ডেস্ক নিউজ:
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের এই জরুরী মুহুর্তে দেশের স্বার্থে রোহিঙ্গা শিবিরে ৪-জি নেটওয়ার্ক চালুসহ বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
তারা মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারকে জাতীয়-আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য দানকারী সংস্থা এবং রোহিঙ্গা নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীগুলির সাথে কোভিড-১৯ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দিতে ৪-জি নেটওয়ার্ক চালু সময়ের দাবী।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে করোনা সচেতনতা বৃদ্ধি ও সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাসে নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করতেও নিরবিচ্ছিন্ন নেটওয়ার্কের বিকল্প দেখছেন না দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা।
তারা বলেছেন, প্রায় ১১ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গার মাঝে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে খাদ্য, আশ্রয় এবং চিকিৎসা সেবা চলমান রাখতে করোনা সংক্রমণের এই সময়ে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মীর শিবিরে প্রবেশাধিকার বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে করে পরিষেবার অভাবে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা বা মৃত্যু না ঘটে।
গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন -দেশের খ্যাতনামা গবেষক ড. মেঘনা গুহ ঠাকুরতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রিদোয়ানুল হক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পীস এন্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক ড. মঞ্জুর হাসান, কোস্ট ট্রাস্ট এর নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, একশন এইড বাংলাদেশ এর কান্ট্রী ডিরেক্টর ফারাহ কবীর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশননের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনম, নারী অধিকার আন্দোলন কর্মী মাহীন সুলতান, বিশিষ্ট আইনজীবী কামরুন নাহার, নাগরিক উদ্যোগ এর প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ নূর খান, এমেরিকান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক কাজী ওমর ফয়সাল, লেখক রেহনুমা আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়েমা খাতুন, নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মুবাশশের হাসান, শিক্ষক ও গবেষক ড. স্বপন আদনান, এডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল নোমান, রুহি নাজ, লেখক/গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী হানা শামস আহমেদ, লেখক/গবেষক পারসা সানজানা সাজিদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ সাইমুম রেজা তালুকদার, মানবাধিকারকর্মী ফরিদা আক্তার, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন, শিরীন প হক।
তারা বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারীটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এই রোগের সংক্রমণটি বাড়তে শুরু করেছে। উখিয়া এবং টেকনাফ অঞ্চলে মোবাইল এবং ইন্টারনেট যোগাযোগের নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ না থাকায় মানবিক সহায়তায় নিয়োজিত কর্মীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সংখ্যা সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না।
তারা মনে করেন, যারা এদের সংস্পর্শে কাজ করছেন তাদের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে এবং প্রতিরোধমূলক কর্মকান্ডের গতি কমিয়ে দিচ্ছে। এই বিধিনিষেধের ফলে, বর্তমানে স্থানীয় জনগণের মাঝে করোনা ভাইরাস উপসর্গগুলো বিদ্যমান থাকলেও তাঁদের পক্ষে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করা কষ্টসাধ্য হচ্ছে।
দেশের বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, বর্তমানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি (বিশেষ করে নারী, বয়োবৃদ্ধ), চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মিসহ জনস্বাস্থ্যে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, মানবাধিকার এবং মানবিক সহায়তায় নিয়োজিত সরকারী এবং বেসরকারি কর্মীবৃন্দ এবং বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের জীবন বাঁচাতে মোবাইল এবং ইন্টারনেট যোগাযোগের মাধ্যমে তথ্যের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংক্রমণটির প্রকোপ রোধের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মাবলী, বিকাশমান মহামারীর সময় সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য এবং হালনাগাদ নির্দেশিকা দ্রুত ইন্টারনেটের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিকট পৌঁছে দেবে এবং তা একইসাথে রোহিঙ্গাদের নেতাদের সাথে সমন্বয় করতেও সহায়তা করবে।
