মো. নুরুল করিম আরমান, লামা
পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। প্রতি বছর অন্যান্য জেলা উপজেলার ন্যায় বান্দরবানের লামা উপজেলায়ও এ উৎসবের দিনগুলোতে প্রাণে প্রাণে তৈরি হতো উচ্ছ্বাসের বন্যা। সম্মিলন ঘটত পাহাড়ে বসবাসকারী সব জাতিগোষ্ঠী মানুষের। কিন্তু এবারে উপজেলার কোথাও কোন এ উৎসবের উচ্ছ্বাস, আমেজ নেই। সব জায়গায় নীরব-নিস্তব্ধতা। এ উৎসবকে কেড়ে নিল প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। কেবল ঐতিহ্যবাহী সামাজিক রীতিনীতি পালন করতেই তিন দিনব্যাপী উদ্যাপিত হচ্ছে ‘বৈসাবি’।

সোমবার বিকালে কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই উপজেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লীতে মহান সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে পানিতে ফুল ভাসিয়ে নিবেদন করা হয় পুষ্পাঞ্জলি। এছাড়া সকাল ও সন্ধ্যায় পাহাড়িদের ঘরে ঘরে জ্বালানো হয় মঙ্গল প্রদীপ। প্রার্থনা জানানো হয়েছে বৈশ্বিক মহামারী করোনাসহ যাবতীয় ভয়, অন্তরায়, বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-গ্লানির বিনাশ করে নতুন বছরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাতে পৃথিবীর গোটা মানবজাতির অনাবিল সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা লাভ হয়।

জানা যায়, মূলত ১৯৮৫ সাল থেকে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈ-সা-বি’ নামে এ উৎসব পালন করে আসছে। বর্ষবরণ ও বিদায় উৎসবকে ত্রিপুরা সম্প্রদায় ‘বৈসুক’, মারমা সম্প্রদায় ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমা সম্প্রদায় ‘বিজু’ নামে এ উৎসব পালন করে থাকেন। একত্রে ৩টি অক্ষর নিয়ে বৈ-সা-বি বলে পাহাড়ে এই উৎসব পরিচিত। এর প্রথম দিন চাকমারা ফুলবিজু, মারমারা পাইংছোয়াই, ত্রিপুরারা হারি বৈসুক, দ্বিতীয় দিন চাকমারা মুলবিজু, মারমারা সাংগ্রাই আক্যা, ত্রিপুরারা বৈসুকমা এবং তৃতীয় দিন চাকমারা গোজ্যেপোজ্যে দিন, মারমারা সাংগ্রাই আপ্যাইং ও ত্রিপুরারা বিসিকাতাল নামে পালন করে থাকে ঘরে ঘরে।

এদিকে প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমনের ঝুঁকি এড়াতে ১২ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বৌদ্ধ বিহারগুলো লকডাউনের ঘোষনা দেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা। সিনিয়র বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ধর্মীয় নেতাদের সাথে বৈঠক করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে এক প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। লকডাউন চলাকালীন সময়ে ভিক্ষু এবং বিহারে অবস্থানকারী শ্রমনরা যাতে সোয়াইং (ভিক্ষুদের খাবার) খেতে পারেন, সে জন্য বিহারগুলোতে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা দান হিসেবে পর্য়াপ্ত খাবার ও প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীও প্রদান করা হয়েছে বলে জানান, পরিষদ সদস্য ফাতেমা পারুল।

দেখা গেছে, করোনার কারণে এবারই প্রথম পাহাড়ে কোন বৈসাবি পালন করতে হচ্ছে, উৎসব ছাড়াই। কোনা রকম আনুষ্ঠানিকতা নেই। নেই কোনো উৎসব। অথচ যুগযুগ ধরে প্রত্যেক বছর বিপুল আনন্দঘন পরিবেশে উৎসবটি’ পালন করে আসছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষ। এবার করোনার প্রভাবে উৎসব ছাড়াই যার যার ঘরে কেবল পরিবারের মধ্যেই পালন করছে বৈসাবি। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম, পাড়া, মহলা পর্যন্ত উপজেলার সব জায়গায় যার যার বাড়িঘরে নিরাপদে অবস্থান করছে মানুষ। এ প্রসঙ্গে পৌরসভা এলাকার মাস্টার আওয়ামী লীগ নেত্রী উনুসাং ও বড়নুনারবিল পাড়ার শিক্ষিকা সো সো ওয়ান জানান, প্রতি বছর পাড়াবাসীর উদ্যোগে ব্যাপক আয়োজনে বৈসাবি উৎসব পালন করে আসছেন তারা। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এ বছর জনসমাগম সৃষ্টি হয় এমন কিছু কর্মসূচী স্থগিতের পাশাপাশি ঘরোয়াভাবে উৎসব পালন করা হচ্ছে।

লামা উপজেলা কেন্দ্রীয় ‘বৈসাবি’ উৎসব উদ্যাপন পরিষদের সদস্য সচিব মংছিং প্রু মার্মা জানায়, প্রতি বছর উৎসবটিকে ঘিরে উপজেলায় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সরকারি বেসরকারি সংস্থা ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে। এসব কর্মসূচির মধ্যে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী পানি খেলা, বিভিন্ন খেলাধুলা, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, গ্রামীণ পালাগান, র‌্যাফেল ড্র লটারি, পাজন ও পিঠা উৎসব, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রদর্শনী, নাট্যমঞ্চ, চলচ্চিত্র, সাময়িকী প্রকাশনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। জানুয়ারি থেকেই এসব কর্মসূচি গ্রহণের প্রস্তুতি শুরু হয়। এবারও পূর্ব থেকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেও বৈশ্বিক প্রাণঘাতী মহামারী করোনার কারণে তা বাতিল করতে হয়েছে।

এ বিষয়ে লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমন এড়াতে এবারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ও ঘরোয়াভাবে বৈসাবি উৎসব পালনের জন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায়কে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।