থেকে লকডাউন কার্যকর করার আহবান জানিয়ে তাঁর নিজস্ব ফেইসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে তিনি একথা বলেন।

স্ট্যাটাসে কক্সবাজারবাসীকে পুলিশ সুপার অনুরোধ করে বলেন, সাত পদের তরকারি খাওয়ার জন্য বাজারে যাওয়া, তুচ্ছ কারণে বাসা-বাড়ীর বাইরে বের হওয়া বন্ধ করুন। ইনশাআল্লাহ বেচেঁ থাকলে অনেক প্রকার তরকারি খেতে পারবেন।

একইদিন অপর একটি স্ট্যাটাসে পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম (বার) বলেন, কক্সবাজারের সম্মানিত নাগরিকেরা লকডাউন আরো কঠোরভাবে কার্যকর করার জন্য বার বার অনুরোধ করছেন। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশকে আরো মানবিক হতে বলেছেন। নাগরিকদের উদ্বেগকে জেলা পুলিশ সম্মান জানাচ্ছে। তারপরেও কিছু বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। করোনা ভাইরাস সংক্রমন রোধে সরকার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থানীয়ভাবে জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে গত ৮ এপ্রিল। আমরা পরিস্থিতি বিবেচনা করে মার্চ মাসের ১৮ তারিখে পর্যটকদের টুরিস্ট স্পট ও বিচে যাওয়া বন্ধ করে দেই। জেলার প্রবেশ পথ চকরিয়ায় চেকপোস্ট বসিয়ে পর্যটকদের কক্সবাজার আসা বন্ধ করে দেই। বেশি আগেই ব‍্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে-উল্লেখ করে অনেকে সেই সময় সমালোচনা করলেও এখন আমাদের সিদ্ধান্ত যথার্থ ছিলো বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে শুধুমাত্র কিছু জরুরী সার্ভিস চালু রাখা আছে।

সরকারি ত্রাণ পুলিশের কাছে আসে না। তা সত্ত্বেও এপর্যন্ত আমরা কয়েক হাজার মানুষকে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে চাল, ডাল, আলু, তৈল তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি। এখন কক্সবাজার জেলা পুলিশ তাদেরই ত্রাণ দিচ্ছে, যারা বিভিন্নভাবে কাজ হারিয়ে সামাজিক মর্যাদাবোধের কারণে সরকারি ত্রাণ নিতে সংকোচবোধ করেন। তারা আমাদেরকে ফোনের মাধ্যমে, ম্যাসেজ করে এমনকি মেইল পাঠিয়ে অনুরোধ করছেন। এ পর্যন্ত এধরনের নিন্ম মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত প্রায় ৩শ’ পরিবারের প্রতিটি পরিবারের কাছে সদস্য অনুপাতে ন্যুনপক্ষে একমাসের খাদ্য সহায়তা নিরবে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া গত ২৩ দিন ধরে প্রতিদিন রাতে প্রায় ১৮০-২০০ জন পথশিশু, ভবঘুরে, অসহায় লোককে খিচুড়ি, ডিম, বিশুদ্ধ পানির বোতল সরবরাহ করছি। এই লোকগুলো বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের খাবারের উপর নির্ভর ছিল। কিন্তু রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় তাদের কষ্ট হচ্ছিলো।

প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ লকডাউন আরো কঠোরভাবে কার্যকর করা হোক বলে দাবি তুলছে। অথচ সে ব‍্যক্তিরা নিজেরাই তুচ্ছ কারণে ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর আমাদের ফোন দিয়ে সরকারি নির্দেশনা লঙ্ঘনের খবর দিচ্ছেন। গত ১৯ এপ্রিল কক্সবাজারে চারজনের করোনা ভাইরাস টেস্ট পজিটিভ ধরা পড়ে এবং দেখা গেছে এই চারজনই ঢাকা নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে কক্সবাজার এসেছেন। এটা নিয়েও ২/১ জন বলেছেন ‘এই হলো প্রশাসনের লকডাউন এর প্রকৃত অবস্থা’!

এসপি এবিএম মাসুদ হোসেন বিপিএম (বার) স্ট্যাটাসে আরো বলেন, এলাকাবাসীর উচিত ছিল পালিয়ে আসা ব‍্যক্তিদের বিষয়ে পুলিশ ও প্রশাসনকে তথ্য দেওয়া। আপনাদের উদ্বেগকে সম্মান জানাই। কিন্তু কক্সবাজারে প্রবেশের মূল পথ ছাড়াও অনেক বিকল্প পথ আছে। অনেকেই নৌপথে বা কাচাঁ মালের গাড়িতে করে কৌশলে এসেছে। শুধু পুলিশ বা প্রশাসনের মাধ্যমে সব তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। সচেতন এলাকাবাসী এদের চিহ্নিত করে তথ্য দিলে প্রশাসনের পক্ষে কাজ করা আরো সহজ হতো। অনেক সচেতন ব‍্যক্তি আমাদের তথ্য দিয়েছেন। আবার অনেকেই দেননি। আবার অনেকেই তথ্য গোপন করেছেন।

