বাংলা ট্রিবিউন ##

করোনায় আক্রান্ত হয়ে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, ডা. মঈনের মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে, প্রথম থেকে সব প্রস্তুত বলে আসা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনও কতটা অপ্রস্তুত।

প্রসঙ্গত, আজ বুধবার (১৫ এপ্রিল) সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে এই প্রথম কোনও চিকিৎসক মারা গেলেন।

ডা. মঈন উদ্দিন কোভিড পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন গত ৫ এপ্রিল। পরের দিনই তাকে সিলেটের শহীদ সামসুদ্দীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু, সেখানে ভেন্টিলেটরসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা না থাকায় স্থানীয় চিকিৎসকদের প্রতিবাদ, এই চিকিৎসকের আকুতি ও তার পরিবারের  দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৮ এপ্রিল তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রেফার করা হয়। পরদিনই তাকে নিয়ে আসা হয় সিলেট থেকে ঢাকায়। ৯ এপ্রিল থেকে প্রথমে আইসিইউ ও পরে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাকে। আজ ভোরে তিনি মারা যান।

তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ চিকিৎসক নেতারা। এদিকে, ডা. মো. মঈন উদ্দিনের পরিবারের দায়িত্ব সরকার নেবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান তিনি।

এদিকে, ডা. মঈন মারা যাওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চিকিৎসকরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। এরইমধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায় আরেকজন চিকিৎসকের সঙ্গে তার কথোপকথনের কিছু স্ক্রিনশট। যেখানে ডা. মঈন লিখেছেন, তিনি হাসপাতালে পিপিই (পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) ছাড়াই রোগী দেখছিলেন।

তার আগে ডা. মঈন তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, সবাই যার যার অংশ পালন করুন, আমরা হাসপাতালে কাজ করছি, আপনি ঘরে থাকুন, আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

এতদিন ধরে চিকিৎসকদের নানা অসুবিধা, পিপিই না পাওয়া, হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা সব যেন একেবারে ক্ষোভ ধরায় চিকিৎসকদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক চিকিৎসকরা সেগুলো লিখতে থাকেন। তাদের কেউ কেউ লিখেন—‘‘করোনার নামে অবশেষে খুন করা হলো ডা. মঈন উদ্দিনকে, আর এ জন্য দায়ী এ দেশের ‘অর্থব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়‘।’’

যেমন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘একটা মানুষ একদিন মারা যাবে এটা জেনেই সে বেঁচে থাকে, মানুষ মারা যাবে, যাবেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে এমন অক্ষম হাহাকার আমাদের সবকিছু চুরমার করে দেয়। একজন ডা. মঈন প্রথমে নিজ শহরে একটা ভেন্টিলেটর চেয়েছিলেন, তারপর এয়ার অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, তারপর চেয়েছিলেন নিদেনপক্ষে একটা আইইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স। আর আমরা ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলাম’ তার এই চাওয়াগুলোকে অগ্রাহ্য করবার জন্য।’’সরকার যখন সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানায় তখন একে সমর্থন দিয়ে নিজের আত্ন নিবেদন এভাবেই প্রকাশ করেন এই বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক।

জানতে চাইলে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটস সংগঠনের মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর সবসময় বলে এসেছে সুরক্ষা সামগ্রীর কোনও অভাব নেই। অথচ ডা. মঈন পিপিই ছাড়াই কাজ করেছেন। কেবল তা-ই নয়, এখন পর্যন্ত চিকিৎসকরা পিপিই ছাড়াই কাজ করছেন। যার কারণে একের পর এক চিকিৎসক সংক্রমিত হচ্ছেন এবং তারাই এর সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছেন।

ডা. মঈনের মৃত্যু আসলে এ সত্যটা চোখের সামনে নিয়ে এসেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কতটা অপ্রস্তুত সেটা সবাইকে দেখিয়ে দিলো, বলেন তিনি।২৫ মার্চে স্নেহভাজন এক ছাত্রের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানান, পিপিই ছাড়াই রোগী দেখছেন তিনি। সরকারিভাবে পিপিই পাননি।

ডা. মঈন উদ্দিনের এক ছাত্র নাম প্রকাশ না করতে চেয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনাতে আক্রান্ত হয়ে স্যার শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন সিলেটে। শরীরের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায়  ঢাকায় উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার আশায় স্যার এই রাষ্ট্রের কাছে চাইলেন একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স; রাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে আমাদের স্যার এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আমার সদা হাস্যোজ্জ্বল স্যার তারপর অনুনয় করে রাষ্ট্রের কাছে একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, হায়রে, রাষ্ট্র তাতে কর্ণপাতই করেনি। অবশেষে স্যার নিজ উদ্যোগে বেসরকারি হাসপাতালের সৌজন্যে একটি সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সে কুর্মিটোলা হাসপাতালে রেফার হলেন এবং আজ সকালে রাষ্ট্রকে সকল দায়ভার থেকে মুক্তি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।’

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, এভাবে যদি একের পর এক চিকিৎসক আক্রান্ত হতে থাকেন তাহলে চিকিৎসা সেবা দেওয়া লোকের সংখ্যা কমতে থাকবে। সেটা যেন না হয় সেদিকে নজর দেওয়া এই মুহূর্তে ভীষণ জরুরি।