প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ব্যক্তি এবং শিশুদেরসহ শরণার্থী শিবিরে যারা সবচেয়ে বেশি দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, তাদের রক্ষার জন্যে ৪জি নেটওয়ার্ক বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তারা বলেন, করোনা মহামারীকালে গণহত্যাসহ অপরাপর নৃশংস অপরাধসমূহের শিকার প্রায় ৪০০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ ভূখন্ডের নৌ-সীমানা থেকে উদ্ধার করার জন্য বাংলাদেশের জনগণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারসমূহ এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং সাধুবাদ জানাই। একই সাথে, করোনা মহামারীকালে প্রশংসনীয় এবং বিরল মানবিক আচরণের প্রেক্ষাপটে আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য-স্বাস্থ্যের অধিকার, অবাধ তথ্য প্রবাহ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রয়োজনীয় চলাচলের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আবেদন জানাই।
সাম্প্রতিক উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা ব্যক্তিবর্গ, উদ্ধারকারী এবং পরবর্তীতে গণমাধ্যমের বরাতে আমরা জানতে পেরেছি, মানব পাচারকারীদের সহযোগিতায় অনধিক ৫০০জন রোহিঙ্গা শরণার্থী দুইমাস যাবত মালয়েশিয়ায় এবং থাইল্যান্ডে নৌপথে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন এবং দুঃখজনকভাবে, মালয়েশিয়ায় এবং থাই উভয় কর্তৃপক্ষই তাঁদের নৌকা প্রবেশে বাধা দেয়। দীর্ঘ দুইমাস যাবত নৌপথে যাত্রা চলাকালীন সময়ে কমপক্ষে ২৮ জন রোহিঙ্গা মারা গেছেন এবং অনেকেই খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা গেছে। মালয়েশিয়ায় এবং থাইল্যান্ড রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করেছে। বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় সময়ের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা ও কোয়ারেন্টাইন শেষে নিজ আশ্রয় শিবিরে ফেরত যেয়ে যেন কোন রকম বৈষম্যর শিকার না হয় সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশেষত নারী ও শিশুরা যেন কোনভাবেই নিরাপত্তাহীনতার শিকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেই সাথে পাচারকারিদের দেশীয় আইনে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে।
তারা মনে করেন, অবৈধ মানব পাচার বিষয়ে হটলাইন চালু করাসহ অবৈধ পথে মানব পাচার বন্ধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনির তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে অতি-ঘনবসতির কারণে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের আশংকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, ড. রিদোয়ানুল হক, ড. পারভীন হাসান, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ড. মঞ্জুর হাসান, রেজাউল করিম চৌধুরীর মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা।
তারা বলেছেন, বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১,১১৬ জন মানুষ বসবাস করে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের বসবাস। স্বাভাবিক ভাবেই এখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা এখানে মেনে চলা সম্ভব নয়। ফলে কোন ভাবে রোহিঙ্গা শিবিরে কোভিড ১৯ সংক্রমণ হলে তা মারাত্মক গতিতে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। আমরা জানি, সরকার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখনও শিবিরগুলিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা, বিশুদ্ধ পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার অভাব রয়েছে। যদি রোহিঙ্গা শিবির অঞ্চলে করোনা ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণহীন প্রাদুর্ভাব ঘটে, তবে এটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে।
বিবৃতিতে তারা বলেছেন- রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার জন্য বিশ্বস্ত এবং আস্থার জায়গা না থাকার ফলে বিভিন্ন প্রকার গুজবের উপর নির্ভর করছেন। শিকার হচ্ছেন স্থানীয়দের বিদ্বেষমূলক আচরণের। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সংক্রমণে আক্রান্ত হবার আগেই আমরা সরকারকে শরণার্থী, স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং সহায়তা কর্মীদের মানবাধিকার এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আশেপাশে চলমান মোবাইল ইন্টারনেট বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাই।
মোবাইল এবং ইন্টারনেট যোগাযোগ প্রবাহ ক্রমবর্ধমান করোনা ভাইরাস মহামারী থেকে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ এবং সহায়তা কর্মীদের সুরক্ষা এবং কল্যাণে কাজ করবে বলে তাদের ধারণা।
তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বলেন, ৪-জি নেটওয়ার্ক চালু করলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় শক্তি, সাহস ও দক্ষতা তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এই সুরক্ষাগুলো বাংলাদেশের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের পক্ষেও উপকারি হবে।