হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর
ঝরে গেল কাসেমী বাগানের আরও একটি প্রস্ফুটিত গোলাপ। রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চিরতরে চলে গেলেন, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ-এর বিজ্ঞ পরিদর্শক ও চকরিয়া ইমাম বোখারী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, বিদগ্ধ মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুর রহীম বুখারী রহ.।
তিনি ১৬ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার দুপুর ২ টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তিনি ডায়াবেটিক ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ডাক্তারের নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন। তাঁর আনুমানিক বয়স হয়েছিলো ৭১। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, চার মেয়ে সন্তানসহ অসংখ্য শাগরিদ ও গুণগ্রাহী রেখে যান।
মাওলানা আবদুর রহীম বুখারী রহ. চট্রগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আলিম পরিবারের প্রখ্যাত বুযুর্গ মনীষী মাওলানা আব্দুল গনি রহ. এর সন্তান এবং আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় মহাপরিচালক আল্লামা মুফতি আব্দুল হালিম বোখারী ( দা. বা.) ছোট ভাই। তিনি লোহাগাড়া উপজেলার রাজঘাটা হোসাইনিয়া মাদ্রাসায় প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে জামিয়া পটিয়ায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। পরে ঢাকা লালবাগ ও দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে পুনরায় কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। এছাড়াও তিনি সরকারি মাদ্রাসা বোর্ড থেকে কামিল পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১ম স্থান অধিকার করেও বিরল প্রতিভার সাক্ষর রাখেন।
কর্মজীবনে তিনি গারাঙ্গিয়া আলিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস হিসেবে দীর্ঘদিন দরসে হাদীসে খেদমত আঞ্জাম দেন। পরে চকরিয়া উপজেলার ইমাম নগরে ইমাম বোখারী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যু অবধি তিনি এ দ্বীনি শিক্ষায়তনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ইলমে নবভীর বিকাশধারায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে তিনি আল্লামা মুফতি আজিজুল হক রহ. এর সুযোগ্য খলীফা হ্নীলার আল্লামা ইসহাক সদর সাহেব হুজুর রহ. এর কাছ থেকে খেলাফতলাভে ধন্য হন।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ বিচরণ ও দখল ছিল। উপমহাদেশের দার্শনিক রাজনীতিবিদ খতীবে আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ. এর একান্ত শিষ্য হিসেবে তিনি অাকাবিরে দেওবন্দের হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মনোনয়নে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে চকরিয়া আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন।
হেফজখানা ছাত্রজীবন থেকে বিদগ্ধ এ আলেমেদ্বীনকে অনেকবার দেখার ও কাছে বসে নসীহত শ্রবনের সুযোগ আমার হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। ইত্তিহাদুল মাদারিসের সফল ও চৌকশ মুফাত্তিশ ( অডিটর) হিসেবে তাঁর বিচরণ ছিল ইত্তেহাদভুক্ত সব মাদ্রাসায়। আমি যখন রামু জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসার হিফজখানায় পড়ি তখন তিনি মাঝে-মধ্যে আসতেন পরিদর্শনে। ছোট ছিলাম বলে আমরা দুই বোখারী সাহেব হুজুরের মধ্যে প্রথম প্রথম পার্থক্য করতে পারতামনা। তখন কৌতুহলী প্রশ্নের জবাবে আমাদের এক শিক্ষক বলেছিলেন, ইনি( মাওলানা আব্দুর রহিম বোখরী সাহেব) হলেন বোখারী সানী (২য় অধ্যায়) আর আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী সাহেব হুজুর হলেন বোখারী আওয়াল ( ১ম অধ্যায়)।