১৯ এপ্রিল দিবাগত রাতে তিনি নিজে বিভিন্ন চেকপোস্টে কয়েক ঘন্টা ছিলেন বলে জানান। এসময় কয়েকজনকে প্রাইভেট কারসহ পুলিশ আটকিয়ে দেয়। কেন রাতে বের হলেন-এর ভালো কোনো উত্তর তাদের কাছে নাই। ঘরে ভালো লাগতেছে না, এই একটু বোনের বাসায় গিয়েছিলাম, দিনের বেলা গিয়েছিলাম, ফিরতে একটু দেরী হলো, একটু বিচ দেখতে এসেছিলাম-সব এ ধরনের উত্তর। অনেকেই পুলিশকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য পুরাতন ডাক্তারী কাগজপত্র হাতে নিয়ে বা দু চারটি টেবলেট হাতে নিয়ে ঘুরছেন। এসময় একজনকে পাওয়া যায়, তিনি বন বিভাগে চাকরি করেন। অফিস উখিয়ার ইনানিতে। এসপি এবিএম মাসুদ হোসেন তাকে জিজ্ঞেস করেন রাত নয়টায় কোথায় থেকে আসলেন? বললেন অফিস ইনানিতে, পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসতে আসতে দেরি হলো। মিথ্যার একটা সীমা থাকা দরকার। যেখানে সরকারি দুই একটি অফিস ব‍্যতীত সব অফিস বন্ধ, সেখানে বন বিভাগের এই লোক রাত নয়টার সময় অফিস থেকে ফিরছেন! তার মোটর সাইকেল দুই ঘন্টা আটকিয়ে রাখতে বলেছিলাম, আর এই দুই ঘন্টায় অনেক তদবির! ‌অনেকেই আছেন রাস্তা দিয়ে হাটার সময় লাট বাহাদুরের মত হাটেন‌। পুলিশ তাকে বাসায় যেতে বললে তার ঘায়ে ফোসকা পড়ে যায়। নিজের ক্ষমতা বা আভিজাত্য প্রকাশের জন্য তর্ক শুরু করে দেন। ‘আমি কোন্ হনু রে’ বুঝানোর জন্য তর্ক শুরু করেন। তারা একবারও বুঝতে চান না পুলিশ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে ঘরে ফেরানোর চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, একজন নাগরিক মন্তব্য করেছেন এই বলে যে, দুই দিন আগে একজন সামান্য এসআই তার সাথে একই কারণে খারাপ ব‍্যবহার করেছে। এই সামান্য এসআই কিন্তু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এবং কঠিন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুলিশের চাকুরী পেয়েছে। পুলিশের কনস্টেবলদেরও বড় একটা অংশ এখন ডিগ্রি ও মাস্টার্স পাশ বলে তিনি স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন।

এসপি এবিএম মাসুদ হোসেন বিপিএম (বার) স্ট্যাটাসে আরো বলেন, এই মহা দুর্যোগে বাবার লাশ আনতে ছেলে যাচ্ছে না, মাকে বনে জঙ্গলে ফেলে সন্তানেরা পালিয়ে যাচ্ছে, লাশ দাফনে পুলিশ বা দু’ একজন সরকারি লোক ছাড়া কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না‌। সেখানে মাঠে যারা কাজ করে তাদের দেওয়া সরকারি নির্দেশনা সকলের শুনা উচিত। পুলিশ তো আঞ্জুমান-এ মফিদুল ইসলাম বা সমাজসেবা বিভাগের কর্মী নন। তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। জনগণকে বুঝানোর পাশাপাশি আইন প্রয়োগ করাও তাদের দায়িত্ব। সারাদেশে যে দু’চারটি সরকারি সংস্থা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত মাঠে কাজ করে যাচ্ছে, পুলিশ তাদের অন্যতম। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অসংখ্য পুলিশ সদস্য ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকেই পুলিশ সদস্যদের ছুটিতে যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। তাই তারা কিন্তু শ্বশুর বাড়ি, মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই আক্রান্ত হয়েছে। রাস্তাঘাটে যারা ঘোরাফেরা করে, তারা কিন্তু পরিবারের সদস্যদের তথা বাবা-মা, স্ত্রী সন্তানদের সাথেই থাকতেছেন। তারা অন্ততঃ পরিবারের সদস্যদের সাথে মানসিক প্রশান্তিতে থাকতে পারলেও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা কিন্তু পরিবার পরিজন ছাড়া ব‍্যারাকে একঘেয়েমি জীবনযাপন করছেন এবং সরকারি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। জনগণের সঙ্গে পুলিশের জায়গা জমি নিয়ে ব‍্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। পুলিশ হলো সমাজের আয়না। আমরা যেমন লন্ডনের মানুষ না, তেমনি আমরা লন্ডনের পুলিশ পাওয়াও আশা করতে পারি না। তাই তারা যখন এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ছোটখাটো ভুল করে, তখন তাদের এই ছোটখাটো অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে পরামর্শ দেওয়া ও পাশে থাকার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। তবে সম্মানিত নাগরিকদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, কোনো পুলিশ সদস্যের ব‍্যক্তিগত খামখেয়ালিপনা, অপেশাদারী কর্মকান্ড, অমানবিক আচরন, দুর্নীতি তার ব‍্যক্তিগত কর্মকান্ড হিসেবেই গন‍্য ক‍রে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।

আপনাদের মতো সমাজ সচেতন ব‍্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, ছাত্র ও যুব সমাজকে সাথে নিয়ে জেলা পুলিশ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে মানবিক পুলিশ হিসেবে কাজ করে যাবে ইনশাআল্লাহ। তিনি সকলকে অনুরোধ করেন, পুলিশের বলার অপেক্ষায় না থেকে নিজে থেকেই ঘরে থাকুন, নিজে নিরাপদ থাকুন অন‍্যকে নিরাপদ রাখুন।