পরিদর্শনকালে তিনি আমাদেরকে প্রশ্ন করতেন কুরআন শরীফ থেকে, সুন্নাত সম্পর্কেও করতেন, মিসওয়াক চেক করতেন। সুন্নাতী জীবনাধারায় উদ্বুদ্ধ করতেন। শিক্ষক-ছাত্রদের সমবেত করে পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সারগর্ভ ইলমী নসীহত পেশ করতেন। অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ, যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত নসীহতমালায় পুরো মজলিসকে তিনি প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো। হেফজখানার গণ্ডি পেরিয়ে সেখানকার কিতাব বিভাগ এবং রাজকরকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালেও হযরতের তারবিয়াতী নসীহত বহুবার শোনার খোশনসিব হয়েছে। তাঁর রসিকতার ছলে কথা বলার মধ্যে বুদ্ধি ও মেধার ঝলক থাকত। তাঁর নসীহত ছিল সত্যিই হৃদয়ছোঁয়া।
আামাদের অঞ্চলের প্রায় মাদ্রাসার সভায় তিনি তাশরীফ আনতেন। সাবলীল ভাষায় কুরআন-হাদীসের আয়নায় জরুরি আলোচনা করে শ্রোতাদের বিমোহিত করতেন। হাদিয়া-তোহফা বিষয়ে তিনি ছিলেন একেবারেই নির্লোভ। শর্তহীনভাবে দ্বীনি মাকসাদে তিনি দাওয়াত কবুল করতেন। অহঙ্কার, গোঁড়ামি তাঁর মধ্যে দেখিনি। ব্যক্তি জীবনে বহুমুখী প্রতিভাবাধর এ আলেমেদ্বীন অত্যন্ত সাদামাটা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন।
তুখোড় মেধাবী এ আলিম কেবল আরবী, ফার্সি নয়; ইংরেজীতেও পারদর্শী ছিলেন। আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী সাহেব হুজুর আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক নিযুক্ত হওয়ায় কক্সবাজার জেলা ইত্তেহাদের পক্ষ থেকে দেয়া মানপত্রটি আমি রচনা করেছিলাম। হুজুরের সম্মানে চাকমারকুল মাদ্রাসায় আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় আমি যখন মানপত্রটি পাঠ করছিলাম তখন পাশে মাওলানা আব্দুর রহিম বোখারী সাহেব রহ. সাদা কাগজে কি যেন নোট করছিলেন। আমার পাঠ করা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনি দাঁড়িয়ে বললেন ” আমার বড় ভাইয়ের সম্মানে বাংলায় যে মানপত্রটি উপস্থাপিত হয়েছে আমি ইতোমধ্যে সেটি ইংরেজীতে ভাষান্তর করেছি। আমি তা পাঠ করে শোনাচ্ছি।” সেদিন তাৎক্ষণিক তাঁর প্রতিভার বিরল নজীর দেখে উপস্থিতি সকলেই অভিভূত হন।
আমার এলাকা রামু লম্বরীপাড়ায় ২০০৮ সালে ইসলামী সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে তাঁকে দাওয়াত করেছিলাম। তিনি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা করে সর্বস্তরের শ্রোতাদের এমনকি ভিন্নমতের শ্রোতাদেরও বিমোহিত করে তুলেন। সে দাওয়াতের সূত্র ধরেই মূলত হযরতের সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সূত্রপাত। যেখানেই দেখা হতো স্বাচ্ছন্দ্যে কুশল-বিনিময় করতেন। রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসায় আমার শিক্ষকতা জীবনেও যখনই হুজুর তাশরীফ আনতেন সালাম বিনিময়সহ মনখুলে কথা হতো। একবার তিনি পরিদর্শনে আসলে মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা মোহছেন শরীফ ( দা.বা.) আমাকে ডেকে হুজুরকে সম্বোধন করে বললেন ” আপনার যে কোন জরুরত মঞ্জুরকে বলবেন, সে ব্যবস্থা করবে”। এ কথা শুনেই তিনি হাসিমুখে বলে উঠলেন “মঞ্জুরকে বললে সহজেই মঞ্জুর (কবুল) হবে, কারণ সে তো কেবল মঞ্জুর নয়; আবুল মঞ্জুর।”
এরকম সাদামাটা কথামালা ও রসরসিকতায় তিনি মুহুর্তের মধ্যেই মজলিসকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারতেন। সে দিন মাদ্রাসার বিভিন্ন ডকুমেন্টস’র পাশাপাশি আমার হাতে সাজানো মাদ্রাসার নিউজকাটিং খাতাটিও উপস্থাপন করা হলে তিনি বললেন “পুরো আজিজুল উলুম তো এ খাতার ভেতরেই চলে এসেছে।”
আজ হুজুরের এ কথাগুলো হৃদয়ে বারবার নাড়া দিচ্ছে। এ বিদগ্ধজনের সাথে রচিত স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
নাজুক পরিস্থিতির কারণে প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও বিশিষ্ট এ আলেমেদ্বীনের নামাজে জানাযায় অংশগ্রহণ করতে না পারার আফসোস বয়ে বেড়াতে হবে বহুদিন। দু’আ করি আল্লাহ মরহুমের জীবনের যাবতীয় বিচ্যুত ক্ষমা করে জান্নাতের আ’লা মকাম নসীব করুন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সবরে জমিল দান করুন। আমিন।

লেখক-
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক
কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ।